দ্য জার্নি টু ফেইথ- ৩
লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ০১ আগস্ট, ২০১৬, ০৬:১১:১৩ সকাল
"দিন গড়াতে লাগলো! আমি আমেরিকায় বড় হতে লাগলাম। ততদিনে কট-কট করে ইংলিশ বলাও শিখে গেছি। আমেরিকান বাচ্চাদের সাথে বড় হতে হতে আমি ওদের থেকেও বেশি আমেরিকান হয়ে গেলাম। মিনি-স্কার্ট পড়ে বের হই। প্রত্যেকদিন হয় চুল স্ট্রেইট করে নাহলে চুল কার্ল করে স্কুলে যাই। স্কুলে আমি মোটামুটি Popular Kid। “হালিমা” নামটা কেমন যেন লাগতো, তাই সবাইকে বললাম আমাকে “এশলি” ডাকতে। আমার আমেরিকান লাইফ স্টাইল যদিও আম্মু একদম পছন্দ করত না. কিন্তু ততদিনে আমি অনেক দূর আগিয়ে গিয়েছি। টিনেজ হয়ে গিয়েছি!! আমাকে আম্মু নামাজ পরতে বললে বিরক্ত লাগতো। রোযা রাখতে বললে আরো বিরক্ত লাগতো, এতক্ষণ না খেয়ে থাকার কোন মানে হয়! আর ভুলেও আমার সামনে হিজাবের নাম নিতো না কেউ। ধর্ম নিয়ে কিছু বলতে নিলেই আম্মুকে থামিয়ে দিতাম, "আম্মু এগুলা সব আমাদের গ্রামের মানুষ করে। আমাকে এসব ব্যাকডেটেড জিনিস করতে বলবে না।"
বাসায় নানা রকম অশান্তি লেগেই থাকতো। বাসায় আসলেই চিল্লা-পাল্লা, মারামারি। আব্বু এত রাগী মানুষ, রাগ উঠলে মানুষকে মানুষ মনে করতো না। তার হাত থেকে কেউ-ই রক্ষা পেত না: না আমি, না ভাইয়া, না আম্মু! আমার ভাইয়েরাও আমার সাথে পাল্লা দিয়ে আমেরিকান লাইফস্টাইলে চলতে থাকলো। প্রতিদিন একটা না একটা অকাজ করতো! বাসায় পুলিশ আসতো! অতঃপর আব্বুর পিটানি, মাইর, চিল্লা-পাল্লা! আমার মনে হত আব্বুর হাতে আমরা কেউ না কেউ একদিন মারা পড়বো! শুধু দেখতাম, আম্মু নামাজে অনেক কান্না-কাটী করছে। আমার এসব দেখে আরো রাগ উঠতো! নিজে শক্ত না হয়ে কার কাছে কান্না-কাটি করছে। এমন পরিবেশে বড় হতে হতে আমার আস্তে আস্তে গড, ঈশ্বর – এসব থেকে বিশ্বাস উঠে যেতে থাকলো! আমি আরো বেশি বেশি আমেরিকান ফ্রেন্ড দের সাথে আড্ডাবাজি/ ক্লাবিং করতে থাকলাম বাসার ঝামেলা ভুলে থাকার জন্যে!
আম্মুকে আমি অনেক ভালোবাসতাম, তাই মাঝে মাঝে তাকে খুশি করার জন্যে ভান করতাম যে নামাজে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু মন থেকে কিছুই আসতো না। আর তাও করতাম বছরে একবার কি দুই বার, সাধারণত রমাদান মাসেই এমন করতাম। আমার মা রাত জেগে আমাদের জন্যে কেঁদে কেঁদে অনেক দুয়া করতো।
এর মধ্যে আমাদের বাবা স্ট্রোক করে মারা গেলেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমি তখন হাই স্কুলে! সারাদিন বসে বসে অনেক ভাবলাম ... আসলে কোথায় গড? এই যে সবাই বলে গড এত মহান, এত দয়ালু, এটা তাঁর কেমন দয়া আমাদের পরিবারের উপর!! আব্বুকে বানালেন, তাও এত রাগী করে বানালেন। আমার মনে নেই আব্বু লাস্ট কবে আমার মাথায় হাত দিতে আদর করেছিলেন। এভাবেই তাকে নিয়েও চলে গেলেন। সৃষ্টি কর্তা বলে কেউ আদৌ আছে কি না আমি প্রশ্ন করতে লাগলাম।
এর মধ্যে সাইকোলজির একটা আর্টিকেল পড়তে পড়তে একটা কোয়েশ্চান আসলো, সেখানে জিজ্ঞেস করছিল, “ধরো, আমি যদি তোমাকে বলি যে একটা গাছ, সে নিজে নিজে কয় টুকরা কাঠে ফেটে পড়লো, তারপর নিজে নিজেই হাতুড়ি-পেরেক দিয়ে সাইজ মত করে চোখের পলকে একটা সুন্দর টেবিল বানিয়ে ফেললো, তুমি কি বিশ্বাস করবে?”
তখন আমার খেয়াল আসলো যে, কোন গড নেই এটা সম্ভব না! একটা সামান্য টেবিল-চেয়ার যদি একা একা সৃষ্টি হতে না পারে, সেখানে এত সুন্দর আকাশ, দিন-রাত, গ্রহ-গ্যালাক্সি, অদ্ভুত সুন্দর নিয়মে একা একাই নিজে নিজেই পরিচালিত হচ্ছে- এটা কোন লজিক্যাল স্টেটমেন্ট না। তার মানে গড অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই গডের সাথে আমার তখন অনেক অভিমান, অনেক প্রশ্ন, তাই বেশি মাথা না ঘামিয়ে আমি আমার আমেরিকান ফ্রেন্ড দের সাথে আমার আমেরিকান লাইফ স্টাইলে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
আমার বাঙালি ফ্রেন্ড ও ছিল তবে অনেক কম। এরাও বেশির ভাগ-ই আমার মতই, এখানে বড় হওয়া, এখানের মতই চিন্তা-চেতনা! ওদের সাথে মাঝে মাঝে ঈদের অনুষ্ঠানে গেলে দেখা হত।
এর মধ্যে ঈদ চলে আসলো! তখন ২০১২ সাল। আমার এমনি ঈদ নিয়ে তেমন কোন একসাইটমেন্ট থাকে না। ঈদের অনুষ্ঠানে প্রবাসী মুসলিমরা সবাই বসে বসে মজার মজার খাবার খায় আর গল্প করে। আমি তো বেশি কাউকে চিনি না, তাই আমার বোরিং লাগতো। তবে আম্মুকে প্রতি বছর ঈদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হত। আব্বুর চলে যাবার পরে আমার আম্মুই তো আছে, তাই ভাইরা কেউ না নিলেও আমি-ই ড্রাইভ করে আম্মুকে নিয়ে যেতাম। সেবারো আমার অনিচ্ছা স্বত্তেও মাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম ঈদের অনুষ্ঠানে। আমার কোন আইডিয়াই ছিল না যে সে বছরের ঈদ অনুষ্ঠানে যে আমার জন্যে কি চমক অপেক্ষা করছিল।
(চলবে ইনশা আল্লাহ্ ...)
বিষয়: বিবিধ
১৪৭০ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আগের দুটো পর্বও পড়ে এলাম
খুব গতিশীল বর্ণনা, ভালই লাগছে
সাথে থেকে উৎসাহ দিয়ে যাবার জন্যে অনেক অনেক জাঝাকাল্লাহ খইর!
এমন জাগায় এসে থামিয়ে দিলেন, যেন আগ্রহ অনেকটা বেড়ে গেল।
লিখতে থাকুন। ধন্যবাদ
সাথে থেকে উৎসাহ দিয়ে যাবার জন্যে অনেক অনেক জাঝাকাল্লাহ খইর!
আসলে আল্লাহ যাদের ভালবাসেন, কোননা কোনভাবে তাদের একসময় নিজের কাছে টেনে নেন।
ধন্যবাদ আপু ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন