প্রকৃতির পাঠশালা
লিখেছেন লিখেছেন সিংহ শাবক ০২ জুন, ২০১৪, ০৪:৪৫:২৩ রাত
ইংরেজী বছর শুরু হয় জানুয়ারী দিয়ে । আরবী শুরু হয় মহররম আর বাংলা শুরু হয় বৈশাখ দিয়ে। অন্যান্য জাতি যখন নতুন বছরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে, পুরাতনকে ঝেড়ে ফেলে নতুনকে আলিঙ্গন করে নতুন একটি ভোরের প্রত্যাশায় বুক বাঁধে ঠিক তখন আমরা আমাদের নতুন বছর বরণ করি ভয়ংকর কালবৈশাখী ঝড়ের মধ্য দিয়ে । আমরা আশংকায় থাকি আমাদের সাজানো ঘর কোন এক কালবৈশাখীর ঝড়ে ভাংবে কিনা। বৈশাখের আচমকা ঝড়ঝঞ্চায় ঘরের পুরনো খুঁটি বদলে নতুন খুঁটি লাগিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করি । এমন ভয়ংকর কালবৈশাখীর সাথে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের বছর শুরু হয় বলেই কি আমরা এত অসহিষ্ণু ? এই জন্যই কি আমরা পরস্পরে মারামারি, হানাহানি ও রক্তপাত পছন্দ করি? এই জন্যই কি আমার কাছে আমার ভাইয়ের জীবনের নিরাপত্তা নেই ? আমার বোনের ইজ্জতের কোন নিরাপত্তা নেই ? এই জন্যই কি কালবৈশাখীর ঝড় আর ছেলে হারা মায়ের চোখের নোনা জল একাকার হয়ে যায় ? এই জন্যই কি কালবৈশাখীর গগণ বিদারী নিনাদে স্বজন হারার আর্তনাদ অদৃশ্যে মিলিয়ে যায় ?
কিন্তু আমাদের কাছে তো আরো ৫টি ঋতু আছে । ঝুম বরষায় তাপিত ধরণীতে আসে এক পশলা শান্তির পরশ । বর্ষার কালো মেঘের ভেলায় চড়ে, শুভ্র কাশের আঁচল উড়িয়ে, কন্ঠে শেফালী ফুলের মালা ঝুলিয়ে শরত আসে প্রকৃতি জুড়ে। মাঠে মাঠে চির সবুজ ধান ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য। ধানের শীষে আগামী দিনের ফসলের মুকুল । পানিতে ফোঁটা শাপলা পদ্ম, ডাঙ্গায় ফোঁটা শিউলি জুঁই প্রকৃতিকে সাজায় রূপ ও মাধুর্যে । বৃষ্টি ধৌত নির্মল প্রকৃতি ও গাছের পাতায় শরতের স্বচ্ছ সূর্য কিরন পড়ে চারিদিকে ঝলমল করে । নীল আকাশে সূর্য আপন কিরনজাল বিস্তার করে মাঠ ঘাটকে করে স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল ও মোহময় । কোন ঋতুই স্থায়ী নয় ।শরতের পরে আসে হেমন্ত । হেমন্তে সারাদিন ধরে চলে মিষ্টি মায়াবী আলোর খেলা। আকাশে আলো, বাতাসে আলো। এ আলো গ্রীষ্মের খর রৌদ্রতপ্ত আলো নয়, বরং এ আলো অতি মনোরম মনপ্রাণে আশা জাগানিয়ার আলো। হেমন্তে সন্ধ্যার গোধূলীর লাল আভা গোটা পশ্চিম আকাশ জুড়ে খেলা করে। হেমন্তে বিস্তীর্ণ সোনালী ধান ক্ষেত দেখে আমাদের প্রাণে এক অন্য রকম ভালো লাগা দোলা দেয় । এরপর শীত আসে একটু রুক্ষতা নিয়ে। গাছ গাছালী হয়ে পড়ে পত্র পল্লবহীন । শুষ্কতার ছোবলে প্রকৃতি হাহাকার করে উঠে । তবুও শীতের সকালের কাঁচা রোদের মিষ্টি আমেজ মানুষকে অনেক আনন্দ দেয়। অতঃপর ঋতু রাজ বসন্তে ডালে ডালে ফুল পাখির আগমনে প্রকৃতি নতুন করে সাজে । ফুল বাগিচার নব যৌবন প্রাপ্ত সুন্দরী ফুলেদের আগমনে প্রকৃতি নতুন রূপে রূপবতী হয়ে উঠে ।
আমাদের ছয়টি ঋতুর শুরুতে কালবৈশাখীর ভয়ংকর ছোবলে আমাদের সোনার সংসার হয়ত ভাঙ্গে কিন্তু এটাকে নেতিবাচক নয়, বরং ইতিবাচক হিসেবে যদি ধরি তবে আমরা দেখব ঋতুর শুরুতে প্রকৃতির কঠিন বাস্তবতা মানুষকে বাস্তববাদী আর কঠিন বিপদ মোকাবেলায় অভ্যস্ত করে তুলে । অতঃপর পরবর্তী ঋতুগুলো ঝড়ের দাপটে যা কিছু ধরা যায় সব খড়কুটো জাপটে ধরে বেঁচে থাকা নয় বরং তাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা তাকে উপহার দেয় । কালবৈশাখীর ঝড়ে যে সোনার সংসার ও ফসল ধ্বংস হল, জোষ্ঠ্যের কঠোরতায় যে যমিন ফেঁটে চৌ্চির হল বর্ষায় সে যমিন নব যৌবন লাভ করে। গর্ভবতী নববধু যেমন গর্ভধারনের প্রস্তুতি নেয় তেমনি বৃষ্টির পানি পেয়ে মরা যমিন ফসল ফলানোর প্রস্তুতি নেয় । এর মাধ্যমে প্রকৃতি আমাদের ভুল সংশোধনের শিক্ষা দেয় । গ্রীষ্মের কালবৈশাখী হয়ত ভুল করেছে কিন্তু বর্ষার আষাঢ় শ্রাবণ সে ভুল শুধরিয়ে তার ক্ষতি পূরণ দেয় । এমনি করে আমরা আমাদের ভুলগুলো শুধরিয়ে নিতে পারি । ভুল হলে তা স্বীকার করে তার ক্ষতি পূরণ দেয়ার শিক্ষা নিতে পারি । এর মাধ্যমে সৃষ্টি হবে পারস্পারিক আস্থা, বিশ্বাস ও ভ্রাতৃত্ববোধ । কালবৈশাখীর ভয়ংকর রূপ আর বর্ষার বিষণ্নতা পরিহার করে শরৎ আসে শান্ত স্নিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে, যেখানে নেই কোনো মলিনতা, আছে কেবল নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছ্বাস। শরতের পরিস্কার নীল আকাশে আমরা ভাসতে পারি সাদা মেঘের ভেলায় । যে আকাশে উড়ে মানুষের স্বপ্নের একঝাঁক নীল পায়রা । এমনি ভাবে শরত আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলে । নতুন উদ্দ্যমে নতুন কিছু করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। অতঃপর আসে হেমন্ত। হেমন্তে ভূমি পানি থেকে জেগে ওঠে। নতুন করে আবার ফসল বোনার কাজ শুরু হয়। উর্বর থাকে সতেজ ভুমি। ফসল কাটার উৎসবে মেতে ওঠে সব গ্রাম। এ ঋতু আমাদের শেখায় সহনশীলতা , সহৃদয়তা, কোন কিছু পাওয়ার আনন্দ । পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা না হয়ে বরং তার সঠিক ব্যবহার এবং সামনের দিনে নতুনকে নিয়ে কিভাবে পথ চলতে হবে তার শিক্ষা দেয় । এরপর আসে শীতকাল । শীতে গাছে পাতা থাকে না । পাতা পল্লবহীন গাছকে দেখতে যেমন বেমানান লাগে তেমনি আমরা তখন আমাদের সমাজের দিকে তাকাতে পারি । ভ্রাতৃত্ববোধ, ন্যায়পরায়নতা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিহীন একটি সমাজকে দেখতে কেমন দেখায় !!! সর্বশেষ বসন্ত কাল প্রকৃতিকে ফুলে ফলে সুশোভিত করার মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ এবং একটি পরিপূর্ণ সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের শিক্ষা দেয় । প্রকৃতিই নাকি মানুষের সবচেয়ে বড় পাঠশালা। কোন এক সময় যখন পৃথিবীতে আইন বলতে কিছু ছিল না তখন মানুষ এই প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করত । রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রূশো মনে করতেন, “মানুষ প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়েই এক সময় সংঘবদ্ধ ও সুশৃংখল জীবন যাপন করত। সে সময় প্রকৃতির রাজ্য ছিল পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্যের ন্যায়।” তাই পৃথিবীর এই মহান পাঠশালায় আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে । আমরা কি প্রকৃতির এই মহান শিক্ষাকে গ্রহন করে নিজেকে গঠন এবং একটি নতুন শান্তিপূর্ণ কল্যাণ সমাজ বিনির্মানের স্বপ্ন দেখতে পারি না ?
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অবশ্যই পারি ? কেন নয় ?
তবে এর জন্যে আগে আপনাকে-আমাকে এগিয়ে আসতে হবে । কি তাই নয় কি ? ভাইয়া ?
সুন্দর পোস্ট । তবে ভাবগম্ভীর । ধন্যবাদ ।
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ সুন্দর পোস্ট দেয়ার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন