শেষ পর্বঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং মুসলিম উম্মাহ এর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।

লিখেছেন লিখেছেন চিলেকোঠার সেপাই ১৭ অক্টোবর, ২০১৪, ০৩:২২:৫৪ দুপুর

কিছু প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করছি।

প্রশ্ন গুলো মুসলিমদের কাছে। আপনাদের মনে কি কখনও প্রশ্ন এসেছে কিভাবে এক মুসলিম উম্মাহ ৫৫ টি দেশে পরিণত হল? হযরত আবু বকর রা. এর সময় যে খেলাফত এর সূচনা হয়, কিভাবে তার অবসান হল? কিভাবে এক জাজিরাতুল আরব ১০-১২ টি দেশ এ পরিণত হল। কিভাবে অপরাষ্ট্র ইজরাইল এর জন্ম হল?? কিভাবে মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দানকারী তুরস্ক একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে পরিণত হল?? এবং কিভাবে মধ্যপ্রাশ্চ্যে রাজ পরিবার গুলো জেঁকে বসলো???

আশা করি এই প্রশ্নগুলোর উওর অনেকটা পেয়ে যাবেন নিচের লেখা থেকে।

ওসমানীয় খেলাফাত(অটোমান) তথা মুসলিমদের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ছিল অত্যান্ত মরাত্নক। নভেম্বর ১৯১৪ সালে সুলতাম ৫ম মোহাম্মাদ মিএ শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তখন স্বাভাবিক ভাবেই মিএ শক্তিও তুরস্কের ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বেশ কয়েকটি ফ্রান্টে অটোমানদের সাথে মিএ শক্তির যুদ্ধ হয়।

মিএ বাহিনীর সাথে ওসমানীয় খেলাফাতের যুদ্ধের সাথে জড়িত ৩ টি অত্যান্ত গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। ষড়যন্ত্র এবং কয়েকটি ফ্রান্টে যুদ্ধ। ব্রিটিশ সরকার তুরুস্কের সাথে আরবদের ঝামেলা তৈরি করতে একজন চর নিয়োগ দেয়। তার নাম ছিল থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স (Thomas Edward Lawrence). এই থমাস এডওয়ার্ড লরেন্স পরে অত্যান্ত বিখ্যাত হয়ে যায়। Lawrence of Arabia নামে একটি বিখ্যাত হলিউড মুভিও রয়েছে। মুভিটি মূল ঘটনার একটি বিকৃত রোমানটি-সাইজ ভার্সন। টি ই লরেন্সকে ব্রিটিশ সরকার তখন প্রতি মাসে ২ লক্ষ পাউন্ড দিত তুর্কিদের তথা খেলাফাত এর সাথে আরবদের সমস্যা তৈরি করতে। এই কাজে টি ই লরেন্স আশাতীত সফল হয়। সে মক্কার গভর্নর শরীফ হোসাইন ইবনে আলী কে ওসমানীয়দের সাথে লড়তে ব্রিটিশ বাহীকে সহায়তা করতে রাজি করে ফেলে।

চুক্তি-১

মক্কার গভর্নর শরীফ হোসাইন ইবনে আলী ছিলেন রাসুল সা. এর সারাসরি বংশধর (৪০ তম)। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার শরীফ হোসাইন ইবনে আলী এর সাথে গোপন আলোচনা শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় তিনি যদি ব্রিটিশদের ওসমানীয় খেলাফাত এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহায়তা করেন এবং যুদ্ধে যদি ব্রিটিশ বাহিনী জয় লাভ করে তাহলে তাকে পুরো জাজিরাতুল আরব এর খলিফা বানানো হবে। শরীফ হোসাইন ইবনে আলী এতে রাজি হয়ে যায় এবং মুসলিম খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৯১৫ সালের অক্টোবর মাস এর ২৪ তারিখ এই গোপন ষড়যন্ত্রের চুক্তিটি সম্পাদিত হয় যা হোসাইন-ম্যাকমোহন চুক্তি নামে পরিচিত। এই হেনরি ম্যাকমোহন ছিলেন মিশরে ব্রিটিশ সরকার এর হাই কমিশনার।



(হোসাইন-ম্যাকমোহন এ্যাগরিমেন্ট)

চুক্তি-২

একই সময়ে ব্রিটিশ সরকার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আরও একটি খুবই গোপন একটি চুক্তি করে যা সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট নামে পরিচিত। এটি যুদ্ধে জিতলে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের কে কোন অংশটুকু পাবে তা নিয়ে চুক্তি। ১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে তারা এ আলোচনা শুরু করে। (একটু আগেই আমরা দেখলাম এর ঠিক এক মাস আগে ব্রিটেন শরীফ হোসাইন ইবনে আলীকে পুরো জাজিরাতুল আরব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।) ব্রিটেন এর পক্ষে বিখ্যাত কূটনৈতিক মার্ক সাইক (Mark Sykes) ফ্রান্স এর পক্ষে ফ্যান্সিস জর্জ পিকো (Francois Georges Picot) আলোচনায় অংশ নেয়। তারা বেশ কয়েকবার আলোচনায় বসে। ১৯১৬ সালের মে মাসে তারা একমত হয় এবং চুক্তিটি সম্পাদন করে। এখানে মজার বিষয় এই যে যারা আলোচনায় অংশ নিয়েছিল তারা কেউ মধ্যপ্রাচ্যে সশরীরে যায় নি। তারা লিটারেলি মানচিএ উপর ভাগাভাগি করেন। মানচিএেই স্বাক্ষর করেন। এই সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য এর ম্যাপ এর আকার ঠিক করে দেয়।



(মূল মানচিএ যার উপর ভাগাভাগি হয়। নিচে সাইক এবং পিকো এর স্বাক্ষর।)



ভাগাভাগির অংশ। সবুজ অংশ রাশিয়ার। লাল অংশ ব্রিটেন এবং নীল অংশ ফ্র্যান্স।

প্রশ্ন আসতেই পারে কিভাবে এমন অতি গোপনীয় চুক্তি এর খবর আমরা পেলাম। আমরা প্রথম পর্বে দেখেছি ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিকরা জারদের হটিয়ে রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে। এর পর তারা জারদের দুর্নীতি জনগণকে দেখানোর জন্য অনেক গোপন দলিল ফাঁস করে দেয়। সেই সব গোপন দলিল এর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।<একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় বর্তমান ISIL বলছে তারা সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট মানে না। এবং তাদের কাজ এর উল্টা>

চুক্তি-৩

এই চুক্তির কথা আমরা প্রথম পর্বে আলোচনা করেছি। একই সময়ে ব্রিটিশ সরকার World Zionist Organization এর সাথে আলোচনা শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার মোটামুটি চারটি প্রধান দিক বিবেচনা করে World Zionist Organization দাবি মেনে নিয়ে এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আবাসভুমির জন্য জায়গা দিতে রাজি হয়।

১। ইহুদিদের সমর্থন পেতে। ওই সময় পুরো ইউরোপে ইহুদিদের ভাল প্রভাব ছিল। মহাযুদ্ধে তাদের পক্ষে আনার জন্য।

২। সেম ওয়াইজম্যানের এ্যাসিটোন।

৩। কিছু উগ্র ডানপন্থী খ্রিস্টান দলকে খুশি করতে। আমরা অনেকই এই সত্য এর ব্যাপারে সচেতন নই। কিছু ডানপন্থী খ্রিস্টান দল আছে যারা উগ্রভাবে প্রো-জায়নিস্ট। এরা মনে করে পবিএ শহর ইহুদিদের অধীনে আসলে যিশু খ্রিস্ট এর পুনরায় আগমন হবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ(David Lloyd George) সয়ং ডানপন্থী খ্রিস্টান ছিলেন।

৪। আমেরিকার জায়নিস্টদের খুশি করে মহাযুদ্ধে আমেরিকাকে আনার জন্য।

এখানেই আমরা ব্রিটিশ সরকার এর হঠকারিতা, দ্বিমুখীতা, বিশ্বাসঘাতকতা দেখতে পাই। একই ভূমি নিয়ে তারা একই সময়ে তিনটি পক্ষের সাথে চুক্তি করে।

গ্যালিপ্ললি অভিযান

এপ্রিল ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ড, রাশিয়া, নিউ জিল্যান্ড, অস্টেলিয়া, ফ্রান্স সম্মিলিত ভাবে তুরুস্ক আক্রমন করে ইস্তাম্বুল দখল এর জন্য। এটি গ্যালিপ্ললি অভিযান নামে পরিচিত। ইস্তানবুল দখল করতে পারলে ব্লাক সি, দারদেনালস স্টেট এবং মর্মর সাগরের এর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এবং এই দারদেনালস স্টেট দখল করতে পারলে রাশিয়ার নেভিকে সরাসরি নিরন্ত্রন করা সম্ভব। তাই সর্ব শক্তি দিয়ে মিএ শক্তি তুরস্ক আক্রমন করে। আট মাস এই যুদ্ধ চলে। এই গ্যালিপ্ললি অভিযান মিএ শক্তির জন্য একটি বড় বিপর্যয় হয়। তারা ওসমানীয়দের কাছে পরাজিত হয়। তাদের ১ লক্ষ ১৫ হাজার সৈন্য নিহত হয়। বিজয়ী হলেও ওসমানীয়দেরও প্রায় একই পরিমাণ সৈন্য নিহত হয়।(এই অভিযান নিয়ে একটি বিখ্যাত হলিউড মুভি রয়েছে। এ ছাড়া কাজী নজরুল ইসলাম কামাল পাশা কবিতায় এ অভিযান নিয়ে লিখেছেন)। এবং এটিই ছিল প্রথম মহাযুদ্ধে মুসলমানদের একমাএ বিজয়।

এ যুদ্ধে ওসমানীয়দের পক্ষে নেতৃত্ব দেন যে জেনারেল তিনি অসম্ভব বিখ্যাত হয়ে যান। তার নাম মোস্তফা কামাল পাশা। যিনি পরে খলিফা আব্দুল মজিদকে হটিয়ে খেলাফত এর অবসান ঘটান এবং তুরস্কের ক্ষমতা দখল করে আতারতুক (জাতির পিতা) উপাধি গ্রহণ করেন। মোস্তফা কামালের উত্থান এর মাধ্যমে হযরত আবু বকর রা. থেকে শুরু হওয়া খেলাফাত এর অবসান ঘটে।

ক্ষমতা দখল করে মোস্তফা কামাল ইসলামের বিরুদ্ধে চরম রুদ্র মূর্তি ধারন করেন। শিক্ষা ব্যবস্হাকে রাতারাতি সম্পূর্ণ বদলে ফেলা হয়। সেক্যুলার স্কুল চালু করা হয়। ইসলামি শিক্ষা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ধর্মীয় অবকাঠামো গুলোও ধ্বংস করা হয়। শরি'আ কাউন্সিল বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ধর্মীয় বৃত্তি প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়। সূফীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। শরি'আ আদালত অবৈধ ঘোষণা করে দেশের সকল কাযীকে বরখাস্ত করা হয়।

তুর্কিদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকেও কামাল পাশা সেক্যুলার নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ এর চেষ্টা করেন :

° পাগড়ি বা টুপি পড়া নিষিদ্ধ করা হয়।

° সরকারী ভবনগুলোতে হিজাব নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

° হিজরি ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করা হয়।

° ১৯৩২ সালে আরবিতে আযান দেয়া নিষিদ্ধ করে তুর্কি ভাষায় আযান চালু করা হয় এবং দেশের হাজার হাজার মাসজিদে বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়।

° জুমাবারের পরিবর্তে শনিবার এবং রবিবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়।

সেই সময় তুর্কিদের শিক্ষার হার খুবই কম ছিল। শিক্ষার হার বাড়ানোর অজুহাত দেখিয়ে কামাল পাশা আরবি বর্ণমালার পরিবর্তে ল্যাটিন চালু করলেন। ল্যাটিন বর্ণ চালুর সাথে সাথে আরবি শব্দগুলোর তুর্কি প্রতিশব্দ খুঁজে বের করতে একটি কমিশন গঠন করেন।

এবং সর্বশেষ ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভবিষ্যৎ থ্রেট থেকে বাঁচাতে কামাল পাশা সাংবিধানিক ভাবে সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগে আমূল সংস্কার করেন। সেনাবাহিনীকে তুরুস্কের ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষক করা হয়। এবং সাংবিধানিক ভাবে সেনাবাহিনীকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয় যে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য তারা যা ইচ্ছা করতে পারবে। (পরে তুরুস্কের বেশ কয়েকজন প্রাধানমন্ত্রীকে সেনাবাহিনী ফাঁসি দেয় এই ক্ষমতা বলে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে জেল দেয় ইসলামি কবিতা পড়ার অপরাধে!)। ইসলাম তথা মুসলিমদের উপর কতটা মারাত্নক এর প্রভাব তা সহজেই অনুনেয়। উপমহাদেশে তখন বিখ্যাত খেলাফত আন্দোলন হয় কামাল পাশার এই কর্মকাণ্ডের জন্য।

বাগদাদের পতন

১৯১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইংল্যান্ড বাগদাদ অভিযান ঘোষণা করে। তারা মূলত বসরা দিয়ে হামলা চালায়। এই ফ্রান্ট এ তিন মাস যুদ্ধ চলে ওসমানীয় এবং ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে। ওসমানীয়দের নেতৃত্ব দেন খলিল পাশা আর ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন জেনারেল ফ্রেডেরিক স্ট্যানলি মাউডু । ১৯১৭ সালের ১১ মার্চ জেনারেল ফ্রেডেরিক স্ট্যানলি মাউডু (Frederick Stanley Maude) এর নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী এর হাতে বাগদাদ এর পতন ঘটে। ৯ হাজার এরও বেশি ওসমানীয় সৈন্য বন্দী হয় ব্রিটিশ বাহিনী এর হাতে।



(ব্রিটিশ বাহিনী বাগদাদে প্রবেশ করছে)

জেরুজালেমের পতন

১৯১৭ সালের ১৭ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বিখ্যাত জেনারেলদের একজন জেনারেল এ্যাডমণ্ড এ্যালেনবে (Edmund Allenby) এর নেতৃত্বে ব্রিটেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, অস্টেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড এর একটি সম্মিলিত বাহিনী পবিএ শহর আল কুদস বা জেরুজালেম এর উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করে। মিএ বাহিনীর অন্য কমান্ডার গন ছিলো অস্টেলিয়ার হ্যারি কাওভেল(Harry Chauvel), ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার হ্যারি বুলফিন (Edward Bulfin)। ওসমানীয়দের পক্ষে ছিল আলি ফুয়াদ পাশা, জাভেদ পাশা এবং জার্মানি এরিখ ভন ফলকেনউন( Erich von Falkenhayn) এবং ফ্রেদেরিখ ক্রেস ভন ক্রেসিস্তিন(Friedrich von Kressenstein). ১৩ দিন ব্যাপি যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী জয় লাভ করে।



(এ্যালেনবে ৩৪ তম বিজয়ী হিসেবে পায়ে হেঁটে জেরুজালেমে প্রবেশ করছে)

দামাস্কাসের পতন

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯১৮ ব্রিটেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, অস্টেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, মক্কার শরীফ এবং ফ্রান্স এর সম্মিলিত বাহিনী ফিলিস্তিনের(বর্তমান ইজরাইল) হাইফা থেকে দামেস্কাস এর উদ্দেশ্য অভিযান শুরু করে। ওসমানীয় এবং জার্মান বাহিনী তাদের এই বিশাল বাহিনীর সামনে দাড়াতেই পারে না। মাএ ৪ দিনেই দামাস্কাস এর পতন ঘটে। সম্মিলিত ব্রিটিশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেয় জেনারেল এ্যাডমণ্ড এ্যালেনবে (Edmund Allenby). তাকে বলা হত Bloody Bull. এছাড়া অস্টেলিয়ার হ্যারি কাওভেল(Harry Chauvel), ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার হ্যারি বুলফিন (Edward Bulfin) এবং শরীফ হোসাইন ইবনে আলীর পুএ ফয়সাল(মনে আছে নিশ্চয় এই ভদ্রলোক কিন্তু নবীজির বংশধর) মিএ বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়। ওসমানীয়দের পক্ষে ছিল মোস্তফা কামাল পাশা, জাভেদ পাশা এবং জার্মানি লিমন ভন স্যান্দারস (Liman von Sanders).



(দামাস্কাস এর পতন)

ইস্তাম্বুল পতন

১৯১৮ সালের ১৩ নভেম্বর মাসে ব্রিটেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, ইটালি, গ্রিস, আমেরিকার এর সম্মিলিত বাহিনীর হাতে ওসমানীয় খেলাফাত এর রাজধানী ইস্তাম্বুল এরও পতন ঘটে। সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ডার ছিল সমেরেস্ট আরথার গোক ক্যালটোপ(Somerest Arthur Gough Calthorpe) ওসমানীয় বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন আলী সাইদ পাশা।



(ইস্তানবুল এর পতন)

এভাবে মুসলিম খেলাফাতের বিভিন্ন সময়ের রাজধানী এবং গর্বের সবগুলো ঐতিহাসিক শহর এর একে একে পতন ঘটে। প্রত্যেকটি শহর ফিজিকালি মিএ বাহিনী দখল করে। এটা ছিল মুসলমানদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। মুসলমানরা রাজনৈতিক ভাবে এতটা দূর অবস্থার মধ্যে কখনও পরে নাই।(মঙ্গলদের আক্রমনকে অনেকে এর কাছাকাছি বড় বিপর্যয় বলেন)।

মধ্যপ্রাচ্য এর ভাগ

মহাযুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ সালের প্যারিস এ বিখ্যাত প্যারিস পিস কনফারেন্স শুরু হয়। এই পিস কনফারেন্স এ ব্রিটিশ সরকার ওসমানীয় খেলাফাত এর ভূমি ভাগ-ভাগি নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পরে। কারন এই সময় তারা তিন পক্ষের মুখোমুখি হয় শরীফ হোসাইন ইবনে আলীর পুএ ফয়সাল, World Zionist Organization এবং সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্টের অন্য পক্ষ যাদের সাথে ব্রিটিশ সরকার একই ভূমি নিয়ে চুক্তি করেছিল।



(ফয়সাল প্যারিস পিস কনফারেন্স এ)

প্রথমেই ব্রিটিশ সরকার সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট অফিশিয়ালি স্বীকৃতি দেয়। ফলে ফ্র্যান্স পায় সিরিয়া তার আশে পাশের এলাকা। ফ্র্যান্স পেয়েই যে অপকর্মটি করে তা হল সিরিয়াকে ভাগ করে ফেলে জাতীয়তা বা আদর্শ অনুসারে। লেবানন নামে আলাদা দেশ বানায় আরব খ্রিস্টানদের জন্য(যদিও এখন লেবানন এখন একটি বহুধর্মীয় দেশ।), দ্রুযিদের জন্য আলাদা অংশ নাম দিয়েছিল আল দ্রুযি স্টেট, আল অয়াতি উপজাতিদের জন্য আল অয়াতি স্টেট, সুন্নিদের জন্য স্টেট অব দামাস্কাস।



(ফ্র্যান্স এর অংশ এবং ভাগ)

ফ্র্যান্স প্রায় ৩০ বছর সিরিয়া এভাবে শাসন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিরিয়া বিপ্লব হয় এবং সিরিয়ানরা ফ্রেঞ্চদের বের করে দেয় তবে লেবাননকে আর ধরে রাখতে পারে না। লেবানন আলাদা রাষ্ট্রই থাকে। ফ্রেঞ্চরা শাসন এর সময় একটি আল অয়াতি উপজাতিদের গ্রুপকে (আমাদের ভাষায় রাজাকার) বেঁছে নেয় এবং নানান সুযোগ সুবিধাদেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের উপর ফ্রান্স এর পক্ষে পুলিশি করতে। এই আল অয়াতি উপজাতিরা ছিল সিরিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর, ডাকাত, অশিক্ষিত এবং অনেকটা বর্বর সম্প্রদায়। ইতিহাসে আল অয়াতি উপজাতিদেরকে একটি ডাকাত সম্প্রদায় হিসেবেই দেখা যায় তারা পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় বাস করতো এবং সুন্নিদের গ্রাম এবং শহরগুলোতে ডাকাতি করতো। সুন্নিরা এই আল অয়াতিদের ভয় পেত। ফ্রেঞ্চরা এসে এই আল অয়াতিদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে এবং প্রচুর সামরিক সহায়তা করে। ফলাফল ৩০ বছর পর যখন ফ্রান্স সিরিয়া ছেড়ে চলে যায় এক আল অয়াতি জেনারেল হাফিজ আল আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। তারই ছেলে বাশার আল আসাদ এখন সিরিয়া এর ক্ষমতায়।

সাইক-পিকো এ্যাগরিমেন্ট অনুযায়ি ইংল্যান্ড ইরাক, ট্রান্স জর্ডান (বর্তমান ম্যাপে জর্ডান, ফিলিস্তিন, ইজরাইল) এবং হিজায পায়। ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ি World Zionist Organization কে ফিলিস্তিন এর একটা অংশ দিয়ে দেয়।

হোসাইন-ম্যাকমোহন এ্যাগরিমেন্ট এর সুরাহা করতে তারা একটি অভিনব কৌশল গ্রহণ করে। শরীফ হোসাইন ইবনে আলীর ছিল তিন পুএ। তারা বড় ছেলে আলী বিন শরীফ হোসাইনকে হিজাযের গভর্নর বানানো হয়। আলী ক্ষমতায় গিয়েই নিজেকে হিজায এর রাজা এবং মুসলিমদের খলিফা ঘোষণা করে। আলী ১৯২৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ মাএ ৩ মাস হিজায শাসন করে। সে আল সৌদ কাছে ক্ষমতা হারায়। এই আল সৌদকেও অর্থ এবং অস্ত্র ব্রিটেনই দেয়। আল সৌদ হিজায দখল করে নিজেকে রাজা ঘোষণা করে এবং বংশের নামে দেশের নাম দেয় “সৌদি আরব”। এর মাধ্যমে শরীফ হোসাইন ইবনে আলী এবং তার পরিবার মক্কা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায়। তারা একাকী অত্যান্ত নির্মম ভাবে মারা যায় এবং ওসমানীয় খেলাফাত এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার পায়।

শরীফ হোসাইন ইবনে আলীর মেঝ পুএ এর নাম আব্দুল্লাহ বিন শরীফ হোসাইন। তাকে দেওয়া হয় জর্ডান। আব্দুল্লাহ ক্ষমতায় পেয়ে বড় ভাই এর পথ অনুসরণ করে এবং নিজেকে হাশেমি (নবীজির বংশ) জর্ডান এর রাজা ঘোষণা করে। এবং এই আব্দুল্লাহ শরীফ হোসাইন ইবনে আলীর একমাএ ছেলে যে ক্ষমতায় টিকে ছিল শেষ পর্যন্ত। তার পর তার নাতি হোসাইন ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৯৯ জর্ডান এর ক্ষমতায় ছিল। হোসাইন এর মৃত্যুর পর তার ছেলে আব্দুল্লাহ জর্ডান এর ক্ষমতায় বসেন। এবং তিনি এখনও জর্ডান শাসন করছেন।

শরীফ হোসাইন ইবনে আলীর ছোট পুএ এর নাম ছিল ফয়সাল । তার সাথে টি ই লরেন্সের সবচেয়ে ভাল সম্পর্ক ছিল। ফয়সালকে ইরাকের গভর্নর বানানো হয়। ক্ষমতা পেয়ে ফয়সালও তার ভাইদের মত নিজেকে ইরাকের রাজা ঘোষণা করে। তবে ইরাকের মানুষকে তাকে প্রত্যাখান করে। তখন ব্রিটিশ সরকার ফয়সাল এর পুএ গাজাকে গভর্নর বানায়। ইরাকের মানুষকে তাকেও প্রত্যাখান করে। এর পর ব্রিটিশ সরকার গাজা এর পুএ ফয়সাল ২য়কে গভর্নর বানায়। ১৯৫৮ সালের ১৪ জুলাই ইরাকি আর্মি বিদ্রোহ করে। তারা শরীফ পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে একটি রুমে একএিত করে গুলি করে হত্যা করে। সে সময় একজন তরুণ আর্মি অফিসার বেশ বিখ্যাত হয় (যদিও তিনি শরীফ পরিবারের হত্যাকাণ্ডের সময় ছিলেন না)। এই তরুণ অফিসার ১৯৬৮ সালে ইরাকের ক্ষমতা দখল করে। তার নাম সাদ্দাম হোসেন।

এভাবেই এক মুসলিম উম্মাহ খণ্ড বিখন্ড হয়ে যায়। তৈরি হয় গভীর ক্ষত। যার দাগ আমরা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। আরও কতদিন বয়ে বেড়াতে তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন।

বিষয়: বিবিধ

২৫১১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

275269
১৭ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:২৫
ইসলামী দুনিয়া লিখেছেন : ইনশাআল্লাহ আবারো খেলাফত আসছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
275329
১৭ অক্টোবর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:১৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
কয়েকটি তথগত ভুল রয়েছে। গ্যালিপলি বিজয় এর জন্য কামাল পাশার চেয়ে তুর্কি নেীবাহিনির কৃতিত্ব বেশি। কামাল পাশার কৃতিত্ব শুধু আনজাক এর যুদ্ধে। মধ্যপ্রাচ্য আক্রমনকারি বৃটিশ বাহিনি প্রথমে কুত-আল আমারা তে পরাজিত হয়ে জেনারেল টাউনসেন্ড এর নেতৃত্বে আত্মসমর্পন করেছিল। এখানে তুর্কি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। মধ্য প্রাচ্যের পুরো বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষ যোদ্ধার চেয়ে কূটকেীশল অবলম্বন করে সাফল্য পেয়েছে।
১৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১১:২৫
219345
চিলেকোঠার সেপাই লিখেছেন : গ্যালিপলি বিজয় এর পুরো অভিযান এ সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্বে দেন কামাল পাশা
১৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১১:৫০
219356
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : একেবারেই নয়। কামাল পাশা তুরুস্কের নেতা হওয়ার পর নিজের কৃতিত্ব বৃদ্ধি করতে এই প্রচারনা চালান। গ্যালিপলিতে তুর্কি বাহিনির উপদেষ্টা হিসেবে পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রন করতেন জার্মান জেনারেল অটো লিমান ভন স্যান্ডার্স। তুর্কি বাহিনির অধিনায়ক ছিলেন ৩য় কোরের মেহমেট ইসাত পাশা(মুহাম্মদ আসাদ পাশা),কামাল পাশা ১৯ ডিভিশন এর অধিনায়ক হিসেবে আনযাক খাঁড়ি প্রতিরক্ষায় নিয়জিত ছিলেন এবং এই যুদ্ধের কৃতিত্ব তার। এছারা দার্দানেলিস এর বিখ্যাত "সেদ্দিল বাহির" সহ দুর্গ ভিত্তিক অবস্থান এর নেতৃত্বে ছিলেন সাবিত কুবায়লি। তিনিও র্যাংক এর দিক দিয়ে কামাল পাশার উচ্ছে ছিলেন।
১৭ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১১:৫৯
219357
চিলেকোঠার সেপাই লিখেছেন : রেফারেন্স The shaping of Muslim Ummah by Yasir Qadi
১৮ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১২:০৪
219358
চিলেকোঠার সেপাই লিখেছেন : হুম অটোমান এবং জার্মান মিলিয়ে মোট ৫ জন কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু বিখ্যাত হয় কামাল পাশা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File