বুক রিভিউঃ লাল নীল দীপাবলি বা বাংলা সাহিত্যের জীবনী
লিখেছেন লিখেছেন চিলেকোঠার সেপাই ১৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:৩৫:৪৯ রাত
হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলির নাম অনেক শুনেছি। কেন যেন পড়া হয়ে উঠেনি। আজ সকালে পড়া শুরু করলাম। অনন্য সাধারণ!! মনে হল একটা চমৎকার সাজানো ফুলের বাগানে ঢুকেছি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মত একটা তাত্ত্বিক বিষয়, এত পরিপাটি করে, অদ্ভুদ সুষমা দিয়ে লিখেছেন। বইয়ের প্রতিটা অধ্যায় যেন এক একটা ফুল গাছ। লাইনগুলো ডাল। আর শব্দগুলো এক-একটা ফুল আর মন ভোলানো সবুজ পাতা। এক বেলাতেই পড়ে ফেললাম পুরো বইটা [কয়েক বছর পর এমন হল]
তবে খুবই আশাহতে হয়ে লক্ষ করলাম বাগানে একটি বড় গাছ নেই! অনুপস্থিত দুই-একটি সুগন্ধ ছড়ানো ফুল গাছ। আবার আকাশ ছোঁয়া ডালপালা ছড়ানো বট গাছ, এ বাগানে বনসাই হয়ে গেছ!!
হুমায়ুন আজাদ এখানেও তার সীমাবদ্ধতা, তার সংকীর্ণতা অতিক্রম করতে পারেন নি। এই বইয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগন তো বটেই, হারু ঠাকুর, ভবানী, কেস্টা মুচির মত সস্তা কবিয়ালদের কথাও বলেছেন। অথচ অবলীলায় এড়িয়ে গেছেন পর্বত সমান লালনকে। রবীন্দ্রনাথসহ লালন পরবর্তী প্রায় সব সাহিত্যিক লালনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এমনকি মার্কিন মুলুকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি অ্যালেন গিন্সবার্গও লালনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। সেই লালন কেন নেই? [আমার অনুমান] কারন লালন ছিলেন মুসলিম। লালনকে পাশে রেখে, [একটু পর পর অতি ভক্তি দেখিয়ে] রবীন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলাটা হয়তো কঠিন হয়ে যেত তাই।
আলাওলকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি বলতেও ড. আজাদের বেশ কষ্ট হয়েছে। তাই তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলেছেন।
তিনি অনুবাদ নিয়ে বলতে গিয়ে আরও একটি নির্জলা মিত্যা বলেছেন। ৬৩ পৃষ্ঠার মাঝামাঝিতে, “বাংলায় কোরান অনুবাদ করতে গিয়েও কম বাধা আসে নি”। কথাটা চরম অসত্য। প্রথম কুরআন বাংলায় অনুবাদ করেন গিরিশ চন্দ্র সেন ১৮৮১ সালে। তিনি ছিলেন একজন অমুসলিম। এরও আগে চতুর্দশ শতকের সিলেটে মুসলিমরা নাগরী নামে একটা নতুন লিপিরই প্রচলন করে স্বল্প শিক্ষিত মানুষের কাছে কুরআন সহজে প্রচারের জন্য।
৪৮ পৃষ্ঠার দিকে তিনি বৈষ্ণব সাহিত্য নিয়ে বলেছেন, “ এ-সময়ে বিশেষ কোন ধর্মীয় আবেগে রচিত হয় নি বৈষ্ণব পদাবলী”। এটাও একটা অসত্য বচন। বৈষ্ণব পদাবলীযে বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান বই। বৈষ্ণব ধর্ম জনপ্রিয় হয় বৈষ্ণব সাহিত্যর জন্য। বাংলা পিডিয়াতে বৈষ্ণব সাহিত্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “বৈষ্ণব সাহিত্য, বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে রচিত একটি কাব্যধারা”।
বইয়ের শেষের দিকে বিশ শতকের কবিদের নিয়ে বলার সময় ড. আজাদ সুগন্ধ ছড়ানো একটি অনিন্দ্য সুন্দর ফুল গাছ পা দিয়ে মাড়িয়ে গেছন। তিনি কুমুদুরঞ্জন মল্লিক, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর মত অখ্যাত কবিদের কথা বলেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ দও, জসীমউদদীন, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, অমিয় চক্রবর্তীদের কথাও বলেছেন। অথচ অবলীলায় এড়িয়ে গেছেন ফররুখ আহমদের মত শক্তিমান কবিকে। যিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ রুপক কবিতা রচয়িতা। নজরুলের পরে একমাত্র ফররুখই অতি পান্ডিত্যের সাথে কবিতায় প্রচুর আরবি, ফার্সি, উর্দু শব্দ ব্যবহার করেছেন। ফররুখ আহমদ মুসলিম রেনেসাঁর কবি। সম্ভবত এই কারনেই ড. আজাদ তার কথা বলেননি। আর তাই তার এই বইয়ে বাংলা রুপক কবিতা নিয়ে কোন আলোচনা নেই। লাল নীল দীপাবলিতে একটি মিষ্টি আলো ছড়ানো বাংলা রুপক কবিতা দীপটি নেই। বইটা থেকে গেছে অসম্পূর্ণ......।
বিষয়: বিবিধ
১১৮৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন