ইসলামী আন্দোলনে আবেগ নয় বরং বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করা উচিৎ
লিখেছেন লিখেছেন সিংহ শাবক ০১ মে, ২০১৪, ১২:৩৪:২৩ দুপুর
সম্প্রতি মিশরের আদালত মুরসিপন্থী ৬৮৯জনকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে । এটি অত্যন্ত দুঃখ্যজনক। কেননা মাত্র ১২ মিনিট শুনানী করে এতজন আসামীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । এ ঘৃণ্য রায়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং হোয়াইট হাউস বলেছে তারা এ রায়ে বিব্রত। আর আমরা বাংলাদেশী ইসলামপন্থীরাও এর তীব্র নিন্দা জানাই । যদিও আমাদের নিন্দা জানানোয় কিছু আসে যায় না তবুও আমাদের অনেকেই ফেসবুকসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে নানা আবেগপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন । নেতৃবৃন্দও তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের হৃদয় নিংরানো আবেগ প্রকাশ করছেন । আমি সকলের আবেগকে সম্মান করছি।
“#৫২৯ কিংবা #৬৮৩ নয় বরং লক্ষ লক্ষ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের হত্যা করা হলেও পৃথিবী থেকে ইসলামকে মুছে ফেলা যাবে না …………”
এমন কথা গুলো বলে হয়ত সাময়িক ভাবে সবর করা যায়, আন্দোলনের কর্মীদের সাময়িক সান্তনা দেয়া সম্ভব কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, আর তা হল কেন এই বিপর্যয় ???
ফিলিস্তিনে এত বছর যাবৎ হাজার হাজার মুসলমান মারা যাচ্ছে কিন্তু এর আল্টিমেট ফলাফল কি ……???
আলজেরিয়ায় ১৯৯২ সালে ইসলামপন্থীদের উপর যে নির্মম ক্রেকডাউন চালানো হয়েছিল ২৪ বছর পর বর্তমানে তার ফলাফল কি ……???
মিশরের ইখওয়ানের অতীত বাদ দিলে গত বছরের মে থেকে এই পর্যন্ত সাড়ে নয় হাজার কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে , এর শেষ কোথায়……???
ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ আন্দোলনে সিপাহী বিদ্রোহসহ সকল ধরনের স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল মুসলমানরা । হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল , ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক আজও তার সাক্ষী । ভারত আজ স্বাধীন কিন্তু সেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু ! মুসলমানদের জন্য যে পাকিস্তান দেয়া হয়েছিলো তাও আজ পূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, কিন্তু কেন ……???
এমন উদাহরণ আরো অনেক দেয়া যাবে । এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কি হতে পারে ! নেতৃবৃন্দ হয়ত বলবেন, ইসলামী আন্দোলনের পথ কাঁটায় ভরা ফুল বিছানো নয় । যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের উপর নির্যাতন হয়েছে , রাসূল (স) তিন বছর শিয়াবে আবু তালিবে জেল খেটেছেন, বুকে পাথর বেধে ক্ষুধায় কষ্ট করেছেন , ওহুদের ময়দানে রাসূলের দাঁত মোবারক শহীদ হয়েছে, তায়েফে রক্ত দিয়েছেন, সাহাবীরা কত কষ্ট করেছেন । সুতরাং এই অত্যাচার নির্যাতন ইসলামী আন্দোলনের চরম বাস্তবতা। ইসলামী আন্দোলনে নির্যাতন আসবে এটাই স্বাভাবিক আমি এর বিরোধিতা করছিনা । কিন্তু শুধুমাত্র আবেগ দিয়েই কি সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ঠিক, সেক্ষেত্রে আবেগ ও বাস্তবতার সমন্বয় করেই কি এগিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় ?
আমি বলছি না যে নেতৃবৃন্দের ভুল সিদ্ধান্তের কারনেই এমনটি হচ্ছে । বরং নেতৃবৃন্দ তাদের সাধ্য অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন । এমনকি এত প্রতিকূল অবস্থাতেও বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যে দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে । তবে সে কাজ গুলো আরো চিন্তাশীল ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া জরূরী । একটি সমাজ বিপ্লব করতে হলে এমন প্রক্রিয়ায় আগ্রসর হওয়া উচিৎ যে প্রক্রিয়ায় সামগ্রিক ভাবে একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগ করে খুব সহজেই ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় । এখানে অর্থনৈ্তিক, রাজনৈ্তিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক, গণমাধ্যম সহ নানা বিষয় গুলোর দিকে খেয়াল রাখা দরকার । সেক্টর ভিত্তিক কাজের চেয়ে যদি রাজপথমূখী কাজের দিকে নজর বেশী দেয়া হয় তবে আন্দোলনের স্বাভাবিক গতিধারায় ভাটা পরতে পারে । কেননা রাজপথের আন্দোলনে বাহ্যিক ক্ষতিটা অনেক বেশী , ফলে আন্দোলনের কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে আর তখনই নেতৃবৃন্দকে আবেগের আশ্রয় নিতে হয় । আমি কখনই রাজপথের আন্দোলনের বিরোধি নই, যখন অস্তিত্বের সংকট হবে তখন অবশ্যই রাজপথে নামতে হবে কিন্তু দুটি কাজের সমন্বয় না হলে ইসলামী আন্দোলন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলবে এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে । চরম বিপর্যয়ের মুখেও কর্মীদের নির্মম নির্যাতন সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না ।
তুরস্কের ফেতহুল্লাহ গুলেনকে আমরা অনেকেই খারাপ চোখে দেখি । যদিও তার বর্তমান আচরণ অনেক প্রশ্নবিদ্ধ । তারপরেও বলছি তিনি যে কাজগুলো করেছেন সে কাজ গুলো মূলত একটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের জন্য শক্তি প্রয়োগের পূর্বে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার তার জন্য সহায়ক । তুরস্কের অধিকাংশ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া হিজমাত পার্টির দখলে । আর তাই একে পার্টির প্রধান তথা তুর্কী প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাতেও তাঁর বেগ পেতে হয়নি । আমি বলছিনা গুলেনের সকল চিন্তা সঠিক কিন্তু এগুলো কি ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক নয় ?
ইখওয়ানুল মুসলিমিন, জামায়াতে ইসলামী, আন্নাহদা, আলজেরিয়ার ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট সহ সারা বিশ্বের যত মূল ধারার ইসলামি সংগঠন রয়েছে তাদের উচিৎ হবে কোন আবেগ তাড়িত সিদ্ধান্ত নয় বরং সব কিছুর সমন্বয়ের মাধ্যমে আল কুরআন এবং রাসূলের গোটা ২৩ বৎসরের আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া । সকল সমস্যাকে বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করা এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া ।
মিশরে ১৯২৮ সালে ইখওয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রায় ৮৪ বছর পর তারা ক্ষমতার গিয়েছিল । কিন্তু এক বছরের মাথায় তাদের বেদনাদায়ক পতন হয় । প্রায় সাড়ে নয় হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয় , দলের প্রধানসহ প্রথমে ৫২৯জন এবং সর্বশেষ ৬৮৩জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় । এখনো প্রতিদিন তাদের রাজপথের আন্দোলনে অসংখ্য কর্মী মারা যাচ্ছে । এসব ঘটনায় আমরা কি ইখওয়ানকে ব্যর্থ বলতে পারি ? ৮৪ বছর যাবৎ যে সংগঠন সংগ্রাম করে টিকে আছে তাদের আমরা একেবারে ব্যর্থও বলতে পারি না । তবে এতটুকু বলা যেতে পারে তাদের সার্বিক কর্মপরিকল্পনায় আরো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হলে ভালো হত । মিশরে এত বছর যাবৎ সেনাবাহিনীর শাসন, দেশের সার্বিক বিষয়ে সেনাবাহিনীই প্রধান হর্তা কর্তা । সুতরাং ‘সেনাবাহিনী’ সে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা, আর তাই ইখওয়ানকে এই দিকটার প্রতি খুব বেশী করে গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল । এখানে তারা ব্যর্থ না সফল সে বিষয়ে আমরা মন্তব্য করতে চাই না । ঠিক একই ভাবে মিডিয়া, প্রশাসন, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগের সকল শাখা, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈ্তিকসহ রাষ্ট্র পরিচালনার সকল পর্যায়ে এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইখওয়ান যে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি সেই জায়গাগুলোতে তারা কতটুকু কাজ করতে সক্ষম হয়েছে এটাই এখন পর্যালোচনার বিষয় ।
ঠিক একই কথা জামায়াতে ইসলামী সহ বিশ্বের অন্যান্য সকল ইসলামী সংগঠনের প্রতি । একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে জামায়াতে ইসলামী দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি । সুতরাং জামায়াতকে দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে খুবই সচেতন হতে হবে । সাময়িক বিপর্যয়ে শুধুমাত্র ত্যাগ-কুরবাণীর বক্তব্য না দিয়ে বিশ্বের বড় বড় ইসলামিক মুভমেন্টের উত্থান পতন থেকে শিক্ষা নিতে হবে । তবে “এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না”, আর এই জায়গায় যদি জামায়াত সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে তাহলে তাদের শুধু রাজপথে রক্ত দেয়া এবং চরম নির্যাতন ভোগ করা ছাড়া কোন উপায় থাকবে না ।
সুতরাং এই ইসলামী সংগঠন গুলো যখন তাদের নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে পারবে এবং ঐ রাষ্ট্র গুলো যখন একই আদর্শের ভিত্তিতে গোটা বিশ্বে একটি শক্তি অর্জন করতে পারবে ঠিক তখনই কেবল মুসলিম জাতির সুদিন ফিরবে । আর এ জন্যই বর্তমানে বিশ্বের সকল ইসলামী নেতৃবৃন্দকে অনেক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হবে । ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার মাধ্যমেই ইসলামী আন্দোলনের আগামীর কর্মপন্থা নির্ধারন করতে হবে । অন্যথায় মুসলিম জাতির আকাশে যে দূর্যোগের কালো মেঘ জমেছে তা অচিরেই ভয়ংকর কালবৈশাখীর রূপ নিয়ে জাতির উপর আচড়ে পড়তে পারে । তখন আফসোস করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না ……।।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮১ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তাই আপনার সাথে একমত আমাদের মুসলমানদেরকে এই পরিস্থিতি মুকাবলিা করার জন্য নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন ও সুদুর পসারী পরিকল্পনা করতে হবে।
ইমাম মালেক (র)এর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে যে,এই উম্মতের পরবর্তী যামানার সমস্যার সমাধান একমাত্র ঐ পথেই হতে পারে যে পথে প্রথম যামানার সমস্যার সমাধান হয়েছিল।
অনেকে ভুল বুঝায়,দ্বীন ক্বায়েম মানে রাষ্ট্র দখল। দেশের বেশীরভাগ মানুষের ভোট যদি পাওয়া যায়ও তারপরেও দেখা যাবে অধিকাংশ মানুষ হয়তো নামযই পড়ে না ঠিকমত,দন্ডবিধান কার উপর ক্বায়েম করবেন ?
আমি পাচ ওয়াক্ত নামায পড়ব,শির্ক বিদা'ত থেকে দুরে থাকব,হালাল হারাম মেনে চলব,যতটুকু আল্লাহ আমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন (আমার পরিবার)তার মধ্যে শরিয়তের বিধান ক্বায়েম করব। তাহলে কি আমি আমার জীবনে দ্বীন ক্বায়েম করলাম না ?
এভাবেই মুসলিমদের অধিকাংশ লোক যদি নিজে ঠিক হয় আর তার পরিবার ঠিক করে তাহলেই একটা ইসলামী সমাজ তৈরী হবে তার ফলশ্রূতিতে একটা ইসলামী রাষ্ট্র তৈরী হবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন