মায়ের মুখে বিজয়ের গল্প
লিখেছেন লিখেছেন চিলেকোঠার সেপাই ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৮:৪২:৩৫ রাত
১৯৭১ সালে আমাদের পরিবার থাকতো পাবনা জেলার বেড়া থানার যমুনা নদির চর, চর সারাশিয়াতে। গোষ্ঠিবদ্ধ বসবাস ছিল। অনেকটা ইসলাম পূর্ব আরবের গোত্র ব্যবস্থার মত। একজনের শুখে সবাই শুখি, দুঃখে সবাই দুঃখিত। ভালকাজে সবাই পুরস্কৃত, অপরাধে সবাই অপরাধি। বংশে বংশে মারামারি......
সব মিলিয়ে আমাদের বংশের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৫০ এর কাছাকাছি।
। দুই-চার জন ছড়া আমাদের বংশের সবার পেশা ছিল মালবাহি নৌকার ব্যবসা। যুদ্ধের সময় আমার বড় আপুর বয়স ২ বছর। আম্মু প্রেগন্যান্ট। এই জন্যেই আব্বু যুদ্ধে যেতে পারেন নাই। আমাদের বংশের অনেকেই যায়। আব্বুর বন্ধুদের মধ্যে প্রায় সবাই-ই যুদ্ধে যান। আম্মুকে আগে প্রায়ই প্রশ্ন করতাম, যুদ্ধের সময়টা কেমন
ছিল?
.... এপ্রিল মাস পর্যন্ত কোন সমস্যা ছিল না। মে মাসের শেষের দিকে আর্মি আসে। চারদিকে কেমন যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। বাজার ঘাট সব বন্ধ। চারদিকে কবরের মত নিরবতা। একটা অদৃশ্য আতঙ্ক তারিয়ে ফিরতো সব সময়। সবাইকে বাড়ি ঘর ছেরে ঝোপঝাড়ে থাকতে হত। এছাড়া মাটিতে গর্ত করে বাঙ্কারের মত বানানো হয়েছিলো বাড়ির পেছনে একটু দূরে। ভাত রান্না করতাম, কোন নিশ্চয়তা নেই এই খাবার খেতে পারবো কিনা....
এর উপর মরার উপর খারার ঘা হিসেবে রাজাকারদের উদ্ভব। এই রাজাকার-রা বিভিন্ন বাড়িতে আগুন দিতো। একদিন রাত্রে পাড়া থেকে আর্মি ১৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়। সবার বয়স ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে। তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। গ্রামে আতঙ্ক আরও জেঁকে বসে। বিশেষ করে আব্বাকে নিয়ে বাড়ির সবাই....। আমার চাচা এবং আব্বুর বন্ধুরা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে ৭ নম্বর সেক্টরেই যুদ্ধ করে। আব্বুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল পুরা বেড়া থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। আব্বু তাদের স্কাউটের কাজ করতো। শেষের দিকে পাক আর্মির অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। প্রায় দিনই সন্ধ্যাবেলা বিভিন্ন জায়গা থেকে ২৫-৩০ বছর বয়েসিদের ধরে এনে আমাদের গ্রাম থেকে একটু দূরে নদির ঘাটে লাইনে দাঁর করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মারতো....
এবং নভেম্বরের প্রথম দিকে একদিন আমার আব্বুকেও ধরে নিয়ে যায়।। আমাদের পরিবারের জন্য এই দিনটা ছিল সবচেয়ে কঠিন দিন। তবে ভাগ্য ছিল ভয়াবহ রকমের ভাল। আমাদের এলাকার শান্তি কমিটির প্রধান জনাব রাজা মিয়া (আল্লাহ তাকে শান্তিতে রাখুন) ছিলেন একজন অসাধারণ ভাল মানুষ। তিনি বহু মুক্তিযোদ্ধাকে নানা বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। শান্তি কমিটি পাকিস্তান আর্মির কাছে জোর।আবেদন জানাচ্ছিলো এই ব্রাশফায়ার হত্যা বন্ধে। আব্বুকে যেদিন ধরে ওই দিনটা ছিল সেই দিন যেদিন শান্তি কমিটি পাকিস্তান আর্মিকে বোঝাতে সমর্থ হয় ব্রাশফায়ার বন্ধ করতে। আব্বুসহ প্রায় ৩০ জনকে ধরেছিলো। সবাইকে ছেড়ে দেয়। এরপর ভারত চলে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করে সবাই। তার কিছুদিন পরেই শুরু হয় ভারতিয় বাহিনির আক্রমন। ভারতিয় বিমান বাহিনির প্লেনে পুরা আকাশ ছেয়ে যায়। পাকিস্তান বাহিনি কোনঠাসা হয়ে পরে....
এবং সেই আরাধ্য বিজয়। ১৬ তারিখ মনে হচ্ছিলো যেন একটা বিশাল পাথর চাপানো ছিল বুকে....অনেকদিন পর নিঃস্বাস নিলাম...
বিঃদ্রঃ - যেসব রাজাকারা অপকর্ম করেছিলো, তাদের কেউকে আমার চাচারা এবং আব্বুর বন্ধু আংকেলরা মাফ করেনি। বিজয়ের পরেই তাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন।
বিষয়: বিবিধ
১১১৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন