আওয়ামী লীগের তাত্ত্বিক দেউলিয়াপনা

লিখেছেন লিখেছেন উড়ালপঙ্খী ০৬ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:৫০:৫৮ রাত

জনাব তাজুদ্দিন আহমদ এবং মুজিববাদীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই।

শ্রেণীগতভাবে আওয়ামী লীগ ছিল বুর্জুয়া এবং পাতি বুর্জুয়া শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারি দল। কিন্তু এই দলে জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল এবং সমাজতন্ত্রীরাও ছিল।এ কারণে বিপরীতমুখী চিন্তা-ভাবনা দলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, অসন্তুষ্টি এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি করে।

প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ প্রচার করেছেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা খাঁটি সমাজতন্ত্রই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে অন্য কিছু নয়। তার এসব বক্তব্য ও প্রচারণাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের ক্ষমতার অর্ন্ত-দ্বন্দ্বগুলো ক্রমান্বয়ে উম্মোচিত হতে থাকে। ক্রমবর্ধমান সমস্যার মোকাবেলার জন্য ১৯৭২ সালের ১০ইমে চট্টগ্রামে এক জনসভায় আওয়ামী লীগের লেজুড় দল ন্যাপের সভাপতি জনাব মোজাফফর আহমদ সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্‌বান জানাতে বাধ্য হন।

আগেই র্বর্ণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অনাস্থা ও যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যে কোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ উপদেষ্টা ভারতের অন্যতম কূটনীতিবিদ জনাব ডিপি ধরের পরামর্শে এবং বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের একাংশের বিশ্বাসঘাতকতায় মুক্তি বাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছিল বিএলএফ পরবর্তিকালে মুজিব বাহিনী।

বাংলাদেশের চারজন ছাত্রনেতা ভারতীয় সরকারের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই চতুরঙ্গ তোফায়েল, রাজ্জাক, শেখ মনি ও আব্দুর রাজ্জাক পরবর্তিকালে বাংলাদেশের 'চার খলিফা' নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। তাদেরই একজন জনাব তোফায়েলকে দিয়ে ১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ এ ঘোষণা করা হল, “মুজিববাদ কায়েম করব। মুজিববাদের চার স্তম্ভ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।” তিনি মুজিববাদের একটি ব্যাখ্যাও দিলেন। তিনি বললেন, “মহান মার্কিন নেতা আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার জনগণকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কিন্তু সমাজতন্ত্র দিতে পারেননি। কার্ল মার্কস সমাজতন্ত্রের স্থপতি কিন্তু তার দর্শনে ছিল না গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা। মুজিববাদে রয়েছে দু’টোই গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র। সুতরাং মুজিববাদ বিশ্বের তৃতীয় মতবাদ কিংবা রাজনৈতিক দর্শন।” তিনি আরো বলেন, “পুজিঁবাদ ও কম্যুনিজমের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে মুজিববাদ কায়েম করে সোনার বাংলা গড়ে তোলা হবে।” তিনি বাংলাদেশের জনগণকে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ‘জাতীয় বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্‌বান জানান। জনাব তাজুদ্দিনকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই জনাব তোফায়েলের মাধ্যমে মুজিববাদ নামক এক উদ্ভট এবং অদ্ভূত রাজনৈতিক দর্শনের উপস্থাপনা করা হয়। ৩রা জানুয়ারী ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার এক ঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হবে বলে খবর প্রচার করে।

যুব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে ফিরেই মুজিব পরিবারের অনুকম্পা ও সহানুভূতি লাভের আশায় জনাব তাজুদ্দিন আহমদ সম্পর্কে কদর্য্য প্রচারণা নতুন করে শুরু করেন। তারা বলেন, “শেখ মুজিবের প্রতি তাজুদ্দিনের কোন আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামের কৃতিত্বের দাবিদার তিনি একাই হতে চান।” তারা আরো বলেন, “শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষক সেটাও জনাব তাজুদ্দিন স্বীকার করেন না। তাছাড়া শেখ মুজিবকে উপেক্ষা করার আর একটি নজির এই যে, তিনি তাকে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী না করে ক্ষমতার অভিলাষে নিজেকেই প্রধানমন্ত্রী বানান এবং শেখ মুজিবকে শুধুমাত্র সাংবিধানিক ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার উদ্দেশ্য সৎ হলে তিনি শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে নিজে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও প্রবাসী সরকার পরিচালনা করতে পারতেন।”

এমনিভাবে তাজুদ্দিনের প্রতি শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের মন বিষিয়ে তুলেছিলেন তারা। শেখ মনির এতে মুখ্য ভূমিকা ছিল। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফেরার পর উল্লেখিত নেতৃবৃন্দ শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে তাজুদ্দিনের বিরুদ্ধে আরো সক্রিয় হয়ে উঠেন। শেখ মুজিব যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রাম কালের নয় মাস নির্বাসিত ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে সেই অনুপস্থিতির পুর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন তারা। তার সামনে কেঁদে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার নাটক করে এদের অনেকেই বলেছিলেন, “আপনার ভাবমুর্তি ও নেতৃত্ব রক্ষা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে তাজুদ্দিনের বিরাগভাজন হয়েছি আমরা। তিনি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাবার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। শেখ কামালকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবার হুকুম দিয়েছিলেন তিনি। শুধু আমাদের বিরোধিতায়ই সেটা সম্ভব হয়নি। আমরা জোর করে তাকে মুজিবনগর হেডকোয়াটার্স এ কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসাবে রেখেছিলাম।” আরো অনেক কিছু বলে তার কান ভারী করতে সক্ষম হয়েছিলেন কুচক্রী ক্ষমতালিপ্সু যুব নেতৃবৃন্দ। শেখ মুজিব তাদের কথার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ পেলেন না। কেননা, তার পরিবারের সদস্যগণ আরো রূঢ় ভাষায় তাজুদ্দিনের বিরুদ্ধে তাদের মনের খেদ প্রকাশ করেন শেখ মুজিবের কাছে। এর ফলেই দেশে ফেরার মাত্র একদিন পরই ১১ই জানুয়ারী ১৯৭২ শেখ মুজিব তার দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত সহকর্মী জনাব তাজুদ্দিনকে অপসারন করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসলেন। জনাব তাজুদ্দিনকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে বাদ না দিলেও তাকে সব ব্যাপারে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে চলতে লাগলেন শেখ মুজিব। প্রশাসনিক ব্যাপারে আবার তিনি যুব নেতৃবৃন্দের উপরই সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। ফলে যুব নেতৃবৃন্দ জাতীয় পরিসরে সর্বময় ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে গেলেন। তাদের মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ হল। কিন্তু শেখ মুজিবের এ ধরণের আচরণে মনোক্ষুন্ন হলেন দলের বর্ষিয়ান নেতারা।

(যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি---মেজর ডালিম)

বিষয়: বিবিধ

১১৫৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

203197
০৬ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১১:৪৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : তাজউদ্দিন আহমদ এর অর্থনৈতিক চিন্তা ধারা একেবারেই ভুল ছিল। তারই প্রভাবে সব কিছু জাতিয় করন করা হয়। যার ফল থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি।
203337
০৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৬
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : জাজাকাল্লা খাইরান.. অনেক ভালো লাগলো পড়ে
০৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২১
152657
উড়ালপঙ্খী লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাই Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File