এপ্রিলের ইতিহাস নিয়ে নতুন ভাবনা!
লিখেছেন লিখেছেন মাহমুদ আরিফ ২৬ মার্চ, ২০১৪, ১১:১৪:৩২ সকাল
দৃশ্য:১:
করিম ঘুম থেকে উঠে বাজারে গেল। সেলিম বলল, ‘কাল তোর বউরে দেখলাম পাশের বাড়ীর আকিলুদ্দীর লগে ইটিশ-পিটিশ করতাছে’। ব্যাস, করিম শোঁ করে বাড়ি এসে স্ত্রীকে রাগের মাথায় অকথ্য ভাষায় গালাগালি করল। সেলিম করিমের খুব পুরনো বন্ধু। তাই তার কথা অবিশ্বাস করার কিছু নেই। আবার করিমও সেলিমের খুব রসিক বন্ধু। কিন্তু হঠাৎ যে সে এত রেগে যাবে, ভাবতেই পারে নি। ফল কী হলো? একটি সংসারে ভাঙন ধরল। অথচ সেলিম সিরফ করিমকে এপ্রিল ফুল বানাতে চেয়েছিল, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
দৃশ্য:২:
করিম অফিসে বসে আছে। কাজে খুব ব্যস্ত। হঠাৎ সেলিমের ফোন আসল, ‘তোর মা… আর নেই… তাড়াতাড়ি বাসায় আয়’। করিম হুড়োহুড়ি করে সবকিছু ছেড়ে বাসায় ফিরে দেখল ঘটনা কিছুই না, মা সুস্থ আছেন। কয়েক বন্ধু একসাথে হয়েছে এই আর কি। আর মাঝে দিয়ে করিম হয়ে গেল ‘এপ্রিল ফুল’।
দৃশ্যগুলো বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। বাস্তবে এমন তেমনটা হয় না। কিন্তু বাস্তবে যা হয়, তা কিন্তু আবার কল্পনায়ও আসে না। প্রায়ই এপ্রিলের দুই তারিখে পত্রিকার পাতায় শিরোনাম দেখা যায় ‘নির্মম এপ্রিল ফুল’, ‘এপ্রিল ফুলের বলি হলো নিস্পাপ ছেলেটি’ –ইত্যাদি।
ইউরোপে ১৭৪৬ ঈশাব্দে ‘Evening Star’ নামের এক পত্রিকা ঘোষণা দিল যে, আগামীকাল ১লা এপ্রিলে অমুক জায়গায় গাধার প্যারেড অনুষ্ঠিত হবে। উৎসুক জনতা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অপেক্ষা করতে করতে যখন আর সইল না তখন আর বুঝতে বাকী রইল না যে, পত্রিকার ঘোষিত গাধা তারাই। তাদেরকে ‘এপ্রিল ফুল’ বানানো হয়েছে।
আমাদের দেশে ক’দিন আগে অভিনেত্রী জয়াকে কেন্দ্র করে কী হলো তা মনে আছে তো? বিজ্ঞপ্তি শব্দটা উল্লেখ করে দেওয়ার পরও বেচারা ভক্তকুল তাকে হারানোর শোক সইতে পারছিল না। অনেকে অনেক রকম লেখা দিয়েছেন, বিবৃতি দিয়েছেন। জয়াকে নিয়ে নিজেদের উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন। কেউ আবার কান্নাকাটিও করেছেন। শেষে কী হলো? দেখা গেল, ওটা ছিল সিরফ একটা বিজ্ঞাপন, আর সবাই হয়েছে ‘ফুল’। কিন্তু তারপরও সাধারণ জনগণসহ সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীগণ তার তীব্র নিন্দা করলেন। কেন করলেন?
এই ঘটনাটাই যদি এপ্রিলের এক তারিখে ঘটত, তাহলে এই ‘তারাই’ কিন্তু সেটাকে ‘এপ্রিল ফুল’ বলে হেসে উড়িয়ে দিতেন। কারণ ওই একদিনের জন্য তো সব বৈধ। কাউকে ফুল বানাতে সেদিন কোনো কুল-কিনারা-প্রাচীর-সীমানা নেই। যে, যেভাবে, যাকে ইচ্ছা, ‘ফুল’ বানিয়ে ফুল দিতে পারে। কেউ কিছু বলবে না।
[দুই]
প্রতিবছর এপ্রিল আসলে আমরা অনেক ইতিহাসবিদ দেখতে পাই। এপ্রিল ফুলের পেছনে কী ইতিহাস ছিল তা খোঁজার জন্যে অনেকেই রাত-দিন গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে যান। একদল প্রমাণ করে দেখান যে, এটার পেছনে একটি জাতির মর্মন্তুদ ইতিহাস রয়েছে, কাজেই তাদের পক্ষে এটা পালন করা সাজে না।
আরেক দল প্রমাণ করেন যে, ঐ ইতিহাস সম্পূর্ণ ভুল। বরং এর পেছনের ইতিহাস সিরফ মজার, তাতে কোনো কষ্ট-কান্না নেই। তাই তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-কর্ম নির্বিশেষে যে কেউ পালন করতে পারে। বরং আমাদের গুরুরা যেখানে তা পালন করছেন, আমাদের তা পালন না করলে কি চলে!
তার মানে কী দাঁড়াল? তার মানে দাঁড়াল এই যে, এই দিবসটা পালনের বৈধতা-অবৈধতা ঘুরপাক খাচ্ছে এর পেছনের ইতিহাসের সত্যতা-অসত্যতার মাঝে। যদি ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে এটা ঐ জাতির বিপক্ষে কোনো মর্মন্তুদ ষড়যন্ত্রের উপর ভিত্তি করে শুরু হয়েছে, তাহলে তা পালন করা যাবে না। আর যদি তা প্রমাণিত না হয়, তাহলে তা ঠিকই পালন করা যাবে।
ব্যস, শুরু হয় দু’পক্ষের বাকযুদ্ধ। এক পক্ষ উইকিপিডিয়া, এনকার্টা, ব্রিটানিকা ইত্যাদি চষে দেখাবেন যে, ইতিহাসটা সহীহ না। আরেক পক্ষ মুসলিমপিডিয়া, ইসলামপিডিয়া ইত্যাদি দিয়ে দেখাবেন ইতিহাসটা সহীহ। আরে ভাই! যেটার প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে প্রকৃত ইতিহাসবিদরাই সন্দেহবিদ, সেখানে আমাদের মতো অনৈতিহাসিকদের ঐতিহাসিক হওয়ার কি কোনো মানে হয়? (প্লিজ কেউ রাগ করবেন না।)
সোজা কথায় আসি। ইতিহাস পক্ষে থাক বা বিপক্ষে থাক, সেটা কেন মূল আলোচনায় আসবে? প্রথমে দেখতে হবে, যে কর্মটা নিয়ে আমরা এত হইহই করছি, সেটার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। ধর্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু মানবতাও কি এসব মিথ্যা-ধোকা সাপোর্ট করে? এই যে প্রতিবছর এটাকে কেন্দ্র করে এতসব অঘটন ঘটছে, এগুলো কি মানবতা বিরোধী নয়? বছরের ৩৬৪ দিন যা করলে মানুষ মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হয়, এই একদিন তা করলে কি সে Jokes-বাদী হয়ে যায়? বরং এই দু’মুখো আচরণের জন্য কি সে দু’মুখী ভন্ড হয়ে যায় না?
মিথ্যা মানুষের স্বাভাবিক বাকশক্তিকে ব্যাহত করে। সমাজে তার বিশ্বস্ততা কমিয়ে দেয়। পৃথিবীর কোনো ধর্ম-দর্শন মিথ্যার পক্ষে কথা বলে নি। বড় বড় মনীষীগণের জীবনী খুঁজলে দেখা যাবে যে, তারা জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত সত্যের উপর অবিচল থেকেছেন।
মানুষের মাঝে পশুত্ব আর দেবত্ব দুটোই কাজ করে। পশুত্বকে দমিয়ে রেখে দেবত্ব অর্জনের চেষ্টায় তাকে থাকতে হয়। তা হলেই কেবল মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। কিন্তু, তারপরও, পশুত্বই জয়ী হয় অধিকাংশ সময়ে। আর স্বেচ্ছায় সে পশুত্বকে, একদিনের জন্যে হলেও, আশ্রয় দিলে তো তা ঘাড়ে চড়ে বসবেই।
ধরুন, আপনি কখনো মিথ্যা বলেন না। কিন্তু একদিন বললেন, তো সেটা আপনার কাছে আগের মতো আর ভয়ানক মনে হবে না। যে কোনো পাপের ক্ষেত্রেই এটা হয়। যে পাপ থেকে আপনি সবসময় দূরে থাকেন, এড়িয়ে চলেন, একদিন কোনো ভাবে বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে যদি সেটা করে ফেলেন, তাহলে আগের মতো সে পাপ কাজটির প্রতি আর ঘৃণা থাকবে না। ভেতরের সুস্থ বিবেকটাও আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়বে। বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তার আর থাকবে না।
অনুরূপভাবে, আপনি একটি কাজকে নিষিদ্ধ বলে জানেন। একটি দিনের জন্যও যদি সেটি আপনার কাছে বৈধ বলে মনে হয়, আপনি যদি সেটা সেই একদিনই করে যান নির্দ্বিধায়, তাহলে তার নিষিদ্ধতা আপনার কাছে হালকা হয়ে যাবে। সেটা তখন করাটা আপনার কাছে অতটা জঘন্য মনে হবে না।
এ্যাডিকশন/ নেশার শুরুটা কিন্তু এভাবেই হয়। বন্ধুর হলুদের রাতে এক চুমুক, এরপর থার্টিফাস্ট নাইটে আরেক চুমুক… ব্যস… আস্তে আস্তে এ্যাডিক্টেড। প্রতিটি নেশাগ্রস্থ মানুষই কিন্তু প্রথম জীবনে নেশাকে ঘৃণা করে থাকে। কেউই কিন্ত জন্মগত এ্যাডিক্টেড নয়।
পরিশেষে কথা হলো, ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, মিথ্যা বলা ও ধোকা দেওয়া কোনো মুসলমানের, বরং, কোনো সুস্থ মানুষেরই কাজ হতে পারে না। তা সিরিয়াসলি হোক বা ঠাট্টাচ্ছলে হোক।
অতএব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই এর থেকে বিরত থাকা উচিৎ। তাই আসুন সবাই এপ্রিল ফুলকে ‘না’ বলি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
collected: Mufti Yousuf Sultan
বিষয়: বিবিধ
১১৪০ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্বাগতম আপনাকে টুডেব্লগে
মন্তব্য করতে লগইন করুন