আমি কনফিউজড - স্বাধীনতা আছে তো ?
লিখেছেন লিখেছেন রাযাই জহীর ১৭ মার্চ, ২০১৪, ০৩:০৫:০৯ রাত
যুক্তরাজ্যে যে কোনো ফর্ম পূরণ করতে গেলে একটি প্রশ্নের উত্তর হামেশাই দিতে হয় - আপনার জাতিগত পরিচয় (ethnic identity) কি? উত্তরটা আমাকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেয়ার সুযোগ নেই - আমাকে শুধু টিক করে দিতে হয় নির্ধারিত বক্সে - ''এশিয়ান - বাংলাদেশী'' । এখানে বাংলাদেশী শব্দটা অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে লিখা হয়ে থাকে। আর যুক্তিটা হচ্ছে ভৌগলিক পরিসীমা দ্বারা নির্দিষ্ট একটি ভূখন্ড আমার জাতীয়তার নির্ণায়ক। যেমন জার্মান ভাষাভাষী জার্মান-অস্ট্রিয়ানরা নিজেদের জার্মান না বলে অস্ট্রিয়ানই বলে থাকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারী মাস এলেই একধরনের তর্ক - বিতর্ক শুরু হয়ে যায় যা শেষ হতে হতে আরো কয়েক মাস লেগে যায়। আর T-20 'র মত কোনো আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যদি হিন্দি-ভারাক্রান্ত হয় তাহলে তো কথাই নেই। আমার প্রারম্ভিক বক্তব্যে দ্বিধা-বিভক্ত স্বজাতি ভাই-বোনেরা আমাকে ''জাতীয়তাবাদী'' শিবিরে ফেলবে - এতে কোনোই সন্দেহ নেই। আমি কোন শিবিরের বাসিন্দা তার কৌশল তো জর্জ বুশ তার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার সময়ই শিখিয়ে দিয়েছিলেন ''Either you are with us or you are with the terrorist''।সুতরাং আমি যদি আপনাদের সমর্থন করতে বিবেক দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হই তাহলে জর্জ বুশের তত্ত্ব তো আমার উপর কার্যকরী হতেই পারে। আমাকে আপনারা যে মানদন্ডেই বিচার করুন না কেন আমার এই পাঠক-আবিষ্কৃত রাজনৈতিক পরিচয় আমার নিজস্ব কোনো সৃষ্টি নয়। আমার পাসপোর্ট এই ধরনের জাতীয়তাই উল্লেখ করেছে। আর আমার প্রথম পাসপোর্টটি করিয়েছিলাম মাননীয়া শেখ হাসিনা যখন প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আমি অবশ্য জানিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাসপোর্ট এ জাতীয়তার বক্সটিতে কি লিখা ছিল। জানিনা মাননীয়া শেখ হাসিনার পাসপোর্ট-এ জাতীয়তার বক্সটিতেই বা কি লিখা আছে।আমাদের বাতিলকৃত জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইংরেজি ভাষায় উর্দু ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমাদেরকে সৎ-সন্তানের মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। তিনি সংখ্যা গরিষ্ঠদের বাংলাদেশে না এসে গেলেন সংখ্যা লঘিষ্টদের পশ্চিম পাকিস্তানে। সংখ্যা গরিষ্ঠদের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত না করে করলেন সংখ্যা লঘিষ্টদের ভাষাকে। চাপিয়ে দেয়া ভাষা আমরা প্রত্যাখান করেছি। আজ এত বছর পর আবার একই কান্ড ঘটছে এই স্বাধীন দেশ বাংলাদেশে !
আওয়ামী লীগের অতি সংবেদনশীল সমর্থকরা যারা বাংলাদেশী বললে চরম নাখোশ হন আর ঠেলে দেন রাজাকার শিবিরে,যারা বাঙালি ভিন্ন অন্য কোনো জাতীয়তার কথা উচ্চারন করলে চেতনায় আঘাতকারী বলে তেড়ে আসেন তারা কিনা হিন্দি-আগ্রাসনের এদেশীয় এজেন্সী নিলেন। হিন্দি-গায়ক এ আর রহমানকে নিয়ে স্ব-পরিবারে খোশ-গল্প করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । আর আমাদের শিল্পীদের বানিয়ে দিলেন অচ্ছুত। কোটি-কোটি টাকা খরচ করে তাহলে কি ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতেই এত আয়োজন? উর্দুর জন্যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে বাতিল করে দিয়েছিলাম আর এখন হিন্দি প্রতিষ্ঠিত করতে ভাষা সৈনিক-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও কি বাতিল করে দেব ? তাও আবার বঙ্গবন্ধু-কন্যার নেতৃত্বে?
জানি এতে 'কুচ পরওয়া নেহি'। বঙ্গবন্ধুর সহচর প্রবীন সাংবাদিক মুসা আহমেদ ভাষায় ''দে ডোন্ট কেয়ার''। তার মানে আগ্রাসন এখন ব্যক্তি বিশেষের চয়েস। ইউক্রেন পুতিনের কথা না শুনে ইইউর সাথে বেশি মাখা-মাখি করায় শেষতক ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার কাছে তুলে দেয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়তে বাধ্য হয়েছে। গণভোটে হয়েছে। ফলাফল রাশিয়ার সাথে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে। আমেরিকা আর ইংল্যান্ড যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন ক্রিমিয়ার এখন রাশিয়ার অংশ হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের দেশে সে ধরনের একটা গণভোট হওয়ার আশংকা কি আমরা করতে পারি? দেশের সংস্কৃতি, ব্যবসা - বানিজ্য আর ভোটের অধিকার সব কিছুই তো এখন ভারতীয় দের ইশারায় চলছে। সরকারী চাকুরে সুজাতা সিং এসে আমাদের নেতাদের বাতলে দেন কি করতে হবে আর কি করতে হবে না। সত্য না মিথ্যা জানি না - একবার তো দেখেছিলাম ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশের সাতক্ষিরায় অপারেশন করানোর জন্য চিঠি চালাচালি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর গণভোটের কথা যদি বলি - খাঁটি ভোট হলেও ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষের লোকের সংখ্যা একান্ত কম হবে না। অ-খাঁটি ভোট হলে তো কথায় নেই। ভোটের বাক্স দখল, কেন্দ্র দখল, নির্বাচন কমিশন দখল এমন কি প্রাথী দখলও আমরা দেখেছি।
বাংলাদেশে বন্যা, ভবন ধ্বস, অগ্নি কান্ড আর মানুষ জবাইয়ের মত ঘটনা শুনতে শুনতে অনেক ঘটনা ঠিক সে রকম ভাবে নজরে আসে না। অনেক দিন ধরে ১০-ট্রাক অস্ত্র মামলা নামক একটা কথা শুনছিলাম। এটি নাকি চোরাচালানের মামলা। ভাবলাম হতেও পারে। আমাদের দেশে তো জজ সাহেবের গাড়িতেও ফেনসিডিল পাওয়ার নজির আছে। সেদিন এই বিদেশে বসে যখন ইউ টিউব -এ দেখলাম মাননীয় বিচারক দুইজন মন্ত্রী আর আমাদের সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ দু'টি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান দুই জেনারেলসহ ১৪ জনের ফাঁসির আদেশ দিলেন তখন নড়ে চড়ে বসলাম। ঘটনাটা কি ? খবরটা বোঝার চেষ্টা করলাম। কিছুই আবিষ্কার করা যাচ্ছিল না প্রতিবেদকদের বক্তব্য থেকে । বারবার বলছিল ''বহুল আলোচিত'', ''অত্যন্ত গুরত্ব পূর্ণ '', ''আজকের টক অফ দি কান্ট্রি '', ''এত বড় ঘটনা '', ''আমাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির সমুক্ষিন করা ঘটনা '', ''হাই প্রোফাইল কেস'' ইত্যাদি ইত্যাদি নানা শব্দ। কিন্তু অপরাধটা কি বুঝতে পারছিলাম না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত বোঝার চেষ্টা করলাম। একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মুয়াজ্জেম আলী বললেন দক্ষিন এশিয়ার এই অঞ্চলে বিচ্ছিনতাবাদী বিভিন্ন সংগঠনকে এই ধরনের অস্ত্র সরবরাহের একটা সংস্কৃতি সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চালু আছে। তিনি বলেছিলেন ভারত ১৯৭৫ সাল থেকে পরবর্তী দুই দশক পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীকে এই ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। কিন্তু আমরা জানতে পারলাম না ভারত কি তার গোয়েন্দা সংস্থা ''র'' এর কোনো প্রধানকে আমাদের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল? একজন প্রাক্তন জেনারেল আব্দুর রশিদ বার বার geo-political situation কে বিবেচনায় নেয়ার কথা বলছিলেন। তিনি বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে আদালতের এই ধরনের নিরাপত্তা ইসু নিয়ে বিচার করার সময় বিরাজমান geo-political situation কে বিবেচনায় না নিলে একে অপরাধ বলে মনে হতে পারে । তবে আদতে এটি কোনো অপরাধ নয়। ভারত বা পাকিস্তান আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় এই কাজগুলো করে থাকে এবং তা আদালতের চৌহদ্দির বাইরেই থাকে।
কে শুনে কার কখা। বুঝলাম এখানেও একই অবস্থা । কোনো দেশের গোয়েন্দা বাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তিটিকে যখন ফাঁসি দেয়া হয় তখন বুঝতে হবে যে এতে নি:সন্দেহাতীতভাবে বিদেশী ষড়যন্ত্র আছে।
ভারতের বানিজ্যিক আগ্রাসন অনেকদিন ধরেই চলছিল। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তো এরও আগে থেকে। তবে এগুলোকে স্বাভাবিক ভেবেছিলাম যখন দেখলাম বৈশ্বিক যুগে এটি প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু যখন দেখলাম T-20 আয়োজনে আমরাই এক পা এগিয়ে আগ্রাসনের আহবান জানাচ্ছি তখন বুঝলাম আমাদের স্বাধীনতা প্রশ্নযুক্ত। আর সাথে যখন আমাদের জেনারেলদের মৃত্যুদন্ডের সাজা এক সাথে করে দেখি তখন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে আসলে প্রশ্নযুক্ত স্বাধীনতার পুরোপুরি হরণ এখন হয়ত বা সময়ের ব্যাপার।
যত দূর জানি মীর জাফর বাংলাদেশের মাটিতে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তার বিশ্বাসঘাতকতার যে কিংবন্দন্তি প্রচলিত আছে সে হিসাবে মীর জাফরের একটা ''গণ-পিটুনি''র মৃত্যু প্রাপ্য ছিল। তার স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দিচ্ছে যে মাত্রায় তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তা বুঝতে বাংলাদেশের মানুষের অনেক বছর লেগে গিয়েছিল। আজকের এই বিজ্ঞানময় পৃথিবীতে যারা আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে মীর জাফরের ভূমিকায় অবতীর্ণ তারাও কি মীর জাফরের মত সৌভাগ্যবান হবে।
বিষয়: রাজনীতি
১৪৩১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এ নিয়ে গতকাল আমি লিখেছিলাম, হ্যাপিত্যেশ করতে হলে মূলতঃ আমাদের সত্যিকার জাতীয়তা চিহ্নিত করে তার ভিত্তিতে করলে ফল পাওয়া যাবে।
Thanks for your thoughtful writing.
মন্তব্য করতে লগইন করুন