মেনে নিবেন তো ??
লিখেছেন লিখেছেন শারিন সফি অদ্রিতা ০৭ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:১২:৩৫ দুপুর
“তখন মাত্র কয়মাস গেলো আমি কুরআন শিখা শুরু করেছি। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন আমার আমাকে ওস্তাদজী বলে উঠলেন, “আমাকে এক বাক্যে গোটা কুরআনের সারাংশটা বলো তো বাবা?”
আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওস্তাদের দিকে। সত্যিকার ভাবে কুরআনকে উপলব্ধি করতে শিখেছি এই ক’মাস হলো! এরই মধ্যে কিভাবে পুরা কুরআনের সারাংশ এক কথায় তুলে আনবো?
আমি আস্তে আস্তে ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলাম, “ওস্তাদ! আপনি কি শিউর যে আমি আপনার প্রশ্নের উত্তরটা জানি?”
ওস্তাদ আশ্বাসের সাথে বললেন, ‘হা বেটা! জানো তুমি’
আমি তখন জান-প্রাণ দিয়ে ওস্তাদের ক্লাসগুলো মাথার মধ্যে রিভিউ করতে লাগলাম! কিছু একটা যেন মনে পরলো! তারপর, ভেবে-চিন্তে ধীরে ধীরে ওস্তাদকে বললাম,
“ আচ্ছা গোটা কুরআনের সারাংশ- “আল্লাহ্ তা’আলাকে এক প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নেও এবং নিজেকে আল্লাহ্তা’আ-র একজন গোলাম হিসেবে স্বীকার করে নাও!”
ওস্তাদ হাসিমুখে বললেন, “ ইয়েস্! You are right!”
এটা হচ্ছে ওস্তাদ নুমান আলী খানের প্রথমদিকের কুরআন শিখার একটা ঘটনা, উনার এক লেকচারে উনি এটা শেয়ার করেছিলেন। উনার কথাগুলি আমার মনে প্রচন্ড রকমের দাগ কাটে! খুবই সাধারণ একটা কথা যদিও-- আল্লাহ্কে প্রভু মানা এবং নিজেকে আল্লাহ্-র গোলাম মানা- কিন্তু, আসলেই নিজেকে কি পুরাপুরি একজন গোলাম হিসেবে স্বীকার করতে পেরেছি আমি? নাকি ‘গোলাম’ শব্দ টাই শুনলেই আমার ‘কেমন জানি’ লাগা শুরু হয়ে যায়? ‘গোলাম’- সেটা আবার কি!?! ‘গোলাম’ হতে হবে কেন?? ...???!?.
.. ... ... ... ...
ফিরে যাই ওস্তাদের কাছে। কুরআনের সারাংশ হিসেবে ওস্তাদ যা বলেছেন, সেটা খুব বেসিক একটা কথা যা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের যে জিনিসটা মাথায় ক্লিক করতে চায় না, সেটা হলো--আল্লাহ্তা’আলা কে এক প্রভু হিসেবে মানতে কিন্তু অনেক সময়েই আমাদের কোন সমস্যা হয় না, কিন্তু সমস্যা টা দেখা যায় কোথায় জানেন?? আমরা নিজেদের কে ঠিক গোলাম হিসেবে কল্পনা করতে পারি না!
“... হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই আমি আল্লাহ্কে প্রভু হিসেবে মানি! কি বলিস্ আমার ধর্ম ইসলাম! আমি মুসলিম! আমি মানি, আল্লাহ্ একমাত্র প্রভু!! ... ইয়েস্! ইয়েস্! কিন্তু কি বল্লি তুই ? আল্লাহ্ বলেছেন যে, এটা করা যাবে না?? এটা কেমন কথা হলো?? এত সাধারণ-সামান্য একটা জিনিস্ হারাম করলো কেন আল্লাহ্? .. যাহ্! মানি না!! ...”
কি উপরের কথাগুলি একটু পরিচিত লাগছে কি?? কিছু টা হলেও কি ঘুরেছে না এমন কথা আমাদের মাথায় ??
গোলাম স্বভাবতই অনুগত! আর আমরা? ঠিক উল্টা-- স্বভাবতই উদ্ধত!
“কেন এত সামান্য সামান্য বিষয়কে হারাম করে রাখা হয়েছে?”
“ছেলেদের অভদ্রতার জন্যে কেন আমাকে কষ্ট করে হিজাব করতে হবে ?”
“ আরে গানটাও শোনা যাবে না!!”
“ইসলামে সব-ই দেখি হারাম!”
- এগুলো কি একজন গোলামের মুখে সাজায়? বিশেষ করে প্রভু যখন প্রতিটি হালাল-হারামের কারণ ব্যাখ্যা করে, পরম যত্নে গোলামের কল্যাণ ও ভালোর জন্যে প্রত্যেকটি নিয়ম-নীতি নাযিল করে গিয়েছেন, সেই ব্যাখ্যায় একটা চোখ পর্যন্ত না বুলিয়ে শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন বিদ্ধ করে যাওয়া— এটা করলে বুঝি প্রকৃতপক্ষে ‘আল্লাহ্-র বান্দা’ হওয়া গেলো?
এত কথা এজন্যে বলছি যে, আমাদের কেমন যেন একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, যেহেতু আমরা ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু” পড়ে আল্লাহ্ তা’আলা কে এক প্রভু হিসেবে মেনে নিয়েছি, আমাদের কার্যসিদ্ধি! কিন্তু, না! দাঁড়ান ভাই! আল্লাহ্ কে শুধু এক প্রভু মানলেই হবে ? একজন প্রভু থাকার মানে, সেই প্রভুর গোলামও আছে, আর আল্লাহ্ সুবহানুতা’আলার গোলাম আপনি-আমি ছাড়া আর কে?
আমরা কি আসলেই মানছি নিজেদের কে আল্লাহ্-র গোলাম হিসেবে? উঠতে-বসতে আমাদের মাথায় কি ঘোরে—“ দুনিয়ার কাছে যতই নিজেকে ‘সুপার কুল’ কেউ মনে করি, আল্লাহ—র চোখে আমি স্রেফ একজন গোলাম?” কি ঘুরেছে কি?
আর কেনই বা নিজেকে গোলাম মানতে এত কষ্ট হবে ? এই প্রভু তো আর দুনিয়ার দশটা প্রভুর মতন না। এই প্রভু তো দিন-রাত আপনার উপর খবরদারি করছেন না! এত ক্ষমতা তাঁর, পুরা আসমান ও জমীন তাঁর, অথচ বান্দার জন্যে তিনি দেখিয়ে যাচ্ছেন অপরিসীম দয়া, ভালোবাসা, করুণা! সুবহান আল্লাহ্!
অন্যান্য প্রভুরা গোলামকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে, আর এই প্রভু আপনাকে মুক্ত বিহঙ্গের মতন স্বাধীনতা দিয়েছে। আপনাকে আপনার পথ বেছে নিবার সুযোগ দিয়েছে...সুযোগ দিয়েই কিন্তু আপনাকে একা একা ছেড়ে দেয়নি, আপনাকে ভালো-মন্দ পথের জ্ঞান ও দিকনির্দেশনা পর্যন্ত দিয়ে গেছেন, কুরআন নাযিলের মাধ্যমে, অন্তরচক্ষু দিয়ে কখনো সেটা পড়ে দেখা হয়েছে কি? আপনি সেটা না পড়লে কি দোষটা প্রভুর, নাকি আপনার?
অন্যান্য প্রভুরা কিন্তু গোলামের পান থেকে চুন খস্লেই সর্বনাশ!! গর্দান বুঝি এখনি গেলো! আর দেখুন এই প্রভুকে... দয়াময় আল্লাহ্ তা’আলা!! কিয়ামত পর্যন্ত তাওবার দরজা খুলে তাঁর বান্দার অপেক্ষায় আছেন! চরম থেকে চরম গুনাহ্ করলেও তিনি কিন্তু সাথে সাথে শাস্তি দিচ্ছেন না... অথচ মহাপরাক্রমশীল তিনি চাইলেই সবকিছুকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারেন মুহুর্তেই, কিন্তু না! না! তিনি তাঁর গোলামের উপর অত্যন্ত দয়াবান... অত্যন্ত মহান!
তিনি তাঁর গোলামের দেখাশোনা করেন, খাওয়ান, পরান, তাঁর গোলামকে কি অবস্থায় কি কি করতে হবে- সবকিছু আসমানী কিতাবের মাধ্যমে বান্দাদের জানানোর ব্যবস্থা করে গিয়েছেন... শুধু জানিয়েই ক্ষান্ত হননি... তিনি যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়ে তাঁর প্রিয় বান্দাদের কেমন হতে হবে- তার দৃষ্টান্ত-ও দেখিয়ে দিয়েছেন... সর্বশেষ রাসূল(সাঃ) এর মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে দ্বীনকে সম্পূর্ণ করে দিয়েছেন। কিভাবে তিনি বান্দাদের পরীক্ষা নিবেন, সেই পরীক্ষার প্রশ্ন-উত্তরসহ কখন কি করতে হবে- সবই জানিয়ে দিলেন ... !! সবকিছু !! কত দয়া আল্লাহ্ সুবহানুতা’আলার !!
তাঁর মতন আর কেউ-ই নেই সুবহান আল্লাহ্ ! কেউ-ই না! “ওয়ালাম ইয়া কুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ”__ তাঁর সদৃশ আর কেউ-ই নেই ! এমন প্রভুর মতন আর কোন প্রভু হয় না! এমন শিক্ষকের মতন আর কোন শিক্ষক হয় না! এমন দয়াশীলের মতন আর কোন দয়াময় হয় না !! তিনি এক, অদ্বিতীয় , অতুলনীয়, অতি পবিত্র, তাঁর প্রতিটি গুণে, তাঁর প্রতিটি কাজে! তিনি এক, তিনি ইউনিক!!
তাহলে, ডিয়ার মুসলিম জাতি! কেন বুঝেন না? ‘ইউনিক’ প্রভুর এক ‘ইউনিক’ গোলাম হবার মাধ্যমেই যে ‘ইউনিক’ রকমের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়! (আলহামদুলিল্লাহ্!) যে প্রভুর মতন আর কেউ-ই নেই, যেই প্রভুর কোন তুলনাই নেই, যে প্রভুর প্রভুত্ব স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমেই দুনিয়া ও আখিরাতের সবরকম মুক্তি, কেন সেই এক প্রভুর গোলাম হিসেবে নিজেকে স্বীকার করে নিতে এত কষ্ট? কেন?
যতই মুখে বলেন না কেন, কে বলেছে আমি স্বীকার করি না! হ্যাঁ আমি গোলাম হিসেবে মানি তো নিজেকে!
হুম্! মুখে তো বললেন, কিন্তু কাজে?? কাজে কি সেটা মানা হচ্ছে? নিজের সাথে নিজে ধোঁকাবাজি আর কতদিন? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করুন, আসলেই মানার দৌড় কতটুকু ?
এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা গেলে কি আপনার চোখ দিয়ে পানি আসে? রমজান ছাড়া কি কুরআন শরীফের একটা পাতাও উল্টে দেখতে ইচ্ছা করে? কখনো কি আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে হিজাবে/দাঁড়িতে কল্পনা করে মনে মনে হেসেছেন? কখনো কি হলিউড, বলিউডের Looser দের ভিড়ে রাসূল(সাঃ), নূহ্(আঃ), ইবরাহীম(আঃ) সহ এই আসল হিরোদের রোল মডেল হিসেবে মানা হয়েছে? তাঁদের জীবনী ও হাদীস পড়তে ইচ্ছা হয়েছে?
কখনো কি মনে হয় যে, কেমন হবে সেই মুহুর্তটা যেদিন আল্লাহ্-র সামনে দাঁড়িয়ে কতটুকু যে তার বান্দা হতে পেরেছেন তার হিসাব দিতে হবে?
কেমন হবে সেই মুহুর্তটা যখন আপনার রেজাল্ট কার্ডের জন্যে আপনি ওয়েট করতে থাকবেন? আপনি কি তখন উদ্ভ্রান্তের মতন ভাবতে থাকবেন, ‘এসব কি হচ্ছে? এসব কি হচ্ছে?” এর কাছে ওর কাছে দৌঁড়াতে থাকবেন কয়টা নেকী ধার করার জন্যে ? নাকি আল্লাহ্-র একজন সার্থক বান্দা হবার পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ্-র আরশের ছায়াতে শান্তিতে অপেক্ষা করতে থাকবেন আর ভাবতে থাকবেন,“ ইশ্! কখন যে জান্নাতের দরজা টা খুলবে” ???
কোনটা ???
সবকিছুর মানদণ্ড কিন্তু ঐ এক প্রশ্নে গিয়েই ঠেকবে - কতটুকু ভালো বান্দা হতে পেরেছেন আল্লাহ্ সুবহানুতা’আলার !?! আর এবেলা বলে রাখি, সমাজের সাদা চোখের “ভালো মানুষ” আর আল্লাহ্-র চোখে একজন “ভালো বান্দা”- এই দুইয়ের মাঝে প্রায়-ই কিন্তু দেখা যায় আকাশ-পাতাল তফাৎ !
সঠিক বান্দার সংজ্ঞা জানতে হলে আবারো ফিরে যেতে হবে আমাদের প্রভুর কাছেই... তিনি কিন্তু খুব যত্ন করে শিখিয়ে দেন... আপনি শুদ্ধ নিয়তে বুঝে বুঝে কুরআন পড়তে থাকলেই টের পাবেন আল্লাহ্ আপনার কতই না কাছে আছে ...!
কতই না কাছে! পরম বন্ধুর মতন... কি শান্তির সে পরশ ! কি আনন্দের !
ইশ্ ! এমন বন্ধুর মতন প্রভু থাকলে আর কি লাগে বলেন??
কি যাবেন তো আপনার প্রভুর কাছে শিখতে ?
মেনে নিবেন তো নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভুর একজন সার্থক গোলাম হিসেবে?
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৮ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যথার্থই বলেছেন জনাব। অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগ্লো বেশ...
তবে 'তিনি যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়ে তাঁর প্রিয় বান্দাদের কেমন হতে হবে- তার দৃষ্টান্ত-ও দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন' এবং এই জাতীয় বাক্যগুলোতে একটু টেকনিকাল সমস্যা আছে। আল্লাহ কোথাও যাননি, তিনি যা দেখালেন তা কতটুকু আমরা অনুসরন করছি তা তিনি পর্যবেক্ষণ করতে রয়েছেন। সুতরাং, 'দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন' না বলে শুধু 'দেখিয়ে দিয়েছেন' বললে মনে হয় বেশি সঠিক হয়। কি বল আপু?
আলহামদুলিল্লাহ্ এমন গুণবতী বোনের উসিলায় আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে শুদ্ধ করে দিলেন!
এখনি এডিট করে ঠিক করে দিচ্ছি দাঁড়াও >- >-
কথাটা পজিটিভলি নেয়ার জন্য যাজ্জাকাল্লাহ আপু।
মন্তব্য করতে লগইন করুন