#পহেলা বৈশাখ ও বাঙালীর #হাজার বছরের #ঐতিহ্য #তত্ত্ব্
লিখেছেন লিখেছেন চিলেকোঠার সেপাই ১২ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:৫২:৫৩ রাত
পহেলা বৈশাখ ও বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য
কথাটি কতটা ঠিক??????
পহেলা বৈশাখ কি আদোও বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ?
ব্যাপারটি জানতে আমাদের আগে জানতে হবে সংস্কৃতি কি ? এবং আমাদের ইতিহাস একটু পেছন ফিরে দেখতে হবে। আসুন একটু সংক্ষেপে আমরা পুরো বিষয়টি দেখার চেষ্টা করি।
সংস্কৃতি
সংস্কৃতি কি এটা নিয়ে অনেক আলোচনা সম্ভব। তবে সাধারন ভাবে যা নিয়ে আমাদের জীবন, পরিবার ও সমাজ তথা আমাদের সামগ্রিক জীবন গঠিত তাই সংস্কৃতি। David Crystal বলেন,
‘Culture is the way of life of a group of people consisting of learned pattrens of behavior and thought passed on from one generation to next’ (Encyclopedia : David Crystal)
সংস্কৃতি হতে পারে দুই ধরনের
১ স্হানিক।
২ ধর্মীয়।
প্রাচীন বাংলা
হাজার বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষ গন কেমন ছিলেন। তাদের জীবন কেমন ছিল? তারা কিভাবে জীবন যাপন করতেন? ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ৮ম শতক থেকে চিহ্নত করা যায়।এর পূর্বের ইতিহাস আছে কিন্তু সুস্পষ্ট নয়’।১ তবে এ ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত প্রাচীন বাংলার মানুষেরা ছিলেন মূলত দ্রাবিড়। তবে দ্রাবিড়রা কেমন ছিলেন এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। আলেকজেন্ডারের সমসাময়িক গ্রীক বিবরণীতে গঙ্গারিড়ি বা বংঙ্গ-দ্রাবিড়ি নামে এক শক্তিশালী রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।গঙ্গা-বিধৌত এ রাজ্যের বংঙ্গ-দ্রাবিড় জাতি ছিল অপরাজেয় শক্তি।টলেমী বলেন, গঙ্গা মোহনার সব অঞ্চলেই গঙ্গারিড়িরা বাস করে।তাদের রাজধানী গঙ্গা খ্যাতিসম্পন্ন বন্দর। তাদের মসলিন ও প্রবাল রত্ন পশ্চিম দেশে রপ্তানি হয়।তাদের মতো পরাক্রান্ত জাতি ভারতে আর নেই।
মোঃ আব্দুল মান্নান বলেন,
‘প্রাচীন বাংলা ও তার সংলগ্ন এলাকায় বাস করতো একটি সভ্যতা-সম্পন্ন জাতি বাস করত। তারা ছিল দ্রাবিড় জাতির একটি শাখা। এ উপমাহাদেশে দ্রাবিড় দের আগমন ঘটেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে।তারা এসেছে সেমেটিকদের আদি ভূমি মধ্য এশিয়া থেকে। ব্যাবলিন বা মেসোপটামিয়া দ্রাবিড়দের উৎপওিস্হল। এই সেমেটিকরাই পৃথিবিতে প্রথম সভ্যতার আলো ছড়িয়েছে।তারাই ইয়েমেন ও ব্যাবিলনকে সভ্যতার আদি বিকাশভূমিরুপে নির্মাণ করেছে।পৃথিবিতে প্রথম লিপির প্রচলন দ্রাবিড় জাতিরই অবদান।সুপ্রাচীন এক গর্বিত সভ্যতার পতাকাবাহী এই দ্রাবিড় জাতির লোকরা ভারতবর্ষে আর্য আগমনের হাজার হাজার বছর আগে মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পা সভ্যতা নির্মাণ করেছিল।অনুরুপ সভ্যতা হয়তো তারা বাংলাদেশেও করেছিল।কিন্তু প্রাকৃতিক কারনে সেগুলোর চিহ্ন এখন নেই’।( আমাদের জাতি সওয়ার বিকাশধারা-২৩)।
আবুল মনসুর আহমদ বলেন,
‘তারা মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার মতো সুন্দর নগরী প্রাক-বাংলায় নিশ্চয়ই নির্মাণ করেছিলেন।অবশ্য স্হানীয় নির্মাণ উপকরণের পার্থক্যহেতু স্হপতিও নিশ্চয় পার্থক্য ছিল। কিন্তু আজ সে সবের কোন চিহ্ন নাই। প্রাকৃতিক কারনে প্রাক-বাংলায় চিরস্হায়ী প্রাসাদ নির্মাণের উপযোগী মাল-মশলা যেমন দুস্প্রাপ্য, নির্মিত দালান কোঠার ইমারত রক্ষা করাও তেমনি কঠিন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এরা নিশ্চিত শিকার।ময়নামতি, মাহাস্তানগড়ের ভগ্নাবশেষ দেখিয়া প্রাক-বাংলার সভ্যতার প্রাচীনণত্ব ও স্হপতির চমৎকারিত্ব আন্দাজ করা যায় মাএ, বিচার করা যায় না’। (আমাদের কৃস্টিক পটভূমি, পূর্বদেশ, ঈদ সংখ্যা-১৯৬৯)
তবে একটি ব্যাপার লক্ষণীয় টলেমী সহ অনেকে দ্রাবিড়দের প্রশংসা করলেও হিন্দু আর্য পন্ডিতগন দ্রাবিড়দের অসভ্য বলে অভিহিত করেছেন। যেমন অজয় রায়,
‘আর্য আগমন পূর্বে এ অঞ্চলে যারা বাস করতো তাদের বলা হত অনার্য। এরা ছিল মুলত অর্ধ বর্বর জাতি’২
প্রাচীন বাংলার ধর্ম
দ্রাবিড়দের ধর্ম কি ছিল এটা নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।তাদের একটি নিজিস্ব ধর্মমত ছিল এবং তা ছিল সম্ভবত একেশ্বরবাদী। আর্যদের সাথে বিরোধ ও পরে জৈন, বুদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের জনপ্রিয়তা বিশ্লেষণ করে আব্দুল মান্নান তালিব বলেন,
‘সেমেটিক ধর্মের উওর পুরুষ হিসেবে এ এলাকার মানুষের তাওহীদবাদ ও আসমানি কিতাব সম্পকে ধারনা থাকাই স্বাভাবিক এবং সম্ভবত তাদের একটি অংশ আর্য আগমনকালে তাওহীদবাদ এর সাথে জড়িত ছিল।এ কারনেই শিরক বাদী ও পৌওলিক আর্যদের সাথে তাদের বিরোধ চলতে থাকে’। (বাংলাদেশে ইসলাম,৩৪)।
আর্যদের সাথে সংগ্রাম
আর্য আগমন বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনার একটি। তারা ছিল যাযাবর জাতি। ঘোড়াকে তারাই প্রথম পোষ মানায়। তারা ছিল খুবই মেধবি কিন্তু যুদ্ধবাজ ও নিষ্ঠুর। তারা দ্রাবিড় প্রাধান পাঞ্জাব, সিন্ধু ও উওর ভারত খুব সহজেই দখল করে নেয়।সামরিক বিজয়ের সাথে তারা তাদের বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতি এ এলাকার মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়। তাদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে এই সব এলাকার দ্রাবিড়রা দক্ষিন ভারত, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।প্রায় সমগ্র উওর ভারত তাদের করতলে চলে যায়। কিন্তু তখন বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ আর্যদের বিরুদ্ধে রুখে দারায়।এর ফলে করতোয়া নদীর তীরে এসে আর্যদের জয় রথ থেমে যায়।
সংগ্রামী পূর্ব পুরুষদের এ লড়াই এর ব্যাপারে অধ্যাপক মন্হথমহোন বসু বলেন,
‘প্রায় সমস্থ উওর ভারত যখন বিজয়ী আর্য জাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াছিল, বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উওোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, আর্যদের হমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভগলপুরের সাদানিরার (করতোয়া নদীর) পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া থামিয়া যায়।অর্থাৎ সাদানিরার অপর পারে অব্যস্তিত বঙ্গদেশে তাহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই। (বাংলা নাটকের উৎপওি ও ক্রমবিকাশ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৯, ২১)।
চলতে থাকে এই লড়াই। সস্মুখ সমরে না পেরে আর্যরা ভিন্ন পথ ধরে।তারা ধর্ম প্রাচার করতে ব্রাহ্মণদের পাঠায়। এবং সংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে একটি অব্যস্থান করার চেষ্টা করে। ‘চার স্তরে বিভক্ত আর্য সমাজের ক্ষএিয়, বৈশ্য বা শুদ্র প্রথমে বাংলায় আসেনি। এদেশে প্রথম এসেছে ব্রাহ্মণরা বেদান্ত প্রচারের নামে’।৩ লড়াই শুরু হয় দুই দিক দিয়ে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ লড়াই চলে। আর্যদের সাহিত্য মাহাভারত, উপনিষদে ধর্ম রাজ্য নিয়ে দেবতা ও অসুরদের যে যুদ্ধের কাহিনী আছে তা মূলত আমাদের মহান পূর্ব পুরুষ ও আর্যদের যুদ্ধের কাহিনী। এটাই সম্ভবত সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যাচার এর একটি।এ কাহিনীতে বেমালুম ভিলেনকে হিরো আর হিরোকে ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। (হায়রে এ জন্যই মনে হয় রবী ঠাকুর বলেছিল, যা লিখিবে তুমি তাহাই সত্য যা ঘটিবে তাহা নয়।)।
Sir William Wilson Hunter, তার ‘The Annals of Rural Bengal’ বইয়ে উল্লেখ করেন,
‘সংস্কৃত সাহিত্যে বিবৃত প্রথম ঐতিহাসিক ঘটনা হল আদিম অধিবাসীদের সাথে আর্যদের বিরোধ।এই বিরোধ জনিত আবেগ সমানভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঋষিদের স্তবগানে, ধর্মগুরুদের অনুশানে এবং মহাকবিদের কিংবদন্তিতে’।
আর্যদের সাথে সংস্কৃতিক ও ধর্মীয় লড়াই এর ফল সরূপ বাংলাদেশের মানুষ নিরাকার একেশ্বরবাদী ধর্ম হওয়ায় জৈন এবং পরে বুদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।
এ ব্যাপারে রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ বইয়ে বলেন,
‘আর্যরাজগনের অধঃপ্তনের পূর্বে উওরাপথের পূর্বাঞ্চলে আর্য ধর্মের বিরুদ্ধে দেশব্যাপি আন্দলন উপস্হিত হইয়াছিল। জৈন এবং বুদ্ধ ধর্ম এই আন্দলনের ফলাফল’। (২৭-২৮)
আর্যদের প্রভাব বিস্তার
খৃস্টপূর্ব ৪ শতক পর্যন্ত বাংলায় আর্যরা কোন রুপ প্রভাব বিস্তার করতে ব্যার্থ হয়। মৌর্য শাসন থেকে আর্যরা এদেশে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।গুপ্ত আমলে তা আরও বৃদ্ধি পায়। ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ের রাজ শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে একঘোরতর নৈরাজ্যের সৃস্টি হয়। যা প্রায় দেড়শো বছর স্থায়ী ছিল।একে মাৎস্যন্যায় যুগ বলা হয়।এই সময় বাংলাতে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃস্টি হয় আত্মকলহ,গৃহযুদ্ধ,গুপ্তহ্ত্যা,অত্যাচার প্রভৃতি চরমে ওঠে ।বাংলার এই দুরব্যস্থার সুযোগ নিয়ে হিন্দুরা এ দেশে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এ সময় বুদ্ধ ধর্মের মধ্যে হিন্দুদের প্রভাবে তান্তিকতা ও মূর্তি পুজা প্রবেশ করে দুই ভাগ হয়ে যায়। ‘ হীনযান ও মহাযান’। মহাযানপন্থীরা হিন্দুদের প্রভাবে তান্তিকতা ও বুদ্ধ মূর্তি পুজা শুরু করে। হীনযানপন্থীরা তান্তিকতা ও বুদ্ধ মূর্তি পুজা বিরোধী। ৪।
পাল শাসন : বাংলার ইতিহসের সোনালি দিন
৭৭৫ সালে মাৎস্যন্যায়ের সময় বাংলার বিশৃঙ্খলা দমনের জন্য বাংলার মানুষ গোপাল নামক এক সামন্তরাজা কে বাংলার রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। পাল বংশ প্রায় ৪০০ বছর বাংলা শাসন করে। এ সময় বাংলার ইতিহাসের সোনালি সময়। এ সময় বাংলার বিভিন্ন জায়গার অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার গরে ওঠে যা ছিল আন্তজাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাহিত্য চর্চা ব্যপকতা পায়।রচিত হয় চর্যাপদ। এ সময় বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক অতীশ দীপংকর বিখ্যাত শিক্ষবিদ জেতারীর বিদ্যালয় এ ভর্তি হন। জেতারীর বিদ্যালয় ছিল বরেন্দ্র অঞ্চলে। হিউয়েন সাঙ এর শিক্ষক শীলভদ্র জ্ঞান চর্চা করেনও এ সময়। বুদ্ধ ধর্ম তার মহানুভতা নিয়ে আরও পৌজ্বলিত হয়। তান্তিকতা ও বুদ্ধ মূর্তি পুজারি মহাযানপন্থীদের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে যায় কালচক্রযান ও ব্জ্রযান। ব্জ্রযান শাখার মধ্যে সহজিয়া মতবাদের উদ্ভব হয় যারা তান্তিকতা ও বুদ্ধ মূর্তি পুজারি মহাযানপন্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই সহজিয়া সম্প্রদায়ই সবচেয়ে প্রাচীন বাংলা সাহিত্য চর্যাপদ রচনা করে।
এ সময় আর্য-ব্রাহ্মণ শাসিত পশ্চিম ভারত সুলতান মাহমুদের অভিযানে নাকাল থাকায় তারা সামরিক ভাবে বাংলায় কোন অনিষ্ট করার সুযোগ পায়নি। তবে চতুর ব্রাহ্মণ এ সময় তাদের প্রভাব বাড়াতে ‘Assimilation’ (আওিকরন) থিওরির আশ্রয় নেয়। বিভিন্ন রাজ পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপণ করে। যার মাধ্যমে তাদের প্রভাব ব্যাপকিত হয়। এটা স্বীকার করে ডঃ নীহাররঞ্জন তার বইতে উল্লেখ করেন,
‘ পাল রাজাদের অনেকেই ব্রাহ্মণ রাজ পরিবারের মেয়ে বিয়ে করেছিলন। ফলে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্র ধর্মের মধ্যে একটা পারস্পিক সন্মন্ধ গড়ে উঠেছিল’ ৫।
সেন শাসন : বাংলার ইতিহসের ঘোর দুঃসময়
দ্বাদশ শতকে পালদের শাসন অবসান হয়। শুরু হয় বাংলার ইতিহসের ঘোর দুঃসময়। সেন শাসন। এদের বর্ণনা দিয়ে সৈয়দ আলী আহসান বলেন,
‘দ্বাদশ শতকে কর্ণাটক থেকে বহিরাগত সেনারা এসে যখন এদেশকে অধিকার করল, তখন তারা নিষ্ঠুর শোষণ-কার্যের মধ্য দিয়ে এদেশবাসিকে নির্যাতন করতে লাগল। সংস্কৃতিকে নিয়ে এল রাজসভা ও মন্দিরের অভ্যন্তরে… সেনদের আমলে দেশীয় ভাষা চর্চা সম্পূর্ণরুপে বন্ধ ছিল। সেনরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিল তা ছিল হিন্দুদের এবং তাও সকল হিন্দুদের নয়। তা ছিল কৌলিন্যবাদী ব্রাহ্মণদের এবং অংশত ক্ষএিয়দের। শেষ রাজা লক্ষ্মন সেনের রাজদরবারে যে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক ছিলেন, তারা সংস্কৃত ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন’।৬।
সেন রাজারা ছিলেন বৈষ্ণব মতবাদের কঠোর অনুসারী। এ সময় বাংলায় পাইকারি হারে বুদ্ধদের হত্যা করা হয়। বর্ণ প্রথা চালু হয়। উপওি হয় ছএিশ জাতের। হিন্দুদের অত্যাচারে কয়েক কোটি বুদ্ধ নিহত হয়। যারা বেঁচে ছিল তারা লেপাল, মঙ্গলীয়া, বার্মা, সহ ঐসব এলাকায় পালিয়ে যায়। সবচেয়ে প্রাচীন বাংলা সাহিত্য চর্যাপদ নেপালে পাওয়া যায় কারন সহজিয়া সম্প্রদায় হিন্দুদের অত্যাচারে নেপাল চলে গিয়েছিল।
এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন ‘Discovery of Living Buddhism in Bengal’ বই থেকে রেফার করেন,
‘যে জনপদে(পূর্ব বঙ্গে) এক কোটিরও অধিক বৌদ্ধ ছিল এবং ১৫৫০ ঘর ভিক্ষু বাস করিত, সেখানে একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থ এিশ বছরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই’। (প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান, ১০-১১)
মুসলমানদের আগমন
মুসলমানদের আগমন বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি। ১২০৫-৬ সালের দিকে মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী সেন রাজবংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনকে মাত্র ১৮ জন সৈনিক নিয়ে পরাজিত করে গৌড় জয় করেন। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো বাংলা জয় করেন। একেশ্বরবাদী সেমেটিক, জৈন এবং বুদ্ধ ধর্মের উওরধিকারি এদেশের মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গ মুসলিম প্রধান জনপদে পরিণত হয়।
এখন প্রশ্ন পহেলা বৈশাখ ও বিশেষ করে তার প্রধান দুই আচার মঙ্গল শোভাযাএা ও মঙ্গলদ্বীপ জ্বালানো কি আমাদের কখনও আমাদের পূর্ব পুরুষের সংস্কৃতির অংশ ছিল? বা পালন করতেন ? উওর না। দ্রাবিড় বা বঙ্গবাসী কখনও এমন উৎসব করেছেন এমন নজির নেই। আসুন একটু দেখার চেষ্টা করি কিভাবে এটা এল...
পহেলা বৈশাখ
ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতেহত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই ইরানের নওরোজ এর অনুকরণে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয় প্রথম দিকে একে নওরোজই বলা হত।
পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাএা ও মঙ্গলদ্বীপ
লোকগবেষক আতোয়ার রহমান 'বৈশাখ' শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, 'বৈশাখ তার নামের জন্য বৈশাখ নক্ষত্রের কাছে ঋণী। পুরাণের মতে বিশাখা চন্দ্রের সপ্তবিংশ পত্নীর অন্যতম’। হিন্দু মিথ অনুযায়ি, ‘মাস হিসেবে বৈশাখের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, যা প্রকৃতিতে ও মানবজীবনে প্রত্যক্ষ করা যায়। খররৌদ্র, দাবদাহ, ধু-ধু মাঠ, জলাভাব, কালবৈশাখীর ঝড় ইত্যাদি’৭। এ সকল অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য হিন্দুরা মঙ্গল শোভাযাএা করতো ও মঙ্গলদ্বীপ জ্বালাত। হিন্দু ব্যাবসায়ীরা হালখাতা খুলত। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে (পহেলা বৈশাখ এর আগের দিন) তৈলবিহীন নিরামিষ ব্যঞ্জন রান্না করার রীতিরও প্রচলন ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের; পরদিন সমারোহে মাছ খাওয়ার সঙ্গতি বাঁচিয়ে রাখার কথা বিবেচনা করেই। বাঙালি মুসলিম ব্যাপক ভিওিতে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন এর নজির পাওয়া যায় না। তবে দ্রাবিড়দের মধ্যে ফসল কেটে নবান্ন উৎসব পালনের কথা পাওয়া যায়। এছাড়া ইবনে বতুতা ফসল কাটার উৎসব এর কথা উল্লেখ করেছেন। চর্যাপদের বিভিন্ন পদেও নতুন ফসল কাটার উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।
বাংলার মুসলিম সমাজে পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাএা ও মঙ্গলদ্বীপ
বাংলার মুসলিম সমাজে পহেলা বৈশাখ এর প্রচলন খুব অপ্ল দিনের। ‘ঢাকায় পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬৭ সাল থেকে এ আচার শুরু হয়’৮। মঙ্গল শোভাযাত্রার আরও অপ্ল দিনের। মাএ ২৫ বছর হল। ১৯৮৯ সালে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার বের হয় ৯। মঙ্গলদ্বীপ আরও নতুন। মাএ কয়েক বছর হল এর প্রচলন হয়েছে।
পর্যালোচনাঃ
সবদিক পর্যালোচনা করে এ বিষয় গুলো আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি,
১ সুপ্রাচীন কাল থেকে পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাএা ও মঙ্গলদ্বীপ কখনও বাংলার মানুষের স্হানিক বা ধর্মীয় সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের অংশ ছিল না।
২ মঙ্গল শোভাযাএা ও মঙ্গলদ্বীপ একটি ভ্রান্ত কুসংস্কার। এটা আমাদের মহান পূর্ব পুরুষদের বিশ্বাস, সাংস্কৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান এবং আমাদের ধর্মের সাথে সাংঘসিক।
৩ পহেলা বৈশাখ, মঙ্গল শোভাযাএা ও মঙ্গলদ্বীপ আর্যদের সাংস্কৃতির অংশ যাদের বিরুদ্ধে আমাদের মহান পূর্ব পুরুষ গন শত শত বছর যুদ্ধ করেছেন। কোটি কোটি মানুষ প্রান দিয়েছেন।
শেষ কথাঃ
আমরা পহেলা বৈশাখ পালন করতেই পারি যেহেতু আর্যদের সাংস্কৃতির অংশ হলেও এর মূল ধারা আর্যদের সাংস্কৃতির অংশ নয়। তবে এটা কোনভাবেই আমাদের বা আমাদের মহান পূর্ব পুরুষদের সাংস্কৃতির অংশ নয় অর্থাৎ বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্য তত্ত্ব্ নয়।
মঙ্গল শোভাযাএা অংশ নেওয়া ও মঙ্গলদ্বীপ জ্বালানো আমাদের পূর্ব পুরুষদের বিশ্বাস, সাংস্কৃতি, আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে প্রতারনা। এবং আমাদের ইসলাম ধর্মে তা নিষিদ্ধ। ইসলাম মতে মঙ্গল শোভাযাএা অংশ নেওয়া ও মঙ্গলদ্বীপ জ্বালানো শিরক।
রেফারেন্স ও সহায়ক গ্রন্থ সমূহ :
১ সৈয়দ আলী আহসান : (মুখবন্ধ) আমাদের জাতি সওয়ার বিকাশধারা।(১,৬)
২ ড. সৌরভ সিকদার : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, ১৪ (২)
৩ কামরুদ্দিন আহমদ : A Social History of Bengal
৪ ড. সৌরভ সিকদার : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, ১০৪
৫ ডঃ নীহাররঞ্জন : বাঙালির ইতিহাস, ১৩৯ (৫)
৬ ওয়াকিল আহমদ : বাংলা নববর্ষের চেতনা (প্রবন্ধ)৭
৭ নওয়াজেশ আহমদ: রমনার বটমূলে জাতীয় উৎসবে, দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮ (৮)
৮ দৈনিক সমকাল, ৩য় পাতা, ১০ এপ্রিল ২০১৪ (৯)
৯ আব্দুল মান্নান তালিব : বাংলাদেশে ইসলাম
১০ Sir William Wilson Hunter : ‘The Annals of Rural Bengal’
১১ আবুল মনসুর আহমদ : আমাদের কৃস্টিক পটভূমি, পূর্বদেশ, ঈদ সংখ্যা-১৯৬৯
১২ Cambridge Encyclopedia : Edited by David Crystal
১৩ আতোয়ার রহমান : 'বৈশাখ' (প্রবন্ধ)
১৪ ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন : প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান
১৫ অধ্যাপক মন্হথমহোন বসু : বাংলা নাটকের উৎপওি ও ক্রমবিকাশ
১৬ রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’
বিষয়: বিবিধ
১৯৭৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন