সাবধান: এবার টার্গেট মোবাইল ফোন গ্রাহকরা!!
লিখেছেন লিখেছেন আইন যতো আইন ০৮ এপ্রিল, ২০১৪, ০৪:৫৭:১৫ বিকাল
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সাইবার অপরাধের সীমা বিস্তৃত হয়ে ঢুকে পড়ছে মোবাইল ফোনে। বিশেষ করে মোবাইল ইন্টারনেট এবং মোবাইল ব্যাংকিং সাইবার হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকের অনলাইন অ্যাকাউন্ট জালিয়াতির ঘটনা, সিম কার্ড ক্লোনিংয়ের মতো অপরাধের আলামতও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ঘটনায়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সিমকার্ড ক্লোনিং বড় সমস্যায় পরিণত হলেও বাংলাদেশে ঘটনাটি এখনও নতুন। ফলে নিভৃতে কিছু ঘটনা ঘটলেও সেগুলো সংশ্লিষ্ট অপারেটর, কর্তৃপক্ষের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষের জানার বাইরে থাকলেও বাংলা ভাষায় সিম কার্ড ক্লোনিং, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের বিস্তারিত টিউটোরিয়ালও একাধিক সাইটে দেখা গেছে। হ্যাকিং ট্রেনিং সহজলভ্য হলেও এ ধরনের অপরাধ থেকে রক্ষার জন্য সরকারিভাবে কার্যকর উদ্যোগ নেই। সমন্বিত সাইবার অপরাধ আইন দেশে নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে অপরাধের ঢালাও সংজ্ঞার কারণে এ আইনের রাজনৈতিক ব্যবহার ছাড়া অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকাও রাখতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার অপরাধের নতুন মাত্রা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা কিংবা অপরাধের শিকার হলে প্রতিকারের উপায় যেমন রাখা হচ্ছে না, তেমনি ৫০ বছর আগে যে বিষয়গুলো ফৌজদারি আইন থেকে পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোকে দেশের আইনে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখিয়ে আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগের সুযোগ রাখা হচ্ছে বেশি। সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত একটি
সেমিনারে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে সাইবার অপরাধের মাত্রা গত এক বছরেই দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অপরাধীদের কারিগরি দক্ষতার চেয়ে পুলিশের দক্ষতার অভাবের কারণে এসব অপরাধ মোকাবেলার ক্ষেত্রে পুলিশকেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে বলেও বাংলাদেশ পুলিশ আয়োজিত ওই সেমিনারে উল্লেখ করা হয়। সেমিনারে সাইবার অপরাধ হিসেবে যেসব উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে তার প্রায় সবই অনলাইনে বিকৃত ছবি, ভুয়া তথ্য কিংবা অশ্লীল ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ঘটনা। বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ বলতে এখন পর্যন্ত পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল ছবি, ভিডিওর মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ঘটনাকেই বোঝানো হয়। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবে অপরাধের মাত্রা আরও নতুন ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে। এখন অপরাধীদের টার্গেট মোবাইল ফোন, মোবাইল ইন্টারনেট এবং মোবাইল ব্যাংকিং। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম ইউনিয়ন (আইটিইউ) সাইবার অপরাধের সংজ্ঞায় মোবাইল ফোন এবং মোবাইল ইন্টারনেটকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন হ্যাকিং এবং সিম ক্লোনিংয়েরও আলামত পাওয়া গেছে। প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, মোবাইল ফোন এখন অনলাইন কার্যক্রমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সে কারণে অনলাইন অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনাগুলোও সাইবার অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে সরকারিভাবে এই বিষয়টি এখন পর্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে না। অপরাধ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে তখন এটি রোধ করা দুঃসাধ্য হবে।
মোবাইল ফোনে জালিয়াতির কয়েকটি চিত্র :২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রকিবুল হাসানের বাংলালিংক নম্বরে একটি ফ্লেক্সিলোড আসে যার পরিমাণ ২৯ টাকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে জানানো হয়, ভুল করে তার ফোনে টাকা চলে গেছে, টাকা যেন ফেরত দেওয়া হয়। তিনি টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ পর বাসা থেকে বের হন। এরপর তার মোবাইলে দুটি মিসড কল আসে পর পর। তিনি ওই নম্বরে ফোন ব্যাক করে টাকা ফেরত দিচ্ছেন বলে জানান। এই কল ব্যাক করার পর তিনি টের পান তার ফোন থেকে আর কোনো আউটগোয়িং কল হচ্ছে না। ফোন রিস্টার্ট করার পর স্ক্রিনে লেখা দেখতে পান, সিম আনরেজিস্টার্ড। পরে তিনি তার ই-মেইল অ্যাকাউন্ট খুলতে গিয়ে দেখেন, অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডও পরিবর্তন হয়ে গেছে। তিনি বিষয়টি বাংলালিংককে জানালে ফোনের মাধ্যমে কোনো ব্যাংকিং লেনদেন করলে সেই ব্যাংকের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করতে বলা হয়। ব্যাংকের গ্রাহকসেবা শাখায় যোগাযোগ করলে দ্রুত তার ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বন্ধ করতে বলা হয়। ব্যাংকে একদিন পর গিয়ে দেখেন তার অ্যাকাউন্ট থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৩৩ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র।
টেলিটকের একটি থ্রিজি মডেম কিনে সঙ্গে একটি সিমকার্ড পাওয়া যায় ফ্রি। সিম কার্ডটি আগে থেকেই চালু করা ছিল। ব্যবহারকারী গত ৫ মার্চ ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার জন্য রিচার্জ করার পর দেখতে পান তার অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো কারণ ছাড়াই ব্যালান্স কমে যাচ্ছে। পরে টেলিটকের গ্রাহক শাখায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এই নম্বর থেকে ইন্টারন্যাশনাল মেসেজ যাচ্ছে। পরে তিনি তার নম্বরের সিডিআর রিপোর্ট সংগ্রহ করে দেখেন, তার পরিচিত লোকাল নম্বরের বাইরে একাধিক মেসেজ গেছে বিদেশে। কীভাবে বিদেশে মেসেজ গেল, তার সদুত্তর মেলেনি। সম্প্রতি +২ দিয়ে শুরু নম্বর থেকে ফোন করে প্রতারণার ঘটনাও ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই নম্বরে ফোন ব্যাক করলেই ফোন নম্বরটি থেকে দ্রুত ব্যালান্স কমতে থাকে।
প্রায় দেড় বছর আগে ২০১২ সালে গ্রামীণ ফোনের একটি সিমকার্ড কেনা হয়েছিল তেজগাঁওয়ের একটি দোকান থেকে। নম্বরটি চালু করার পর অসংখ্য অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসতে থাকে। পরে দেখা যায়, নম্বরটি পুরনো ঢাকার দোকান থেকে আরও একজন আগেই কিনেছেন এবং তিনি ব্যবহার করছেন। একই নম্বর দুটি সিমকার্ডে ব্যবহারকেই বলা হয় সিম কার্ড ক্লোনিং। ২০১২ সালের শুরুতে ভারতীয় এয়ারটেল ভারতে প্রায় দেড় লাখ সিম কার্ড এভাবে ক্লোনিংয়ের ঘটনার প্রমাণ পাওয়ার পর সেগুলো বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত বিটিআরসি কিংবা মোবাইল ফোন অপারেটর কর্তৃপক্ষের আমলে নেই। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দুটি ওয়েবসাইটে সিম কার্ড ক্লোনিং কীভাবে করতে হয়, কোন কোন সফটওয়্যার প্রয়োজন তার বিস্তারিত টিউটোরিয়াল দেওয়া আছে। http://www.pchelplinebd.com/archives/71658 এবং http://www.techtunes.com.bd/news/tune-id/253423 দুটি লিংকে টিউটোরিয়ালের সঙ্গে লেখক ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, 'এটি শুধু ক্লোনিং শেখানোর জন্য, কেউ এটি শিখে অপরাধ করলে লেখক দায়ী নয়।'
সম্প্রতি সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম ট্রেড মাইক্রোর একটি গবেষণা প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়, চীনে মোবাইল ইন্টারনেটের জন্য ব্যবহৃত স্মার্ট ফোন এবং জিএসএম মডেম হ্যাক করার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। চীনের ৮১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং তারাই সাইবার অপরাধীদের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। ভুয়া অ্যানড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের লোভ দেখিয়ে ফোন ব্যবহারকারীকে ফাঁদে ফেলে তার সিম ক্লোনিং করে একই নম্বর যেমন মেসেজ পাঠানো এবং কল করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে, তেমনি গ্রাহকের ই-মেইল পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ড, পিন নম্বর প্রভৃতি হ্যাক করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় তাইওয়ান ও চীনের একটি সংঘবদ্ধ ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতচক্র ধরা পড়ে যারা প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ছিল চীন ও তাইওয়ান থেকে।
আইনগত দুর্বলতায় অপরাধীরা পার পাচ্ছে :বাংলাদেশে সমন্বিত সাইবার অপরাধ আইন নেই। বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে সাইবার অপরাধ দমনের বিষয়টি এসেছে। যেমন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি আইন। এসব আইন সম্পর্কে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার প্রয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে। এই ধারায় অপরাধ এবং অপরাধের হুমকি বা আশঙ্কাকে এক করে একই শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ কারণে এ আইন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং এর রাজনৈতিক ব্যবহার ছাড়া এ আইনে সত্যিকারের অপরাধ দমনও সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, মানসিক কষ্ট কিংবা অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার যে বিষয়গুলো এ ধারায় আছে, সে ধরনের বিষয়গুলো সভ্য দুনিয়ায় আরও ৫০ বছর আগেই ফৌজদারি আইন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ এখানে সেই পশ্চাৎমুখী আইনই প্রণয়ন করা হচ্ছে অপরাধের ঢালাও সংজ্ঞা দিয়ে। ফলে এখানে অনেক আইনই কার্যকর হয় না। প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার বলেন, সুনির্দিষ্টভাবে সাইবার অপরাধকে চিহ্নিত করে একটি কার্যকর সাইবার অপরাধ আইন হওয়া উচিত এবং অপরাধ মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা উচিত।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১৪৪১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সহমত
মন্তব্য করতে লগইন করুন