রমাদান আসে... রমাদান যায় ...
লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ৩০ জুন, ২০১৬, ০৬:৫০:০৮ সন্ধ্যা
ঘড়ির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার পড়তে মন দিল ফারিয়া। ইফতারের আর দুই ঘন্টার মতন বাকি। “টিং-টং”, ফোন টা বেজে উঠলো , এক বড় আপু ফেসবুকে মেসেজ করেছে।
ফেসবুকে ঢুকতেই হোমপেইজে স্কুল জীবনের বান্ধবীর সদ্য প্রো-পিক চেঞ্জ করা সেল্ফি ভেসে উঠলো। মুখটা কিভাবে যেন বাঁকিয়ে একটা ভঙ্গি করা, ভারী করে মেক-আপ দেওয়া, ফিল্টারের এডিটিং এ চেহারা টা ঝলমল করছে, আর সেখানে দেদার্সে ছেলেরা কমেন্ট করে যাচ্ছে। আর বান্ধুবী অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে একটু পর পর এসে একেকটা ইমোজি দিয়ে সেই কমেন্টগুলোর রিপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে। ফারিয়ার একটা মেয়ে হয়েও ওর প্রচন্ড লজ্জা লাগলো, চোখ নামিয়ে নিল। “রোযার সময় এটা না করলেই কি নয়!” ভেবেই পরক্ষণে ফারিয়ার মনে হল, বছর কয়েক আগে ও নিজেই তো এমন ছিল। ও অন্যকে দেখে কি বলবে! আল্লাহ্র নিজ রহমতে ওকে নর্দমা থেকে উঠিয়ে আলোর পথ দেখিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ্!
যা হোক, মেসেজ চেক্ করে নিল। বড় আপু বললো ইন্সটাগ্রামে ওদের মাদ্রাসার বাচ্চাদের খাওয়ানোর প্রজেক্ট নিয়ে একটা পেইজ খুলেছে ডোনেশানের জন্যে। সেটা চেক করতে বলেছেন। ইন্সটাগ্রামে ঢুকেই দেখলো আরেক দৃশ্য। পাঁচ বছর আগের প্রাণ-প্রিয় বান্ধুবী বয়ফ্রেন্ডের সাথে ইফতার করছে, ক্যাপশান দিয়েছে “ইফতারী উইথ জান”। এবার আঁতকে উঠলো ফারিহা!
“তোমার অনর্থক উপোস থাকার আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই”, হাদিসটা মনে পড়ে গেল। মানুষ গুলি কষ্ট করে সারা টা দিন না খেয়ে থাকছে সওয়াবের আশায়, অথচ এমন উপোসের আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন-ই নেই যেটা আল্লাহ্র অবাধ্যতা হওয়া থেকেই তাদের বিরতই না রাখলো। আবারো ফারিয়ার মনে পরে গেল ওর নিজের ভুলগুলোর কথা! ওর নিজের কাছেও ধর্মকে কত কঠিন লাগতো। ধীরে ধীরে ও বুঝেছে, ধর্ম মোটেও কঠিন না, মানুষ নিজের জন্যে এটা আগে থেকেই কঠিন বানিয়ে রাখে কারণ আগে থেকেই তাদের মনে মানার ইচ্ছা নিয়ে দায়সারা ভাব। একবার শক্ত করে নিয়ত করে আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাইলে আল্লাহ্র স্বীয় রহমতে সব সহজ করে দেন। আর ইসলামের নিয়মগুলি মেনে আমরা তো আল্লাহ্র কোন উপকার করছি না, বরং ও নিজেই নিজের উপকার করছে! আল্লাহ্ রহমত করে আমাদের জন্যে নিয়ম গুলি গাইডলাইন হিসেবে দিয়েছেন যেন আমরা দুনিয়াী এবং আখিরাতে ভালো থাকতে পারি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করলো ফারিয়া ওকে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে।
“এই ফারিয়া! এদিকে আয় তো মা!”, আম্মুর ডাকে টেবিল থেকে উঠে গেল ফারিয়া।
গিয়ে দেখে টেবিলে ট্রে ভর্তির রকমারি ইফতার সাজানো!
“যা, পাঁচ তলার আন্টির বাসায় ইফতারী দিয়ে আয়”।
ওড়না, আবায়া, হিজবা, নিকাব সব তড়িঘড়ি করে ঠিকঠাক করতে করতে ট্রে টা তুললো ফারিয়া।
“আরে, পাঁচ তলায় যেতে হলেও ভুত সেজে যেতে হবে নাকি!”
“হ্যাঁ হবে আম্মু, আমার এই ভুত সাজাতেই আনন্দ! হা হা হা!” ফারিয়া দৌড়ে উঠে গেল পাঁচ তালায়। আন্টি দরজা খুললে সালাম দিল।
“ফারিয়া! তোমার আম্মুর বেগুণী তো অনেক মজা হয় । আর সাত তলার ভাবীর বেগুণী তো মুখেই দিতে পারি না। সেদিন ইফতার পাঠিয়েছে শুনো না, প্লেটে কি যে দিল না দিল কিছুই বুঝলাম না, বুটটাও মনে হচ্ছি বাসি, মানুষ যে এমন ... "
“ইয়ে আন্টী থাক্ না ওসব কথা ... !”, ফারিয়া ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল! রোযা রেখে এতগুলো গীবাহ্ শোনা লাগলো একসাথে! রোজা এখনো আছে কি না কে জানে!
“না আমি তো কাউকে হিংসা করে কিছু বলছি না...”
“থাক্ আন্টি। রোযা রেখে এসব শুনতে ভালো লাগে না। আম্মুকে বলে আপনাদের জন্যে আরো কিছু বেগুণী পাঠিয়ে দিব। আসসালামুয়ালাইকুম” . বলে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লো ফারিয়া।
বাসায় এসে দেখে ফারওয়া, সাফিনা আর সাদিয়া এসেছে! ইয়ে এ এ !! এই বান্ধুবী গুলোই হচ্ছে ওর জন্যে চক্ষু শীতলতা কারী! ওরা সাপ্তাহিক হালাকা করে ইফতারের আগে আগে, হাদিসের কথা বলে, কুরআনের কথা বলে, একজন আরেকজন কে দ্বীনের পথে বেঁধে রাখে, একসাথে জান্নাতে থাকা চাই তো!
ফারিয়া সবাইকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“এসেছিস তোরা!! উফ্ কখন থেকে কেমন যে খারাপ লাগছে! আচ্ছা মানুষ কেন রমাদানের মর্ম বুঝে না?”
“এটা সাফিনা ভালো বলতে পারবে! বদ টা এখনো সূরা ক্বদরের দুয়া মুখস্থ শেষ করে নাই! এটা তার গত সপ্তাহের হোমওয়ার্ক ছিল! সাফিনা রোযার মর্ম কেন বুঝো না তুমি?”, বলেই ফারওয়া হেসে দিল!
“এক্সকিউজ মি!! আমি অর্ধেক মুখস্থ করেছি ওকে!! তোমাদের মতন টিং টিং করি আমি! বাসায় ২ টা ছোট বাচ্চা সামলাতে হয়, ওকে!! আমি ছোট, আমাকে এভাবে মারবে না!”, সাফিনা একটা কষে লাগালো ফারওয়া কে!
ব্যস! সবাই হাসতে হাসতে ফারিয়ার মন টাও ভালো হয়ে গেল।
ওদের হালাকা শুরু হয়ে গেল! বিস্মিল্লাহ্!
মন টা খারাপ হয়ে গেল সবার। আর বেশি দিন বাকি নেই রোযার। এভাবেই রমাদান আসে, রমাদান চলে যায়! আমরা গীবাহ্ ছাড়তে পারি না, বয়ফ্রেন্ড ছাড়তে পারি না, নামাজের থোড়াই কেয়ার করি, হিজাব ধরতে পারি না। আমরা কত অবুঝ! যেই সৌন্দর্য্যের জন্যে আমরা আল্লাহ্র অবাধ্য হচ্ছি, সেটা নিশ্চিত না! একদিন ক্ষয়ে যাবে; যেই ছেলের জন্যে আমরা আল্লাহ্র অবাধ্য হচ্ছি, তারও কোন গ্যারান্টী নেই। কুচকুচে অন্ধকার কবরের আলো হয়ে আযাব থেকে বাঁচাবে যে নামাজ, তাকে আমরা দিনের পর দিন অবহেলা করছি। যে প্রভু আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, তাঁর প্রতি আমরা সবচেয়ে বেশি অকৃতজ্ঞ। তিনি দয়া করে আমাদের রমাদানের মতন মাস্ দিয়েছেন, তাও আমরা বেখেয়াল!
রমাদান নিজেকে গড়ে তোলার পারফেক্ট মাস্! রহমতের মাস্ চলে যাচ্ছে। কতটুকু গড়ে তুললাম নিজেকে জানি না। ওদের সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো জিবরাঈল(আঃ) হাদিসটি পড়ার সময়,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা মিম্বরে উঠার সময় তিনি সিড়িতে তিনবার আমিন বললেন। সাহাবীগণ এর কারণ জানতে চাইলে উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি যখন প্রথম শিড়িতে পা দিলাম তখন জিবরাঈল (আ.) বললেন, “ধ্বংস হোক সে ব্যক্তি যে, রমাদানের রোযা পেল কিন্তু সে রোযা রেখে জীবনে গুণাহসমূহ মাফ করাতে পারেনি। আমি বললাম, আমীন। “
রমাদানের এই শেষ ক্ষণে এসে মনে ভয় আর আশা। ভয় যদি ঐ ধ্বংস হয়ে যাওয়াদের মধ্যে শামিল হয়ে যাই, আশা যে, রহমতের, জান্নাতের সবগুলি দরজা এখনো খোলা আছে আমাদের জন্যে। শুধু ফেরার অপেক্ষা। আল্লাহ্র কাছে তাঁর যোগ্য বান্দা হয়ে ফেরার। আল্লাহ্ আমাদের সবার রমাদান কবুল করে নিক! আমিন
“আল্লাহু আক্বার ... আল্লাহু আক্বার...” ঐ যে মাগরিব হয়ে গেছে! ফারিয়ারা ইফ্তার করতে উঠে গেল।
বিষয়: বিবিধ
১৪৩৩ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সময় এবং ধৈর্য্য নিয়ে লিখাটি পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ! জাঝাকাল্লাহু খইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন