প্রথম বিশ্বযুদ্ধঃ প্রথম পর্ব ১৯১৪ পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর
লিখেছেন লিখেছেন চিলেকোঠার সেপাই ১৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:৪১:২২ রাত
সকাল, দুপুর, বিকেল গড়িয়ে ২০১৪ সাল এখন সন্ধ্যার দিকে ছুটছে। আইএসআইএল এর নাটকীয় উত্থান এবং গাজায় যায়নবাদি ইজরাইলের বর্বর হামলা ছাড়া ২০১৪ সালে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা নেই যা ইতিহাসে স্থান করে নেবে। আমাদের ঠিক ১০০ বছর পেছনে ১৯১৪। এই ১৯১৪ ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী বছর। সবচেয়ে প্রভাবশালী বছর এর সংক্ষিপ্ততম তালিকাতেও ১৯১৪ সাল প্রথম দিকেই থাকবে। ১৯১৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইংল্যান্ড পৃথিবীর ৪ ভাগের ১ ভাগ শাসন করতো। তারা গর্ব করে বলতো এমন সাম্রাজ্য যার সূর্য কখনও অস্ত যায় না। ১৯১৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপ ছিল পৃথিবীর একমাএ সুপার পাওয়ার। আমেরিকা বা চীন সুপার পাওয়ার ছিল না। আমেরিকা তখন বর্তমান ভারত এর মত মাঝারি শক্তির দেশ ছিল। মুসলিম উম্মাহ এর মধ্যে নানা সমস্যা থাকার পরও যদিও মুসলিম খেলাফাত আগের মতশক্তিশালী ছিল না, বসনিয়া, আলবেনিয়া,ইন্ডিয়া তখন খেলাফাত এর বাইরে ছিল। তারপরও একটি গ্লোবাল উম্মাহ ছিল ধারনা ছিল তখনও। আমাদের বাংলাদেশের মানুষও তখন ওসমানীয় খেলাফাত এর প্রতি অনুগত ছিল। ১৯১৪ সালে অনেক গুলো ঘটনার সূত্রপাত ঘটে যার প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ১৯১৪ সালের পৃথিবীতে ৬টি প্রভাবশালী প্রথম সাম্রাজ্য ছিল। ১- ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ২- অস্ট্র-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য। ৩- জার্মান সাম্রাজ্য। ৪- ফ্রেঞ্চ সাম্রাজ্য। ৫- রাশিয়ান সাম্রাজ্য। এবং ৬- ওসমানীয় খেলাফাত।
এখন প্রশ্ন কেন ১৯১৪ এত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং এই মহা যুদ্ধের জন্যই ১৯১৪ এর গুরুত্ব। আমাদের অনেকে মনে করেন হতাহত এবং ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়ার জন্য ২য় মহাযুদ্ধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা সম্পূর্ণ ভুল। গুরুত্ব এবং প্রভাবের দিক দিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধ এর অব্যস্থান ২য় মহাযুদ্ধ এর চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে।
১৯১৪ সালের ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্র-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ড এবং তার ওয়াইফ সফিয়া এক সার্বিয়াবাসীর গুলিতে নিহত হন। অস্ট্র-হাঙ্গেরিয়া এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে। সার্বিয়া ছিল রাশিয়ান সাম্রাজ্য এর অধীনে। একই বছরের ২৮ জুন অস্ট্র-হাঙ্গেরিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মানী ছিল অস্ট্র-হাঙ্গেরিয়ার বন্ধু। তারা অস্ট্র-হাঙ্গেরিয়ার পক্ষে যোগ দেয়। এবং এই যুদ্ধের ছুতোয় তারা কয়েকটি দেশ দখল করে নেয়। জার্মান ফোবিয়া পেয়ে বসে অন্য সুপার পাওয়ার গুলোর মধ্যে। তখন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স রাশিয়ার পক্ষে যোগ দেয়। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সূচনা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে তখন বলা হত Great War or Global War। এ যুদ্ধকে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলা হত না। কারন ২য় বিশ্বযুদ্ধ ছিল না। ২য় বিশ্বযুদ্ধ এর পরএর নাম দেওয়া হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম দিকে ওসমানীয় খলিফা ৫ম মোহাম্মাদ মহাযুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকেন। এবং কোনদিকে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তুরস্ক এবং জার্মানি এর সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভাবে ভাল ছিল। ইস্তাম্বুল থেকে সরাসরি মিউনিখ এ একটি ট্রেন ছিল নাম “ওরিয়েন্টালএক্সপ্রেস”। ওরিয়েন্টালিজম এর সূচনা হয় তুরস্ক এবং জার্মানি এর সম্পর্ক থেকেই। সেই সময়ে ইয়াং টার্ক নামে তুরুস্কে একটি শক্তিশালী গ্রুপ ছিলো। তারাই মূলত খেলাফাত নিয়ন্ত্রন করতো। এই ইয়াং টার্ক গ্রুপ খলিফাকে জার্মানি এর পক্ষে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। এছাড়া সে খলিফার গ্রান্ড ভিজিয়ার সাইদ পাশা এবং যুদ্ধমন্ত্রী এনভার পাশা খলিফাকে না জানিয়ে জার্মানির সাথে একটি গোপন চুক্তি করে (১৯১৪ সালের-ই অগাস্ট মাসে) যা অটোমান-জার্মান এলায়্যান্স নামে পরিচিত। সবদিকে থেকে চাপে পড়ে খলিফার এর প্রতি সমর্থন নাজানিয়ে কোন উপায় ছিল না। তুরস্ক জার্মানি এর পক্ষে মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে খলিফা ৫ম মোহাম্মাদ ইসলামের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ বারের মত সকল মুসলিমকে “জিহাদে” যাবার ঘোষণা দেন। <যারা জানেন না তাদের জন্য ইসলামিআইন অনুযায়ি একমাএ খলিফাই সসস্ত্র জিহাদের ঘোষণা দিতে পারেন।>
তখন পর্যন্ত এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ও বড় যুদ্ধ। প্রায় ৭০ মিলিয়ন সৈন্য এ যুদ্ধে অংশ নেয়। এটি একটি অকল্পনীয় সংখ্যা ছিল। সেই সময়ের পৃথিবীর কাছে এটি ছিল অসম্ভব সংখ্যা। যুদ্ধাস্ত্রের সংকট দেখা দেয়। এই যুদ্ধে প্রথম অত্যাধুনিক মরনস্ত্র ব্যাবহার করা হয়। প্রথম বিমান হামলার সূচনা হয় এই মহাযুদ্ধে। ১৬ মিলিয়ন মানুষ এই যুদ্ধে মারা যায়। ক্ষয়-ক্ষতি যা হয় তা সে সময়ের মানুষের কাছে আচিন্তনীয়। ১৯১৮সালের ১১ নভেম্বর শেষ হয় এই মহাযুদ্ধ।
৬টি প্রভাবশালী সাম্রাজ্যের প্রতিটি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। ওসমানীয়, রাশিয়ান, জার্মান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে খণ্ড বিখন্ড হয়ে যায়। অস্ট্র-হাঙ্গেরি ভেঙ্গে ১০-১২টি দেশ হয়।জার্মান সাম্রাজ্য তার মূল আয়তনের তিন ভাগের এক ভাগেরও ছোট হয়ে যায়। তার কলোনি গুলো স্বাধীন হয়ে যায়। ওসমানীয় খেলাফাত ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এক জাজিরাতুল আরব ১৫-২০টি দেশে পরিণত হয়। ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যতাদের প্রাচুর্য হারিয়ে ফেলে এবং ভাঙন শুরু হয়।
এ মহাযুদ্ধের অস্টিয়া, হাঙ্গেরি, জার্মানি, ফ্রান্স, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশের বেশ কিছু শহর এবং গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে যায়। ইতিহাসে প্রথম বারের মত মেয়েরা বাধ্য হয়ে কর্মক্ষেএে আসে। এবং বর্তমান পৃথিবীর খুবই আলোচিত, সমালোচিত, প্রশংসিত ফ্যামিনিজম এর সূচনা এখান থেকেই হয়।
রাশিয়ার জার সম্রাট এর দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে বলশেভিকরা ২৫ অক্টোবর ১৯১৭ তারিখে একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দ্বারা মাধ্যমে জারদের হটিয়ে দিয়ে সেন্টপিটার্সবার্গ দখল করে নেয়। এই বিপ্লবকে অক্টোবর এর বিপ্লব বলা হয়। এবং বিশ্বের প্রথম প্রভাবশালী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ান এর জন্ম হয়। এই সোভিয়েত ইউনিয়ান এবং কমিউনিজম পরবর্তীতে দুনিয়ায় কেমন প্রভাব রেখেছে সেটা সবার জানা।
মহাযুদ্ধে ইংলান্ডে যখন অস্ত্রের চরম সংকট দেখা দেয়। কারন সমরঅস্ত্রের কারখানা ছিল জার্মানিতে। তখন জায়নিস্ট নেতা মাল্টি বিলিয়োনিয়ন ও রসায়ন বিজ্ঞানী সেম ওয়াইজম্যান ব্রিটিশ সরকারকে একটি নতুন এবং শক্তিশালী এ্যাসিটোন করে দেয় এবং বিনা মুল্যে যত দরকার তা উৎপাদন করে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয় (তার ইউরোপের অন্যতম বড় এ্যাসিটোন তৈরির কারখানা ছিল। এই এ্যাসিটোন বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার হয়)। এছাড়া World Zionist Organization ব্রিটিশ সরকারকে এইপ্রতিশ্রুতি দেয় সমগ্র ইউরোপের ইহুদি এবং মহাযুদ্ধে ইংল্যান্ড এর পক্ষে থাকবে। এবং আমেরিকা যেন মহাযুদ্ধে ইংল্যান্ডের পক্ষে যোগ দেয়ার জন্য তারা তাদের শক্তিশালী লবি ব্যবহার করবে (তখন অবশ্য বর্তমান এর মত এতটা শক্তিশালী জায়নিস্ট লবি ছিল না আমেরিকায়)। তার বিনিময়ে ফিলিস্তনে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমিদাবি করে। ব্রিটিশ সরকার World Zionist Organization এর এ দাবি মেনে নেয়। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে বেলফোর ঘোষণা এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি জানায়। জন্ম নেয় বর্তমান বিশ্বের ক্যান্সার,বিশ্বশান্তির সবচেয়ে বড় বাঁধা সন্ত্রাসবাদী রাস্ট্র ইজরাইল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়। তার কলোনি গুলোতে স্বাধীনতার দাবি প্রবল হয়ে ওঠে।
৬টি প্রভাবশালী প্রথম সাম্রাজ্যতের পতন এর কারনে। বিশ্বেনেতৃত্ব এর সংকট উঁকি দেয়। আমেরিকা সুপার পাওয়ার হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধেরপর ইউরোপ সম্পূর্ণ ধসে যায়। বিশ্বে নেতৃত্ব ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয়। আমেরিকা এই স্থানদখল করে এবং সুপার পওয়ার এ পরিণত হয়।
যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে প্যারিসে মহাযুদ্ধ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হয়। যা “প্যারিস পিস কনফারেন্স” নামে পরিচিত। এ সম্মেলন থেকেই ২৮ জুন “লীগ অব নেসন্স” এর জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই “লীগ অব নেসন্স” কে একটু সংশোধনকরে “জাতিসংঘ” নাম দেওয়া হয়।
প্যারিস পিস কনফারেন্স এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভারসাই চুক্তি। ভারসাইচুক্তিতে মহাযুদ্ধ এবং এর যাবতীয় ক্ষয়-ক্ষতির জন্য জার্মানিকে দায়ী করা হয়। জার্মানিকে বলা প্রতিটি দেশের যত ক্ষতি হয়েছে তা জার্মানিকে তার ক্ষতি পুরন দিতে হবে।জার্মানির উপর ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স পড়ে যায়। পরাজিত জার্মানি ছিলঅ্যান্ডারডগ অব্যস্থায় তাই তাদের এই চরম অপমানজকন মেনে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। এতে জার্মানদের অহমিকায় চরম আঘাত লাগে। তারা কোন ক্যারিশমাটিক নেতার সন্ধান করতে থাকে। উত্থান হয় এ্যাডলফ হিটলার এর। হিটলার জার্মানিকে অপমানের প্রতিশোধ নিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে। অর্থাৎ WW II is Ultimate Consequence of WW I.
ওসমানীয় খেলাফাত এবং মুসলিমদের উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরপ্রভাব খুবই বেশি। দ্বিতীয় পর্বে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো। ।
বিষয়: বিবিধ
২১৯৯ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এটি ঠিক না, বিষয়টি ঠিক other way round. ইসরাইল রাষ্ট্র আছে বলেই মধ্যপ্রাচ্যের ক্যানসার আক্রান্ত মুসলিমরা কিছুটা হলেও সভ্যতার আলো দেখতে পাচ্ছে। অচিরেই আইসিস, বোকোহারামের মোহ কেটে যাবে।মধ্যপ্রাচ্য ইসলাম ধর্মের কালো অথ্যায় মুক্ত হবে।
তো, ইসলামের জলবায়ুতে কি মাদমতা মিশে আছে যেখানে সিআইএ মোসাদের যাদুর ছোঁয়ার শুধু আইসিস, বোকোহারাম উর্বর হয়??
আপনাকে ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন