দ্য জার্নি টু ফেইথ-১২

লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ১৫ আগস্ট, ২০১৬, ০৯:১৫:৫১ সকাল



“ ... ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি! আমি কোন দিন ভুলবো না! আমাদের এখানের বাঙালি কমিউনিটির এক ভাই জিসান। ছেলেটা আমার সমবয়সী, ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিল। সেই রাতেও যার যার কাজ শেষে আরো ৩ টা ফ্রেন্ডের সাথে সে তার হলে ফিরে যাচ্ছিল। পথে হাইওয়েতে উঠে যেতে হবে। হাইওয়েতে ২ টা আলাদা আলাদা লেইন। ২ লেইনের গাড়িগুলো প্রচন্ড স্পীডে বিপরীত দিকে যার যার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছিল। জিসান রাও গাড়িতে হাসছিল, খেলছিল, ফ্রেন্ডদের সাথে মজা করতে করতেই গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিল! ওদের কোন আঁচ-ও লাগে নাই যে ততক্ষণে মদ খেয়ে মাতাল হওয়া এক ড্রাঙ্ক ড্রাইভার তার ট্রাক নিয়ে হাইওয়ের Wrong way তে ঢুকে গেছে! Wrong way! ট্রাকটা যেই লেইন ধরে ভয়াবহ স্পীডে উড়ে যাচ্ছে, সেই লেইনের প্রত্যেকটা গাড়ি এর বিপরীত দিকে যাচ্ছে! কিছু বুঝে উঠার আগেই জিসানদের গাড়িটার সাথে সেই মাতাল ড্রাইভারের ট্রাকের প্রচন্ডভাবে মুখোমুখি সংঘর্ষ!!সাথে সাথে ২ টা গাড়িতেই আগুণ ধরে ব্রাস্ট হয়ে যায় সবকিছু!! চোখের পলকেই পাঁচটা হাসি-খুশি প্রাণ জ্বলে-পুড়ে পরে থাকে নিথর দেহ হয়ে! মুহুর্তেই সবাই স্পট ডেড!! ( ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন)

এই ঘটনায় আমাদের পুরা কমিউনিটীর সবাই ভেঙ্গে পড়ে! জিসানকে কম-বেশি সবাই চিনতো। হাসিখুশি বাঙালি মুসলিম ছেলে। জিসানকে আমি প্রায়ই ঈদের দাওয়াতে, বাঙালি অনুষ্ঠানে দেখতাম। যদিও কখনো কথা হয়নি আমাদের। ছেলেটার নামটাও আমি ঠিক মতন জানতাম না। কিন্তু ওর এরকম মৃত্যু আমাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়, ভীষণ ভাবে!!!

জানাজার দিন আমরা সবাই গেলাম। জিসানের আম্মু কাঁনতে কাঁনতে একটু পর পর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন, অনেকগুলো আন্টি চারপাশে তাকে শক্ত করে ধরে আছে। জিসানের ৩ বছরের ছোট্ট বোন একটু পর পর বলছে, “আমার ভাই কোথায়? আমার ভাই কোথায়? আম্মু কাঁদে কেন? আম্মু তুমি কাঁদো কেন?”

কিছু আঙ্কেল আমাদের বললেন মেয়েদের কবস্থানের বেশি কাছে না যেতে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি, জিসানের সাদা কাপড়ে মোড়ানো নিথর দেহটাকে নামানো হচ্ছে গর্তে। হঠাত চারপাশের সমস্ত কান্নার আওয়াজ, জিসানের আম্মুর বুক ফাটা আর্তনাদ, চারপাশের দুয়া-দরূদ সমস্ত কিছু ভেদ করে আমার ভিতরে ভীষণ একটা ধাক্কা লাগলো, “হালিমা! কি করছো তুমি তোমার লাইফের সাথে!?” !!!!!!

আসলে কি করছি আমি!! সেই অন্ধকার কবরে আমাকেও যেতে হবে! আট হাত গর্তের নিচে পঁচবে আমার শরীর, আমার সৌন্দর্য্য, যেটা দেখিয়ে বেড়িয়ে আমার কত গর্ব লাগতো। আমার আম্মু-আব্বু, আমার ভাইয়া শত চেষ্টা করেও কেউ আমার কোন সাহায্য করতে পারবে না! সেই অন্ধকার কবরে থাকবো শুধু আমি একা!! ব্যস শুধু আমি আর আমার আমল! সেই আমল, যেই আমলের খাতা খড়খড়ে শূন্য! যে আমলে কিচ্ছু নেই, যেই নামাজে কোন প্রাণ নেই, যেই ব্যবহারে কোন বিনয় নেই, যেই মুখ দিয়ে শুধু গীবত, পরনিন্দা আর গসিপ, যেই হাত দিয়ে শুধু আল্লাহ্‌র অবাধ্য কাজ করা, যে পা দিয়ে হারামের দিকে হেঁটে যাওয়া, যে কান দিয়ে শয়তানের প্রত্যেকটা আদেশ শুনে পালন করা, যেই অন্তর পাপের জন্যে কুচকুচে কালো হয়ে দূষিত হয়ে গেছে, যেই ঈমানে কোন প্রাণ নেই—এসমস্ত... এসমস্ত নিয়ে আমাকে আমার রবের সামনে দাঁড়াতে হবে!! অবশ্যই দাঁড়াতে হবে!! আমার রব তখন যদি আমাকে বলেন, হালিমা তোমাকে তোমার রব সবচেয়ে ভালোবেসেছেন, তোমার খেয়াল রেখেছেন, তোমাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে তোমাকে সত্য বুঝার তাওফিক দিয়েছেন, তাও তুমি তোমার রবকে ভুলে ছিলে? তাও তুমি তাওবা করে আমার কাছে আসোনি? তাও তুমি তোমার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছো? কিসের জন্যে? কার জন্যে??!!

তখন কি জবাব দিব আমি!?! কি বলবো আমি!! আমি কি বলবো যে, আমি শয়তানের জন্যে, নিজের নফ্‌সের জন্যে, দুনিয়ার মানুষকে খুশি করার জন্যে আমার রবকে ঠুকরিয়ে দিয়েছি! নিজের হাতে নিজের জন্যে জাহান্নামের আগুণ কামিয়েছি!! কি বলবো আমি!!!!!

কারো মৃত্যু সংবাদ শুনলে আমরা বলি “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন” অর্থাৎ, “হে আল্লাহ্‌ আমরা তোমার-ই এবং তোমার-ই কাছে আমাদের ফিরে যাওয়া। জিসান আল্লাহ্‌র-ই সম্পদ, সময় হয়ে এসেছে, আল্লাহ্‌ তাঁর জিনিসকে তাঁর কাছে ডেকে নিয়েছেন। আমিও আল্লাহ্‌র-ই প্রোপার্টি এবং আমাকে আমার আল্লাহ্‌র কাছে ফেরত যেতে হবে। মৃত্যুর মতন মহাসত্য আর কিচ্ছু নেই। আমি ভাবতাম, থাক না পরে বুড়ো হয়ে, আমার আম্মুর মতন বড় হয়ে আমি পর্দা শুরু করবো, নামাজ পড়বো ... এই করবো-সেই করবো!! কি চরম ধোঁকা! জিসান কি জানতো যে তার আর বড় হওয়া হবে না!! আমি কি জানি আমার মালেকুল মউতের সাথে Appointment টা কখন! কিসের ধোঁকায় নিজেকে ফেলে রেখেছি!!

জিসানের মৃত্যু আমার চোখ খুলে দিল। জিসান আর কোনদিন সুযোগ পাবে না একটা বার মাথাটা সিজদায় ঠেকিয়ে বলার, “আল্লাহ্‌ গো! মাফ করে দিও!” কিন্তু আমার মতন অবাধ্য বান্দাকে আল্লাহ্‌ সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন! প্রতিটা দিন, প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমাকে তিনি দিয়ে যাচ্ছেন আরো একটা সুযোগ!! তাঁর কাছে ফিরে যাবার সুযোগ! আর আমি কি করছি সেই সুযোগ দিয়ে??

আল্লাহ্‌ সুবহানুতা’আলা যেন জিসানকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন, তাঁর কবরকে জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দেন! দুয়াতে আমিন বলে আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম! আমি সেদিন এত কেঁদেছি, এত কেঁদেছি আমি আমার বাবার মৃত্যুর দিনেও এত কাঁদিনি! নিজের এতদিনের ব্যর্থতা!! এতদিনের গ্লানির কান্না!!!

নাহ্‌! এভাবে আর জীবনে চলা যাবে না। এভাবে আল্লাহ্‌ কে ভুলে থেকে, শয়তানের পূজা করে আমি আর থাকতে চাই না। অনেক হয়েছে, এবার ঘরে ফেরার পালা! বান্দার তার রবের কাছে ফেরার পালা!

বাসায় ফিরে এসে আয়িশাকে ফোন দিলাম, “দোস্ত! বাসায় আয়! কথা আছে!” ...

(চলবে ইনশাআল্লাহ্‌ ... )

[ সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত, ছদ্মনাম ব্যবহৃত হলো]




বিষয়: বিবিধ

১২৫৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

376293
১৫ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৯:৩৬
কুয়েত থেকে লিখেছেন : جزاك الله خيراএভাবে আর জীবনে চলা যাবে না। এভাবে আল্লাহ্‌ কে ভুলে থেকে ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৬ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৫:১৩
312027
শারিন সফি অদ্রিতা লিখেছেন : জাঝাকাল্লাহ খইর!
১৬ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৮:৩১
312030
কুয়েত থেকে লিখেছেন : وشكرا لك يا اختي الكريمة Good Luck Good Luck
376299
১৫ আগস্ট ২০১৬ সকাল ১১:৩৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
১৬ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৫:১৪
312028
শারিন সফি অদ্রিতা লিখেছেন : জাঝাকাল্লাহ খইর
376351
১৬ আগস্ট ২০১৬ দুপুর ১২:৫২
দ্য স্লেভ লিখেছেন : আমরা এখনও জিসানের মতই । আমাদের উপলব্ধী কখনও হয় আবার চলে যায়। আল্লাহ তার ভয় অন্তরে সদা জাগ্রত রাখুক আর ক্ষমা করে দিক। তার ক্ষমা না পেলে সর্বনাশ
২২ আগস্ট ২০১৬ সকাল ০৮:৩৮
312237
শারিন সফি অদ্রিতা লিখেছেন : আল্লাহুম্মা আমিন!
ঈমান এমন আপ-ডাউন করে। কিন্তু সফল মুসলিম সে-ই যে কি না ঈমান Up এর টাইমে অহঙ্কারী না হয়ে যায় এবং ঈমান Down এর সময় হতাশ না হয়ে যায়। ইসলাম মানেই তো একটা ব্যলেন্স জীবন! আল্লাহ সুবহানুতা'আলা আমাদের সবাইকেই ক্ষমা করে দিক, কবুল করে নিক! আমিন
২৪ আগস্ট ২০১৬ সকাল ১০:২৬
312343
দ্য স্লেভ লিখেছেন : সুম্মা আমিন

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File