হজের জন্য স্থল ও নৌপথ খুলে দিতে হবে
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজুর রহমান ০৩ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:৩৫:৫৬ দুপুর
ইসলামের ৫টি মূল ভিত্তি বা স্তম্ভের অন্যতম একটি হচ্ছে ‘হজ’। হজ সামর্থ্যবান সকল মুসলমান নর-নারীর ওপর ফরজ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি শারীরিকভাবে সম ও সুস্থ, আর্থিকভাবে মক্কায় যাওয়া-আসার মতো সঙ্গতি আছে, যাতায়াতের জন্য রাস্তা নিরাপদ ও পরিবারের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে, এমন প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর অবশ্যই হজ ফরজ। যখন কারো ওপর কোনো ফরজ কাজ এসে যায় তখনই তার সে ফরজ আদায় করা জরুরি হয়ে যায়। কারণ আমরা কেউ আমাদের মৃত্যুর দিনণ জানি না। আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ হচ্ছে, ‘আর তোমরা আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির জন্যে হজ ও ওমরা পালন করো’ সূরা বাকারা আয়াত ১৯৬। আরো নির্দেশ হচ্ছে, ‘আর যে ব্যক্তির ঐ ঘর (কা’বা) পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে, সে যেন এই ঘরের (মালিকের উদ্দেশ্যে) হজ আদায় করে, আর যদি কেউ এই বিধান অস্বীকার করে, তার জেনে রাখা উচিৎ আল্লাহ তা’য়ালা সৃষ্টিকুলের মোটেও মুখাপেী নন’ সূরা আল ইমরান, আয়াত ৯৭। হজরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি মহান আল্লাহ তা’য়ালার ঘর পর্যন্ত পৌঁছার মতো শক্তি-সামর্থ্য থাকার পরও যদি হজ না করে তবে সে ইহুদি বা নাসারা হয়ে মৃত্যুবরণ করুক, তাতে আল্লাহ তা’য়ালার কোনো পরওয়া নেই’। তিরমিজী শরীফ হাদিস নং ৭৫৯।
এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত ‘হজ’ নিয়ে কি করছে বা কি করা উচিৎ তা নিয়ে ভ্রান্তিতে আছে বর্তমান সরকার। সরকারের ভ্রান্তির কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের হজনীতি ভুলনীতিতে ভরা। সরকারের ভুলনীতির সাথে স্বাভাবিক কারণেই দুর্নীতি জেকে বসে। সরকারের ভুলনীতি আর দুর্নীতিকে ত্বরান্বিত করে হজ নিয়ে সরকারের বাণিজ্যনীতিকে।
২০১৩ সালে বা ১৪৩৪ হিজরীতে মুসলিম বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজে যাওয়ার কথা থাকলেও হজ করার সুযোগ পেয়েছে ৮৭ হাজার ১২৬ জন। সৌদী সরকারের সাথে হজ যাত্রীর কোটা চুক্তির চাইতে ৪০ হাজারেরও বেশি লোক অর্থাৎ চুক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হজ যাত্রী হজে যেতে পারেননি। এই বিরাট সংখ্যক হজ যাত্রী হজে যেতে না পারার কারণ বহুবিধ। কারো কারো মতে সরকারের ইসলামের প্রতি উদাসীনতা বা ভুলনীতি আর দুর্নীতির কারণে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত বছর ধর্মপ্রাণ অনেক মুসলমান মামলার কারণে হজে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায়ের পর থেকে শুরু করে হেফাজতে ইসলামীর আন্দোলন ও ৫ মে ২০১৩ মতিঝিলের শাপলা চত্বরের সমাবেশ পরবর্তী সময় পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে, জেলায় ও থানায় প্রায় ৬ হাজার মামলা হয়েছে। এসকল মামলায় আসামি করা হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ও বিএনপির নেতা কর্মী আর কওমী মাদরাসার আলেম, মসজিদের ঈমাম, খতিবসহ প্রায় সাড়ে আট লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে। এসকল মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে কেউই হজে যেতে পারেননি বলে ভুক্তভোগী ও তাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন অভিযোগ করেছেন। আমাদের দেশের সাধারণ মুসলমান মূলত কওমী মাদরাসার আলেম ও মসজিদের ঈমাম বা খতিব সাহেবদের সাথেই হজে যেতে আগ্রহী; এসকল আলেম ও ঈমামগণ অধিকাংশই হলেন হেফাজতে ইসলামীর মামলার আসামি আর কিছু আছেন যাদের বিরুদ্ধে মামলা না হলেও ভয়ে তারা আত্মগোপনে ছিলেন বা এখনো অনেকেই আত্মগোপনে আছেন। যার ফলে এসকল আলেম ও ইমাম সাহেবদের অনুসারীগণও হজে যেতে পারেননি।
এবছর সৌদী সরকারের সাথে চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশী হজযাত্রীর সংখ্যা হচ্ছে ১,০১,৭৫৮ জন। যা গত বছরের চাইতে ২৫,৪৪০ জন কম। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এবারও হয়তো বা অর্ধেকের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজে যেতে পারবেন না। সরকারের মামলাসহ বহুবিধ কারণের মধ্যে ব্যয় বৃদ্ধিও অন্যতম একটি কারণ বলে কেউ কেউ মনে করছেন। ২০০৯ সালে আ’লীগ সরকার মতায় আসার পর কয়েক দফা হজ যাত্রীদের বিমান ভাড়া বৃদ্ধি ও বাংলাদেশ বিমান ও সৌদী এয়ার লাইন্স ব্যতীত অন্য কোনো বিমানে হজযাত্রী পরিবহন করতে না দেয়ায় হজযাত্রীদের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশী হজযাত্রীদের জন্য যেখানে গত বছর বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫শ ডলার; সেখানে সাধারণ যাত্রীর জন্য এখনো বাংলাদেশ বিমানের ভাড়া হচ্ছে ৭শ ডলার আর সৌদী এয়ার লাইন্সের ভাড়া হচ্ছে ৬৫০ ডলার । বাংলাদেশ বিমানে ৭ শত ডলার ভাড়ার সাথে ট্রাভেল ট্যাক্স গুণতে হয় প্রায় ১৪ হাজার ৬শ টাকা আর সৌদী এয়ার লাইন্সে ৬৫০ ডলার ভাড়ার সাথে ট্রাভেল ট্যাক্স হচ্ছে ৪ হাজার পাঁচশ টাকার কিছু বেশি। বিমান ও সৌদী এয়ার লাইন্স ছাড়া অন্য যে কোনো এয়ার লাইন্সের ভাড়া ১শ থেকে দেড়শ ডলার পর্যন্ত কম। বিমান সবচেয়ে বেশি ভাড়া ও ট্যাক্স নেয়ার পরও প্রতি বছর লোকসান দিচ্ছে বলেও জানা যায়। আর এ লোকসানের হাত থেকে বিমানকে বাঁচানোর জন্যই নাকি হজযাত্রীদের েেত্র দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ।
সরকারের ভুলনীতি, দুর্নীতি আর বাণিজ্যনীতির খেসারত দিচ্ছে এদেশের সহজ সরল ও ধর্মপ্রাণ হজযাত্রী সাধারণ মুসলমানগণ। ১৯৯৭ সালেও হজের সময় বিমানের বা সরকারের বলতে গেলে একতরফা বাণিজ্যনীতির সাথে দুর্নীতির কারণে হজযাত্রীদের এহরামের কাপড় পড়ে বিমান অফিস ঘেরাও করতে হয়েছিল। যারা সারা জীবনের ুদ্র ুদ্র সঞ্চয় দিয়ে আল্লাহর এই দুনিয়ায় তাঁর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত কা’বা ঘর জিয়ারত বা হজ করতে চায় তাদের নিয়ে সরকারের বাণিজ্যনীতি অনৈতিক বলে ভুক্তভোগী অনেকেই মনে করেন। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে সারা জীবনের ঘাম ঝরা শ্রম বিক্রি করে পরিবার পরিজনের ব্যয় নির্বাহ করার পর বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে জীবনে একবার হজ করতে চায়। তাদের ব্যাপারে সরকারের নীতির পরিবর্তন হওয়া দরকার বলেও অনেকেই মনে করেন।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের হজযাত্রীদের জন্য বিমান ভাড়া ৬ শত ডলারেরও কম। ভারত ছাড়াও এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার হজযাত্রীদের ও বিমান ভাড়াসহ যাবতীয় ব্যয় বলতে গেলে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের তুলনায় অর্ধেক বা তার চেয়েও কম। কি কারণে সরকার প্রতি বছর হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া বৃদ্ধিসহ আনুষাঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন আছে। নানান জন নানান মন্তব্যও করছেন।
৯০% মুসলমানের দেশে সরকার যেখানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো পালনে সার্বিক সহযোগিতা করার কথা, সেখানে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ‘হজ’ নিয়ে সরকার বাণিজ্য শুরু করেছে। সরকারের এই বাণিজ্যের ফলে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান জীবনের ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কারণে একটি ফরজ কাজ আদায় করতে পারছেন না।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে সে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ ৯০ হাজার ইন্ডিয়ান রুপি থেকে ১ লাখ ২০ হাজার রুপির মধ্যে হজ পালন করতে পারছেন যা বাংলাদেশী টাকায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার মধ্যে। চলতি বছর বা ১৪৩৫ হিজরীতে যারা হজ করতে চাচ্ছেন তাদের জন্য সরকারিভাবে সর্বনিম্ন খরচ ধার্য করা হয়েছে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৭ শত ৭৬ টাকা যা গত বছরের চাইতে প্রায় ১০ হাজার টাকা বেশি। হজযাত্রী পরিবহনের জন্য সরকার এবারও বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স ও সৌদী এয়ার লাইন্স এর ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে।
হজ এজেন্সি এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (হাব)-এর প থেকে দাবি করা হয়েছে, হজযাত্রী পরিবহনে সকল এয়ার লাইন্সকে অনুমতি দেয়ার জন্য। এনিয়ে গত বছর হাইকোর্টে মামলাও করা হয়েছে। মামলায় হাব এর দাবির পে রায় আসলেও সরকার তা মানতে রাজি নয়। সরকার যদি সব এয়ার লাইন্সকে হজ যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয় আর ভাড়ার ব্যাপারে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে মিল রেখে ভাড়া নির্ধারণ করে তাহলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা কম খরচে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ হজ আদায় করার সুযোগ পাবেন।
সরকার ইচ্ছা করলে নৌ-পথে ও সড়ক পথেও হজ যাত্রীদের পরিবহনের ব্যবস্থা করতে পারে। আমাদের দেশ থেকে নৌ-পথে হজযাত্রী পরিবহনে অনেক আগ্রহী নৌ-পরিবহন সংস্থা আছে। ষাট ও সত্তরের দশকেও বাংলাদেশ থেকে নৌ-পথে অনেকেই হজ পালন করেছেন। কম খরচে ও নিরাপদ ভ্রমণে হজযাত্রীদের নৌ-পথ হতে পারে সর্বোত্তম মাধ্যম। এ ব্যাপারে সরকারের সুষ্ঠুনীতি ও সিদ্ধান্ত একান্ত প্রয়োজন বলে হজ এজেন্সির বর্তমান ও প্রাক্তন কয়েকজন নেতা মনে করেন। তাছাড়াও সরকার চাইলে সড়ক পথেও হজযাত্রীদের পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে। সড়ক পথে বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক বা কুয়েত হয়ে সহজেই বাংলাদেশী হজযাত্রীগণ সৌদী আরব যেতে পারেন।
বাংলাদেশী হজযাত্রীদের নিয়ে সরকারের বাণিজ্যনীতির কারণে বাণিজ্য করছে সরকারের দেয়া লাইসেন্সধারী কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশের অধিকাংশ হজযাত্রী তারা সরকার ও সরকারের লাইসেন্সধারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চাইতে মসজিদের ঈমাম, খতিব বা আলেম ও পীর সাহেবদের বেশি পছন্দ করেন। এযাবৎ যতোগুলো প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই সরকার ও সরকারের দেয়া লাইসেন্স ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বাইরে যারা লেনদেন করেছেন তারাই প্রতারিত হয়েছেন। গতবছরও অনেক হজযাত্রী এমনি প্রতারণার স্বীকার হয়ে হজে যেতে পারেননি। সবমিলিয়ে হজযাত্রীদের নিয়ে বাণিজ্যিক চিন্তা না করে তাদের দুর্ভোগের কারণ ও তা নিরসনের উপায় সরকারকেই বের করতে হবে।
লেখক: গাজী মুহাম্মদ শওকত আলী
বিষয়: বিবিধ
১৪০৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন