যারাই প্রতিবাদ করেছিল, মৃত্যু অথবা অমানুষিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত হতে হয়েছিল তাদের।

লিখেছেন লিখেছেন উড়ালপঙ্খী ০৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০৬:১৮:১৩ সকাল

১৯৭৩ সালের মধ্যেই যারা স্বৈরাচার এবং আওয়ামী অপশাসনের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছিল তাদের কে মৃত্যু কিংবা অকথ্য নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়।

১৯৭৩ সালে ঐ সময়ের উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক সাংবাদিক জনাব আবুল মনসুর আহমদ দৈনিক ইত্তেফাকে বিভিন্ন বিষয়ে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখে অসীম সাহসের পরিচয় দেন।

‘আজ আর একচেঞ্জ অব হার্ট নয়, চাই চেক অব হার্ট’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি বলেন, “মানুষের হৃদয়ের চার চেম্বারের মতই আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতির সকল ক্ষেত্রেই চারটি করিয়া চেম্বার আছে। প্রথমত: আমাদের সংবিধান দাড়াইয়া আছে চারটি স্বতন্ত্র মজবুত মূল নৈতিক খুঁটির উপর। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ (জাতীয়তা তন্ত্রই বেশি শুদ্ধ হইত) ও ধর্মনিরপেক্ষতা (এখানেও তন্ত্রযোগ করিলে ভাল হইত)। এই চারটি নৈতিক খুটিকে ‘স্বতন্ত্র’ বলিলাম এই দন্ডে যে, সংবিধান রচয়িতাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন, ওই চারটি খুঁটি এক ঘরের খুঁটি হইতে পারে না। খুঁটিগুলির উচ্চতা সমান নয় বলিয়াই তারা এক ঘরের খুঁটি হইতে পারে না। নীতি ও পন্থা হিসাবে এই চার বস্তুর মিল নাই একথাই বোধ করি সমালোচকরা বলিতে চান। তার মানে হৃদপিন্ডের চারটি চেম্বারের মধ্যে যেমন সহযোজক দরজা (কানেকটিং ভালব) আছে, আমাদের চার নীতির মধ্যে তেমন কোন কানেকটিং ভালব নাই। তারপর সংবিধানের বেলাতেও আমরা প্রচলিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোকে টানিয়া বুনিয়া চারি চক্রে আনিবার চেষ্টা করিয়াছি এবং যথাসম্ভব সফলও হইয়াছি। অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রচলিত এক্সিকিউটিভ, লেজিসলেটিভ ও জুডিশিয়ারী এই তিনটি ইন্সটিটিউশনকে ‘নির্বাহী বিভাগ’, ‘আইন বিভাগ’ ও ‘বিচার বিভাগ’ নামে সংবিধানে গুঞ্জায়েস করিয়াছি সত্য; কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে যা অত্যাবশ্যক অথচ সংবিধানের কর্মবিভাগ বা দেশরক্ষা বিভাগে যার বিধান করা সম্ভব ছিল না; সেই রূপ একটি স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্যারামিলিটারী বাহিনী গঠন করিয়া আমরা রাষ্ট্রকে চারটি শক্তি স্তম্ভের উপর দাড় করাইয়াছি। এই চারটি শক্তি স্তম্ভের সাথে পাঠকগণ চারটি মূলনীতি স্তম্ভের সাথে তালগোল পাকাইয়া ফেলিবেন না।”

তার ঐ দীর্ঘ প্রবন্ধে শিল্পকারখানা সর্ম্পকে জনাব আবুল মনসুর আহমদ লেখেন, “হৃদয়ের চার চেম্বারের অনুকরণে আমরা শুধু আমাদের জাতীয় জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে, পার্টি জীবনে ও সামাজিক জীবনে চার-বর্ণের প্রবর্তন করিয়াই ক্ষান্ত হই নাই। অর্থনৈতিক জীবনেও উহার সম্প্রসারন করিয়াছি। ‘মিনস অফ প্রডাকশন’ অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানাকে সংবিধানেই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছি। যথা: রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা। এই তিন শ্রেণীর মালিকানা ছাড়া আর সব সম্পত্তি যা প্রডাকটিভ নয়, সেগুলি অটোম্যেটিক্যালী ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকার ব্যবস্থা করিয়া গোটা সম্পত্তি জগতকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া হৃদয়ের চার চেম্বারের সামাঞ্জস্য বিধান করিয়াছি। যাতে মিল কারখানাদির ‘মিনস্‌ অফ প্রডাকশনকে’ হরতাল স্ট্রাইকারদের দ্বারা আনপ্রডাকটিভ করিয়া অন্য প্রকার মালিকানার সৃষ্টি করিতে কেউ না পারে এবং ঐ পন্থায় চার প্রকার মূলনীতিতে যাতে কেউ বত্যয় ঘটাইতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে আমরা হরতাল-স্ট্রাইককে ন্যাশনালাইজ করিয়া ফেলিয়াছি। সরকারি দল ছাড়া অপর সকলের হরতাল স্ট্রাইক নিষিদ্ধ করিয়াছি।”

প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক প্রশ্নে একই প্রবন্ধে জনাব আবুল মনসুর আহমদ বলেন, “হৃদয়ের চার চেম্বারের প্রতি আমাদের এই সামগ্রিক ও সার্বজনীন আকর্ষণ দেখিয়া বিদেশী বন্ধুরা বিস্মিত হইতে পারেন। কিন্তু তাদের সেই বিস্ময় সেই মুহুর্তেই কাটিয়া যাইবে যখন তারা জানতে পারিবেন যে, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতার নেতৃত্ব কেবলমাত্র আমাদের হৃদয়ের উপরই নির্ভরশীল। আমাদের নেতা প্রেমিক; তিনি দেশবাসীকে ভালোবাসেন; দেশবাসী তাকে ভালোবাসে। এ দেশে নেতা আর জনতার মধ্যে ভালোবাসা-বাসি ছাড়া আর কোন বৈষয়িক স্বার্থের সম্পর্ক নাই। পুরোটাই হৃদয়ের ব্যাপার। তাই হৃদয়ের চার চেম্বারের সাথে মিল রাখিয়াই আমাদের সামগ্রিক জীবনকে চার ভাগে বিভক্ত করিয়াছি। হৃদয়ের অনুকরণেই আমাদের রাষ্ট্রীয় আর্থিক জীবনকে উপরের তলা নীচের তলা এই দুই তলা বিশিষ্ট করিয়াছি। হৃদয়ের অনুকরণেই আমরা উভয় তলাতেই অর্থাৎ অবিকল ভেনট্রিকস উভয়টাতেই লেফট রাইট রাখিয়াছি। সাধারণত: নেতার ভালোবাসা-বাসির ব্যাপারই হৃদয়ের চার চেম্বারের প্রতি আমাদের আসক্ত করিয়াছে ঠিকই। কিন্তু চারের প্রতি আকৃষ্ট হইবার আমাদের আরও কারণ আছে। আমাদের রাষ্ট্র সেক্যিউলার হইলেও আমরা নিজেরা আজও ধর্মবিরোধী হই নাই। ধর্মনিরপেক্ষ হইয়াছি মাত্র। আমাদের মধ্যে বিপুল মেজরিটি লোকই মুসলমান। আমরা মুসলমানেরা এখনও ধর্ম ছাড়ি নাই। তাই চারের মায়াও ছাড়িতে পারি নাই। আমাদের চার কিতাব, চার কলেমা, চার ফেরেশতা, চার মাযহাব, চার খলিফা, চার ইমাম এ অবস্থায় রাষ্ট্রের চার মূলনীতি, সমাজের চার মালিকানা নীতি, পলিটিকস এ চার পার্টি নীতি। এসবে আমাদের আকর্ষণ সহজাত। শুধু মুসলমানরা হইবে কেন? আমাদের দেশের হিন্দুদের ধর্মেও চারের প্রাধান্য রহিয়াছে। তাদের চার বেদ, চার বর্ন, চার যুগ এমনই চার যোগও আছে। এইভাবে আমরা চারের গোলকধাধাঁয় ঢুকিয়াছি। সরকারি দফতরে চার তাসের কর্মচারী বহাল হওয়ায় বাজারে আমরা চার কায়দায় ব্যবসা চালু করিয়াছি। কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, মজুতদারী ও চোরাচালানী আমরা ছাড়তে পারি না এই চারের মায়াতেই।

হার্টের চার চেম্বারের সবচেয়ে বড় ত্রুটি দেখা দিয়াছে ‘জাতির পিতা’ ও তার সন্তানদের সর্ম্পকের মধ্যে। জাতির পিতা তার সন্তানদের ভালোবাসেন, সন্তানরাও পিতাকে ভালোবাসে। সবাই পিতাকে অন্তর দিয়া ভালোবাসে বলিয়াই তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরিণামে খুন-খারাবী। জাতির পিতা খুন-খারাবী বন্ধ করিতে সন্তানদের প্রথমে অনুরোধ পরে নির্দেশ অবশেষে ধমক দিয়েছেন। কিন্তু সন্তানেরা পিতার কথা শুনিতেছে না। পিতা ও কঠোর হইয়া সন্তানদের শাস্তি দিতে পারিতেছেন না। এটা ঘটিতেছে হৃদয়ের জন্যই। বিশেষত: হৃদয়ের চারটি চেম্বারের দোষেই। জাতির পিতা সকলের কল্যাণের জন্য যতই চেঞ্জ অফ হার্টের কথা বলিতেছেন সন্তানেরা ততই স্টেনগানের সাহায্যে এক্সচেঞ্জ অফ হার্ট করিতেছে। এটা অধিক দিন চলিতে দিলে সকলেরই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যাইবে।” এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হইবার পর জনাব মনসুরের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল থেকে নানারকমের কটুক্তি শুরু হয়।

(যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি---মেজর ডালিম)

বিষয়: বিবিধ

১৩৪৩ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

202409
০৪ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ০৯:৫৯
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : অনেক সুন্দর হয়েছে ... চালিয়ে যান। আরো বেশী বেশী লিখুন
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:২৫
152003
উড়ালপঙ্খী লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ,দোয়া করবেন Happy
202439
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:১০
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : অনেক ভালো লাগলো পড়ে Rose Rose Rose
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:২৬
152004
উড়ালপঙ্খী লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ,পাশে থাকবেন Happy
202456
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ১২:৩৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আবুল মনসুর আহমদ এর "আমার দেখা রাজনিতির পঞ্চাশ বছর","আত্মকথা" এবং "বাংলাদেশের কালচার" এই বইগুলি সকলের পড়া উচিত। এগুলি বাংলাদেশের শত বছরের ইতিহাসের প্রামান্য দলিল।
০৪ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:২৭
152005
উড়ালপঙ্খী লিখেছেন : ইতিহাস কথা বলে,এইসব জানা দরকার,ধন্যবাদ Happy
202482
০৪ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৩২
আবু সাইফ লিখেছেন : ইতিহাস পঠন ও তার নির্যাস আত্মস্থকরণে আমাদের বড্ড অনীহা-

আর আমাদের ইতিহাসও এখন ভাস্কর্যশিল্পীদের অনুশীলনাগার- At Wits' End Time Out

সত্য-সঠিক ইতিহাস খুঁজে-বুঝে নিতে পারার মত শিক্ষারও অভাব D'oh I Don't Want To See

পোস্টের জন্য ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ Praying
202511
০৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৮:৪৯
উড়ালপঙ্খী লিখেছেন : সহমত ভাই...ধন্যবাদ Happy
203306
০৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৪:৩৫
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : বইটা পড়া বর্তমান সময়ের দাবী।
আরেকটি কথা - এই মনীষির ছেলে বাহাদুরের ছেলের কথা কি জানেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় - আবুল মানসুর সাহেবরা লিখেছেন যে কলম দিয়ে সেই একই কলম ছেলে সন্তানদেরকে দিয়েছেন ভিন্ন নামে।
০৬ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২৯
152665
উড়ালপঙ্খী লিখেছেন : সহমত।
215412
৩০ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৩৫
উদাস পথিক লিখেছেন : সেদিন আবার ফিরে আসছে

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File