একটি লোমহর্ষক ও মর্মস্পর্শী ঘটনা'' রক্তের ফোঁটা নয়,অশ্রুর ফোঁটাতো দিতে পারবো? লেখকঃ আবু তাহের মিছবাহ
লিখেছেন লিখেছেন মারইয়াম উম্মে মাবরুরা ২৮ মার্চ, ২০১৪, ০৫:৫৬:৫১ বিকাল
জীবনের পান্থপথে কত জনের সাথে দেখা হয়। কখনো একবার কখনো বহুবার। কেউ হারিয়ে যায় স্মৃতির পাতা থেকে, কারো স্মৃতি সঞ্চিত থাকে হৃদয়ের গভীরে। আমার হৃদয়ে স্মৃতির পাতায় যাদের স্মৃতি আজো সমুজ্জল, তাদের একজনের সাথে পরিচয় হয় বিমানে। আমার পাশের আসনে ছিলেন তিনি। বিমান তখন আকাশে উঠেছে ও ডানা মেলে ওড়ছে। হঠাত্ দেখি অপলক দৃষ্টিতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সে দৃষ্টিতে কী ছিল,বেদনা! বিষণ্নতা! মমতা!
স্মৃতির ব্যাকুলতা ও কাতরতা! জানিনা তবে কিছু একটা ছিলো যা বৃদ্ধের প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করলো। আমি সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করতেই অপরিচয়ের বাঁধ যেন ভেঙ্গে গেলো। তিনি নাম জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম আবু তাহের। বৃদ্ধ যেন চমকে উঠলেন। আবু তাহের!, তোমার ছেলের নাম তাহের!
বুঝিয়ে বললাম তাহের নামে আমার কোনো ছেলে নেই। এভাবেই আমার নাম রাখা হয়েছে। তিনি একটু বিষণ্ন হাসি হেসে বললেন ওহ! আমাকেও সবাই আবু তাহের ডাকে। আমার একমাত্র ছেলের নাম ছিলো তাহের। বেঁচে থাকলে তোমার বয়সের হতো। তোমাকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে,আমার তাহের বেঁচে থাকলে দেখতেও তোমার মত হতো। এতটুকু বলতেই বৃদ্ধের চোখ ছলছল করে উঠলো। এরপর তিনি তার জীবনের র্দীর্ঘ কাহিনী শোনালেন, তা যেমন রক্তভেজা,তেমনি অশ্রুভেজা, যেমন লোমহর্ষক তেমনি মর্মস্পর্শী। শুনতে শুনতে সেদিন আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছিলো। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের অধিবাসী।
১৯৪৮ থেকে ফিলিস্তীনে ইহুদী পশুদের নিষ্ঠুর উচ্ছেদ-অভিযান শুরু হয়েছিলো। কয়েক লাখ ফিলিস্তীনী মুসলিমকে তখন তাদের হাজার বছরের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে বিভিন্ন আরব দেশে হিজরত করতে হয়েছিলো। তিনি ছিলেন পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক। তিনিও বিতাড়িত হয়েছিলেন এবং জর্দানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সহায় সম্পদ, এমনকি স্ত্রী পুত্র হারিয়ে।তাঁর মা-বাবা দুজনেই ছিলেন ফিলিস্তীনী মুজাহিদ। উভয়ে অস্ত্র হাতে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন।তিনি তাঁর আম্মার সাহস ও নির্ভীকতা ও ঈমানী গায়রাত ও জিহাদী জাযবার এমন সব ঘটনা শুনিয়েছিলেন যা আমার দেশের কোন মর্দে মুমিন সম্পর্কেও কল্পনা করা যায়না। শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্তেও ফিলিস্তীনের বীরঙ্গনা সেই মুসলিম নারী শুধু খন্জর হাতে একটা ইহুদী জানোয়ারকে জাহান্নামে রাসীদ করেছিলেন।
আম্মা-আব্বার শাহাদাতের পর অটল প্রতীজ্ঞা ছিলো যে কোনো মূল্যে তিনি পিতৃভূমির মাটি কামড়ে পড়ে থাকবেন। পুর্ব পুরুষদের বাস্তুভিটা ইহুদীদের হাতে ছেড়ে কখনোই যাবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে গেলো সেই ভয়াবহ রাত। সেটা ছিলো রামযানের মাঝামাঝি সময়।
গভির রাত। ছয় বছরের শিশু তাহের ও তার মা ঘুমিয়ে আছে।পালা করে পাহারা দিতে হয়।তিনি বন্দুক হাতে পাহাড়া দিচ্ছেন। এমন সময় ইহুদী পশুরা হানা দিলো তাদের বস্তিতে। একদল হায়েনা অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়লো তাঁর বাড়িতেও। তিনি প্রতিরোধ করতে চাইলেন। কিন্তু একা একটি বন্দুক হাতে আর কতক্ষণ!
শেষ পর্যন্ত তিনজন ইহুদীকে খতম করে তিনি আহত ও বন্দী হলেন।
বাকি ছয় সাত ইহুদী হায়েনা উল্লাসে মেতে উঠলো। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও তার স্ত্রী সাহস হারাননি। তিনি জানতেন ইহুদীদের কবলে যাওয়ার পরিণতি কী?
তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিলেন। তবে দুই ইহুদী হায়েনাকে জাহান্নামের খোরাক বানিয়ে তারপর। চোখের সামনে স্ত্রীর শহীদী লাশের বে-হুরমতি হলো। তিনি কিছুই করতে পারেন নি।কিছুই করার ছিলোনা। কারণ তখন তিনি পশুদের হাতে বন্দী, আহত ব্যঘ্র।এমনকি যখন পশুরা ছয় বছরের শিশুকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করলো তখন ও কিছু করতে পারেননি। প্রাণপণে শুধু ভিতরের চিত্কারটুকু রোধ করার চেষ্টা করেছেন। যাতে পশুগুলোর সামনে মুমিনের দুর্বলতা প্রকাশ না পায়।
অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে তাহিরের পিতা বললেন খুব ভালো মায়ের দুধ পান করেছিলো আমার বেটা। সহজে তার জান বের হয়নি। পশুরা যখন অতটুকু নিস্পাপ শিশুকে বেয়নেটের মাথায় বিদ্ধ করে শূন্যে তুলে রেখেছিলো তখনো সে চেয়েছিলো আমার দিকে। এবং শান্ত দৃষ্টিতে। ধীরে ধীরে তার মাথাটা ঝুলে পড়লো। তার জানটা বের হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখে পশুগুলো অবাক না হয়ে পারেনি। আমার ছেলের বড় শক্ত জান ছিলো। বেঁচে থাকলে জানবাজ মুজাহিত হতো। বৃদ্ধ এমনভাবে বলছিলেন যেন গতকালকের ঘটনা, যেন স্ত্রী-পুত্রের তাজা লাশ তাঁর চোখের সামনে। চোখ থেকে ঝরা অশ্রু যেন অশ্রু নয়, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত যেন ঝরছে তার কলিজার যখম থেকে।
তিনি বলেন আমাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে পশুরা চলে গেলো। কিন্তু আমার তাকদীরে ছিলো বেঁচে থাকা। কীভাবে বেঁচে গেলাম, এবং পিতৃভূমি থেকে প্রাণ হাতে পালিয়ে জর্দান সীমান পার হলাম তা দীর্ঘ এক কাহিনী। শুধু এইটুকু বলতে পারি পদে পদে আল্লাহর কুদরত আমাকে সাহায্য করেছে। এবং কয়েকবার মৃত্যুর ঘেরাও পার হয়ে আমি জর্দানে পৌছতে পেরেছি। আমার শহীদ আম্মা আব্বার জানাযা আমি পড়েছি, এবং নিজের হাতে দাফন কাফন করেছি তাই আমার সান্ত্বনা ছিলো। কিন্তু আমার স্ত্রী! আমার মাসুম বাচ্চা! তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশতো পড়ে ছিলো সেই ঘরে। একটা চাদর দিয়েও ঢেকে আসতে পারিনি। আমি যেন আমার স্ত্রী ও মাসুম বাচ্চার লাশ আমার বুকের ভিতর দাফন করে রেখেছি। সে বছর ই আল্লাহ হজ্ব করার তৌফিক দিলেন। তারপর থেকে প্রতি রামাযানে ওমরা করি। যখন ই আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করি,আমি আমার পাশে আমার স্ত্রী পুত্রের উপস্থিতি অনুভব করি। যেন একেবারে শরীরী উপস্থিতি। আমার স্ত্রী তেমনি জোয়ান। আমার বেটা সেই নিস্পাপ শিশুটি। আমার বিশ্বাস জান্নাতে ওদেরকে পাবো। এবং আমি আমার স্ত্রীর মত জোয়ান হবো। আমার বেটা তেমনি শিশু থাকবে।
এবং গিলমানদের সাথে ঘুরে বেড়াবে। মনে পড়ে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,আপনি কি আবার শাদী করেছেন? তিনি এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যেন আমি কুন্ঠিত হয়ে পড়লাম। তার দুই ঠোঁটের মাঝে তখন যে নূরানী হাসি খেলা করছিলো তা আমি এখনো ভুলিনি। তিনি বললেন 'শাদী! কেন? স্ত্রীতো আমার পাশেই রয়েছে। আমার পুত্র তো এখনো আমার হাত ধরে হাঁটে। সেদিন আমি কামনা করেছিলাম পৃথিবীর সব পুরুষ যেন হৃদয়ের গভীরে এমন ভালোবাসা পোষণ করতে পারে স্ত্রী সন্তানের প্রতি।
জানিনা মুসলিম উম্মাহের মায়েদের বুকের দুধে এখনো সেই গুণ আছে কিনা! কিংবা এখনো তারা তাদের গর্ভে এমন সন্তান কামনা করে কিনা , যারা বাঁচবে গাজী হয়ে, মরবে শহীদ হয়ে!
বিষয়: বিবিধ
১৭০৮ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো || ধন্যবাদ || পিলাচ || মাইনাস || অনেক ধন্যবাদ || স্বাগতম ||
কুইক কমেন্ট তৈরি করুন
পোস্টটি পড়ার পর চোখদুটো ছল ছল করতেছে আমার।
আল্লাহ উত্তম অভিভাবক। উনি হিফাজত করুন আমাদের ভাইবোনদের।
সুন্দর লিখাটি শেয়ার করার জন্য শুকরিয়া।
"ফিলিস্তিনের মা-বোন,বাবা-ছেলেরা আমাদের অহংকার,গর্ব। হে আল্লাহ তুমি মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করো, শান্তি দাও।।।"
হায় আল্লাহ আদীব হুজুরের কলমের বরকত আমাদেরকে আরো দান করুন।আমিন
একজোড়া খরম উপহার পেয়েছি। পড়ে আসতে পারেন
মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়েও তারা সুখি
সে তো তার ঈমান বলে
যারা আল্লাহর কথা বলে আল্লাহর পথে চলে
আল্লাহকে ভালোবেসে সপেছে জীবন
তাদের কিসের ভয়! কে করে পরাজয়
শহীদি তামান্নাতে নাচে তাঁর মন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন