আমার দেখা থাইল্যান্ড
লিখেছেন লিখেছেন টুটুল মাহমুদ ১৮ মে, ২০১৪, ০২:০২:৪৪ দুপুর
২০১২ সাল। ঈদের নামায পড়ে বাসায় ফিরেছি। শেষ বেলার প্রস্তুতি দেখে নিলাম। একটু পরেই রওনা দিব এয়ারপোর্ট। ১ টা ৩০ মিনিটে থাই এয়ারলাইন্সে থাইল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা দিব আমি আর আমার বউ। উদ্দ্যেশ্য শুধুই দেখা। এটা ছিল প্রথমবার থাইল্যান্ড ভ্রমন। এরপর অবশ্য আরো যাওয়া হয়েছে।
আমার বউ সিলভী মোটামুটি মাস খানিক ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। অফিস থেকে ফিরেই দেখি ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। সমস্যা কি? না না, এই দেখো এইটা এইটা দেখতে যাব। এই হোটেল টা সুন্দর। সুন্দর কোন দিক থেকে? এর আশ পাশ দিয়ে সব মার্কেট। অনেক সুবিধা হবে। এইবার বুঝলাম সুন্দরের শানে নুজুল। বললাম তুমি কি মার্কেট দেখতে যাচ্ছো নাকি থাইল্যান্ড দেখতে যাচ্ছো? উত্তর দিল, একই কথা, এই মার্কেট গুলোকি তোমার থাইল্যান্ডের বাইরে? নাহ, কথা সত্য। কিন্তু সেদিন থেকেই মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে আল্লাহ জানে, বউ আমার কোন পর্যায় ফাঁসাবে।
আমি যে ধরনের চাকুরী করি তাতে সারা বছর প্রায় ছুটি নাই। দুই ঈদে ৭ দিন করে দুইটা ছুটি পাই। যার কারনে ঈদের সময়টা বেছে নিতে হলো ট্যুরের জন্যে। ৭দিনের সাথে আরো একটা দিন যোগ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ঘুরতে যাবার। নিজে নিজে ভিসা করিয়েছি, থাই এয়ারের টিকিট কেটেছি তারপর সোজা যাত্রা দিয়েছি। কিছুই জানিনা, চিনিনা। আছে কিছু হোটেলের ঠিকানা। কি কি দেখার আছে বা সেখানে কিভাবে যেতে হয় সে নেট ঘেটে বের করেছে। তবে আমার মনে হয় কেউ যদি ট্যুরের উদ্দ্যেশ্যে যেতে চান তাহলে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়াই ভালো। এতে খরচও কম হবে আবার নিশ্চিন্তে ঘুরে আসতে পারবেন। আমরা নিজেদের মত করে যাওয়াতে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
একটু আগে আগে এয়ারপোর্ট যেয়ে বোর্ডিং পাসের জন্য লাইনে দাড়ালাম। বিশাল ভীড়। জীবিকার জন্য যারা বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে তাদের ভীড় বেশি। বোর্ডিং পাস দেবার লোকেরা দেখছি অনেকের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। পাসপোর্ট ভিসা টিকিট সব থাকার পরেও তারা জিজ্ঞেস করছে কি জন্য যাবেন? আরে বাবা এই প্রশ্ন করার তুমি কে? এইটা জিজ্ঞেস করবে সংশ্লিষ্ট দেশের দুতাবাস যারা ভিসা দিয়েছে! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে যদি জিগায় তাহলে বলব বাথরুম করতে যাব। আমার সিরিয়াল আসলে দেখলাম তেমন কিছুই বলল না। বোর্ডিং পাস দিয়ে দিল। তবে হাতে নিয়ে দেখি সিট দুজনের আলাদা দিয়েছে। আবার ফেরত দিয়ে ঘটনা জানতে চাইলাম। বলে আপনিতো আগে বলেননি। কতবড় বেয়াক্কেল হইলে এই কথা বলে! একসাথে দুইটা পাসপোর্ট দিয়ে আবার বলতে হবে আমরা দুজন একসাথে! ওদের উপর আগে থেকেই আমি বিরক্ত হয়ে আছি। এ জন্য উত্তরটা একটু বাকা করে দিলাম। বললাম ভাত খাবার সময় আপনি যে ডান হাত দিয়ে খান কারো তো সেটা বলতে হয়না। আমার দিকে চুপ করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার চেঞ্জ করে দিল।
ইমেগ্রেশনে এসে দেখি এখানেও বিশাল সিরিয়াল। ভাগ্যিস একটু আগে আগে এসেছিলাম। খুব ধীর গতিতে এক আংগুল দিয়ে আমাদের পুলিশ অফিসারেরা কম্পিউটার টিপতেছে। আমি নিশ্চিত একটু দেরি করে আসলে আমার বিমান চলে গেলেও তাদের ইমেগ্রেশন শেষ হইতো না। অবশেষে তাদের সামনে আসলাম। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল কোথায় যাবেন? অথচ তিনি আমার পাসপোর্ট খুলে আমার থাই ভিসার দিকে তাকিয়ে আছে। উত্তর দিলাম না, নিজে নিজে উত্তরটা নিয়ে আবার প্রশ্ন করলো কয়দিন থাকবেন? মর জ্বালা, তার হাতে কিন্তু আমার রিটার্ন টিকিট আছে!! বললাম আমার এটা অন ওয়ে টিকিট না, রিটার্ন টিকিট। আমার দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে টিকিটের ভাজ খুলল। মনে হচ্ছে তাকে দিয়ে আমি খাটিয়ে নিচ্ছি। উত্তরটা দিলে তাকে আর এই কষ্ট করতে হতনা। অথচ তিনি কিন্তু আমার টিকিটেও সিল মারবেন!
থাই এয়ারের নির্দিষ্ট সিটে বসে আছি। ব্যাংকক যাবার জন্য যতগুলো এয়ার লাইন্স আছে তার ভিতর থাই এয়ার সবচেয়ে ব্যায় বহুল। কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা কমে আপনি বিমান বাংলাদেশ বা রিজেন্ট এয়ারে যেতে পারবেন। তবে স্প্রিডে আপনি একটু পিছিয়ে থাকবেন। থাই এয়ার অন্যান্য এয়ার থেকে কম করে হলেও ১ ঘন্টা গতিতে এগিয়ে থাকে। তারপরেও আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্তদেরর জন্য ২০ হাজার টাকা অনেক কিছু। বউ এর পাল্লায় পড়ে আমাকে থাই এয়ারের টিকিট নিতে হয়েছে। অবশ্য আমাদের বিমানের ডিসি-১০ খাল বিলে ল্যান্ড করার ইতিহাসও, থাই এয়ারের টিকিট নিতে উৎসাহিত করেছিল। সেদিন দেখলাম রিজেন্ট এয়ার তাদের রাডার অকেজো থাকা অবস্থাতেও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট উড়িয়ে দিয়েছিল।
পিচ্চি পিচ্চি পুতুলের মত দেখতে থাই এয়ার হোষ্টেস ঘোরাফেরা করছে। পুতুলের মত বিশেষনটা অনেকের অপছন্দ হতে পারে। আসলে আমি বিমান বাংলাদেশে করে মালায়েশিয়া যাবার সময় দেখেছি খাস্তা স্বভাবের, মুখে মাস্তে পড়া মহিলারা সব এয়ার হোষ্টেস, মুখে অশুদ্ধ বাংলা ভাষা।
একটু পর ঘোষনা দেওয়া হল ফ্লাইয়ের কথা। এয়ার হোস্টেজরা দেখাতে থাকলো নিরাপত্তা ইস্যু গুলান। এক সময় উচুতে উঠতে থাকলো। জানালা দিয়ে উচু থেকে ঢাকা শহরকে সত্যি অস্বাধারন লাগছিল। হাতিরঝিলকে নিচে রেখে উড়ে চলল প্লেন। একসময় সব চোখের আড়ালে চলে গেল। প্লেন উপরে উঠছে, আরো উপরে। ৭হাজার ফিট থেকে ১৪ হাজার ফিট, ২০ হাজার ফিট শুধু উঠছে আর একটু পর পর ঘোষনা দিচ্ছে। একসময় উপরে উঠা বন্ধ হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে প্লেন এক যায়গায় স্থির হয়ে আছে। সবাই সিট বেল্ট খুলে ফেলল। এয়ার হোষ্টেস আর ক্রুরা লাঞ্চ দেবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
লাঞ্চ খাওয়া শুরু করবো এমন সময় বউ বাইরের দিকে ইশারা করলো। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একি দেখছি আমি!! এ যেন স্বপ্নপুরী। মনে হচ্ছে চারিদিকে বিশাল বিশাল কনক্রিটের মেঘের ইমারত। সব স্থির। এ যেন মেঘের রাজত্বে আমি অবস্থান করছি। সে কি রুপ তার....! আমার পক্ষে সম্ভব নয় সেই রুপের ব্যাখ্যা দেওয়া।
প্লেনে বসে নিচের থাইল্যান্ড
২ ঘন্টা ৩০ মিনিট পর ব্যাংকক এসে ল্যান্ড করেছি। বিশাল এয়ারপোর্ট। ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে ইমেগ্রেশন এলাকায় হেটে যেতে সময় লাগবে কমপক্ষে ৩০ মিনিট। আমরা গেলাম ১০ মিনিটে। প্যাসেঞ্জার স্পেজের মাঝ বরাবর ফ্লর এক্সেলেটর দেওয়া আছে। যার ইচ্ছা হেটে যেতে পারে আবার কেউ চাইলে ফ্লর এক্সেলেটরে দাড়ালে ফ্লর একাএকা চলতে শুরু করে। আমরা এর উপর দাড়িয়ে আছি অন্যদিকে আমি ভাবছি অন্যকথা। ইমেগ্রেশনে যদি আমার দেশের মত দেরি হয়ে যায় তাহলে বিপদে পড়ে যাব। সন্ধ্যা হতে চলল, এখান থেকে বের হয়ে রওনা দিতে হবে পাতায়ার দিকে। ঢাকা থেকে আসার সময় চিন্তা করে রেখেছিলাম ব্যাংকক থেকে বাসে পাতায়া যাব। ঘন্টা দুয়েক সময় লাগে বাসে করে পাতায়া যেতে। এই রাতে অপরিচিত পাতায়া শহরে যেয়ে হোটেল ঠিক করতে হবে। আগে থেকে হোটেল বুকিং দেওয়া হয়নি। নেট থেকে কিছু হোটেলের এড্রেস নিয়েছি। সেক্ষেত্রে ইমেগ্রেশন আমাদের দেশের মত হলে আসলেই বিপদে পড়বো। আশে পাশে তাকাচ্ছি আর আতংকিত বোধ করছি। এত মানুষ আর মানুষ, একটারপর একটা ফ্লাইট ল্যান্ড করছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আসছে। সবার ইমেগ্রেশন পয়েন্ট একই যায়গা। ওরে আল্লাহ ওরে আল্লাহ.., এর ভিতর ইমেগ্রেশন পয়েন্টে হাজির হলাম। চোখের পলকে হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাড়িয়ে পড়লো এবং চখের পলকে সব ফাকা হয়ে গেল। আমরাও পলকে পলকে বাইরে চলে এলাম। বের হবার আগে এয়ারপোর্ট থেকে ফ্রিতে ২০ বাথ ব্যালেন্স সহ দুইটা মোবাইলের সিম নিয়েছি। ট্যুরিষ্টদের জন্য ফ্রিতে দেওয়া হয়।
চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। পাতায়া যাবার বাস স্টপেজ কিভাবে যেতে হবে জানিনা, সেটা কোথায় এটাও জানিনা। কারও কাছে জিজ্ঞেস করবো তেমন কাওকে দেখছিনা। পর্যটক যারা এসেছে তাদের জন্য গাড়ি রেডি আছে। আসার আগে থেকেই এরা ব্যবস্থা করে এসেছে। এর ভিতর আমাদের পাশে চারজনের দুটি বাংলাদেশী পরিবার এসে দাড়ালো। কথা বলে জানতে পারলাম তারাও পাতায়া যাচ্ছে। ট্রাভেল এজেন্সি এশিয়ান হোলিডেজের মাধ্যমে প্যাকেজে এসেছে। তাদের নিতে মাইক্রো বাস আসছে। আমরা কি করতে পারি জানতে চাইলে একটি থাই মেয়েকে দেখিয়ে বলল তার সাথে কথা বলে দেখেন। সে আমাদের গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। তাকে যেয়ে বললাম আমরা পাতায়ার হোটেল ডিসকাভারি যেতে চাই, তুমি কোন সাহায্য করতে পারো কিনা? সে কি বুঝল আল্লাহ জানে। বলল আমি গাড়ি ঠিক করেছি হোটেল ব্রেভিলি প্লাজা পর্যন্ত, এখন তুমি অন্য হোটেলে যেতে চাইলে ড্রাইভারকে বেশি টাকা দিতে হবে। বললাম তুমি ড্রাইভারকে বলে দাও। সে কি কি যেন আলাপ করে জানালো আমাকে ২০০ বাথ দিতে হবে। থাই কারেন্সিকে বাথ বলে। আমাদের দেশের ২.৬৫ টাকা সমান তাদের এক বাথ। একটু অবাক হলাম। অনলি ২০০ বাথ!!! আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ঝটপট উঠে পড়লাম।
ঝড়ের বেগে ছুটে চলছে গাড়ি, ১৩০-১৫০ এর নিচে কাটা নামছে না। বিশাল ছয় লেনের রাস্তা। রাস্তা থেকে বেশি ফ্লাইওভার। ফ্লাইওভারের উপর ফ্লাইওভার। রাতের বেলা দিনের মত আলো। কোন রাস্তায় ক্রসিং সিগনাল নেই। একটা ক্রসিং আসলেই রাস্তা একটা উপর দিয়ে চলে গেছে আর একটা নিচ দিয়ে। মাইক্রো বাসে আমরা ছয় জন। আলাপে আলাপে পরিস্কার হল ২০০ বাথের ঘটনাটি। আসল বিষয় হলো ব্যাংকক থেকে পাতায়া যেতে ট্যাক্সির ভাড়া ১০০০ বাথ আর মাইক্রো বাসের ভাড়া ১৫০০ বাথ। ওই থাই মেয়েটি মনে করেছে আমরা ছয়জন একসাথে। কিন্তু আমি ব্রেভিলি প্লাজায় না যেয়ে অন্য হোটেলে যেতে চাই। যার কারনে ড্রাইভারের সাথে কথা বলে আমাদেরকে বলেছে তোমাকে অতিরিক্ত ২০০ বাথ দিতে হবে। ড্রাইভারও খুশি এইকারনে যে আমরা ব্রেভিলি প্লাজা থেকে হোটেল ডিসকাভারি যেতে চেয়েছি তার ভাড়া ১০০ বাথের বেশি না। কিন্তু আমরা ২০০ বাথেই রাজি হয়েছি ।
১ ঘন্টা ৩০ মিনিটে আমরা পাতায়ার ব্রেভিলি প্লাজা হোটেলে আসলাম। সবাই নেমে গেল কিন্তু আমরা গাড়িতে থেকে গেলাম। ট্রাভেল এজেন্সির পক্ষ থেকে তাদের একজন বাংলাদেশী রিসিভ করলো। তাকে বললাম, আমরা আপনাদের লোক না, আলাদাভাবে এসেছি। অন্য হোটেলে উঠবো। সে একটু অবাক হলো, আমাদের লোক না তাহলে আমাদের গাড়িতে কেন? সে বলল আমার নাম মানিক, আমার নাম্বারটা রাখতে পারেন। কোন দরকার হলে আমাকে ফোন দিয়েন। এখানে আমি সাত বছর ধরে আছি। নাম্বার নিয়ে বের হয়ে গেলাম ডিসকাভারী হোটেলের দিকে। একটা মোড় ঘুরেই গাড়ি আমাদের ডিসকাভারী হোটেলে ঢুকিয়ে দিল। এভাবে পর পর কয়েকটি হোটেলে গেলাম। কোথাও রুম ফাকা নেই। আসলে আমরা যে সময়টা গিয়েছি এটা ট্যুরিষ্টদের সিজন। ওদিকে রাত ৯টা বেজে গেছে। অবশেষে ঐ মানিককে ফোন দিয়ে আমাদের সমস্যার কথা বললাম। তিনি আমাদের ব্রেভিলি প্লাজা হোটেলে ফিরে আসতে বললেন। আমরা ঐ গাড়ি নিয়ে আবার এখানে ফিরে আসলাম। ভাড়া আমাদের কাছ থেকে ২০০ বাথই রেখেছিল। মানিক সাহেব আমাদের ফোর স্টার ইন্ডিয়ান হোটেল ব্রেভিলি প্লাজাতে ২০০০ বাথ ভাড়াতে রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন।
সময় নষ্ট করা যাবেনা, মাত্র তিন রাত চারদিন এখানে থাকবো। রুমে এসে ফ্রেস হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম রাতের খাবারের জন্য, খাবার শেষে বিচ এলাকায় যাবো। কোন রকম রাতের খাবার শেষ করে বিচ এলাকার দিকে হাটা দিলাম।
ব্রেভিলি প্লাজা থেকে বের হলেই সামনে শহরের প্রধান রাস্তা। এই রাস্তা ধরে ওই পাড়ে গেলে অনেক গলির মত সরু সরু রাস্তা ভিতর দিকে চলে গেলে। যেকোন একটা দিয়ে ঢুকলেই আপনি বিচ রোড পেয়ে যাবেন। বড় ছোট সব রাস্তার দুপাশ দিয়ে বিভিন্ন প্রকার দোকানপাট। সব চেয়ে বেশি দোকান হলো মাসেজিং এন্ড স্পা। থাই ফুট মাসেজ বিশ্ব বিখ্যাত। হাফ প্যান্টের চেয়ে ছোট ছোট প্যান্ট আর হাতা কাটা গ্যাঞ্জি পরিহিত মেয়েরা আপনাকে মাসেজ করে দিবে, যদি আপনি নিতে চান। মেয়েরা রাস্তার দুপাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ডাকতে থাকে। ফুট মাসেজ ২০০ বাথ আর যদি সারা শরীর মাসেজ নিতে চান তাহলে ৫০০ বাথ গুনতে হবে। গ্লাসে ঘেরা দোকানের দিকে তাকালে দেখা যায় আন্ডার ওয়ার পড়া সুপুরুষ (!) গুলো শুয়ে আছে আর থাই সুন্দরী একজন তাকে মাসেজ করে দিচ্ছে। এছাড়া আছে ফিস মাসেজ। আমাদের দেশের চেলা মাছের মত এক আংগুল সাইজের সরু টাইপের একধরনের মাছ কাচের জাড়ে রাখা আছে। জাড়ের পানিতে পা চুবিয়ে বসে থাকবেন। পা দেবার সাথে সাথে শখানেক মাছ আপনার পা কুট কুট করে কামড়াতে থাকবে। দিনের বেলা মেক্সিমাম দোকান আপনি বন্ধ পাবেন। বিকালের পর আস্তে আস্তে সব খোলা শুরু হয়। পাতায়াকে বলা হয় নাইট লাইফ। দিনের পাতায়া নির্জন নগরী। রাতের বেলা জীবন শুরু। সারা রাত মানুষ গিজগিজ করে। দিন যত এগিয়ে আসে মানুষ তত কমতে থাকে।
ওয়াকিং স্ট্রিটে আমি
হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা রাস্তা দিয়ে হাটা দিলাম। রাত ১০ টা বেজে গেছে এখনও খাওয়া হইনি, ব্যবস্থা করতে হবে। ম্যাসেজ সেন্টার দেখতে দেখতে কিছু দূর এসে একটি ইন্ডিয়ান হোটেল দেখতে পেলাম। আর খোঁজাখুঁজি না করে সেটাতেই ঢুকে পড়লাম। স্ট্রিম রাইস, সি-ফুড আর ডাল দিয়ে রাতের খাবার খেলাম। মাছের কারিটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব আছে। সিলভী বাড়তি কাচা মরিচ চেয়ে নিল। ও আবার ঝাল বেশি খাঁয়। ডালটা অনেক স্বাদ লাগলো। শুধু ডাল দিয়েই দুই প্লেট ভাত খাওয়া যায়। খাওয়া শেষ করে বের হয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলাম। কোন একটা গলি পেলেই ঢুকে পড়ব ভাবছি। আসতে আসতে চোখে পড়ল একটি সাইন বোর্ড, “ভিততে বাংলাদেশী হোটেল” আছে। পুরাপুরি বাংলায় লেখা। যায়গাটা দেখে রাখলাম, একবার ঘুরে আসা যাবে। সামনে একটা গলি পেয়ে ঢুকে পড়লাম। সোজা উঠলাম বিচ রোডে। রাস্তা পার হয়ে ঐ পাড়ে রাস্তা থেকে বড় ফুটপাথ, ফুট পাথ ঘেসে সৈকত। সম্পূর্ণ ফুটপাথে টাইলস বিছানো আর বড় বড় গাছের সারি। দুজন হাত ধরে গল্প গল্প করতে করতে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছি। ডানে তাকালেই সমুদ্রের পানি আর রংবেরঙের লাইটের ঝলকানি। ফুটপাথের উপরে প্রতিটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন করে নিশিকন্যারা। উদ্ভট সাজে পর্যটকদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আর একটু সামনে এসেই বড় করে একটা সাইন বোর্ড ঝুলতে দেখলাম। লেখা “ওয়েল কাম টু ওয়াকিং ষ্ট্রীট”, ঢুকে পড়লাম সেই এলাকার ভিতর। ঢোকার মুখেই পুলিশের ক্যাম্প বসানো, লেখা বিচ পুলিশ।
“ওয়াকিং ষ্ট্রীট” মুলত একটা রাস্তা, যেখান দিয়ে শুধুমাত্র হেঁটে চলাফেরা করা যায়। কোন বাহন চলতে পারবেনা। রাস্তাটা দীর্ঘ ১ কিঃমিঃ হবে। পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে আছে পুরা এলাকা। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের দোকানপাট ও বার সেন্টার। ওপেন বার গুলো থেকে লাইভ গানের সুর ভেসে আসছে এবং ছেলে মেয়েদের নাচানাচি চলছে। আমরা এক একটি দোকানের দিকে তাকাচ্ছি আর মজা দেখছি। দোকানের সামনে দিয়ে রাস্তায় হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। তাঁরা কাস্টমারদেরকে নিজেদের দোকানে নেবার চেষ্টা করছে। ওয়াকিং ষ্ট্রীটের শেষ মাথা পর্যন্ত হেঁটে ফিরে আসছি। সিলভীর পানি পিপাসা লেগেছে। কোন একটা ফাষ্ট ফুড জাতীয় দোকানে বসে ঠাণ্ডা কিছু খাওয়া যায় কিনা দেখতে বলছে। বার গুলো সব ওপেন কিন্তু ফাস্ট ফুডের দোকান গুলো গ্লাসে ঢাকা সাথে পর্দা টানা। রাস্তায় দাঁড়ানো মেয়েদের কাছে জিজ্ঞেস করে এই ধরনের একটি ফাষ্ট ফুডের সপে ঢুকলাম। ভিতরে আমাদের দেশের চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মত আলোর ব্যবস্থা। হটাত করে ঢুকলে তেমন একটা দেখা যায় না। ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়। আমাদের একজন পথ দেখিয়ে নিয়ে একটি সোফায় বসতে দিল। সামনে একটি স্টেজের মত প্লাটফর্ম আছে। এই স্টেজকে ঘিরে চারিদিকে বসার ব্যবস্থা। ভিতরে সাউন্ড বক্সে চলছে তুমুল গান। একটি মেয়ে চার্ট নিয়ে অর্ডার নিতে আসলো। শুধু সফট ড্রিংক্স চাইলাম। সে জানালো খুব উন্নত মানের হায়কেন বিয়ার বড় সাইজটার দাম ৮০ বাথ আর কোকের ক্যান ১১০ বাথ। তাহলে কেন আমি হায়কেন না নিয়ে কোক চেয়ে বোকামি করছি? একটু হেঁসে সিলভীকে দেখিয়ে বললাম সে বিয়ার খাঁয় না। মেয়েটি একটা হাঁসি দিয়ে কোক আনতে চলে গেল। অবাক হলাম অবস্থা দেখে, মদের থেকে পানির দাম বেশি। সামনে যে স্টেজ আছে তার চার কোনায় চারটা পাইপ উপরে উঠে গেছে। ঐ পাইপ চারটা ধরে চারটি মেয়ে বিভিন্ন ভঙ্গীতে গানের তালে নাচানাচি করছে। এখন আমার মনে পড়তে লাগলো থাই দুতাবাসের যে লোকটি দেশে থাকতে আমাদের ইন্টারভিয়্যু নিয়েছিল তার কথা। আমাদের ভিসা দেবার আগে দুতাবাসে আমাদের স্বশরীরে হাজির হতে হয়েছিল। ঐ সময় কথা প্রসঙ্গে লোকটি বলেছিল ফ্যামিলি ট্যুরের জন্য ফুকেট ভালো। কিন্তু এই সময় ফুকেট যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। ব্যাংকক থেকে বাসে ২২ ঘন্টার জার্নি। খরচ অত্যাধীক বেশি। অবশ্য এর পরের বছর আমি আবার ফুকেট গিয়েছি।
বিচ পয়েন্ট (দ্বিতীয়বার আমার কন্যা সাথে ছিল)
দুতাবাসের অফিসারের কথাটা তখন কিছু বুঝি নাই। দেশে থাকলেই জানতাম যত ট্যুরিষ্ট থাইল্যান্ড যায় সে অবশ্যই পাতায়া যায়। আর এখানে সে ফ্যামিলি ট্যুর নিরুৎসাহিত করছে!! পাতায়ার এই সপে বসে এখন বুঝতে পারছি কেন সে বলেছিল ফ্যামিলি ট্যুরের জন্য ফুকেট ভালো। আমাদের সামনে যে মেয়ে চারটা নাচানাচি করছে তাঁদের শরীরে কোন কাপড় নেই। কাপড় যে কিছুই নেই সেটা না, ডান হাতে একটি করে লাল কাপড়ের ব্যান্ড বাঁধা আছে। কাপড়ের স্পর্শ বলতে এটা। এতক্ষন আশে পাশে খেয়াল করা হয়নি। এবার ডানে বায়ে তাকিয়ে দেখি গেস্ট যারা আছে তাঁদের সবার কোলে একটা করে হাতে ব্যান্ড বাঁধা থাই মেয়ে বসে আছে। ইন্ডিয়ান গেস্ট গুলো একটি বেশি বাড়াবাড়ি করছে। কারও দিকে তাকানোর কারও সময় নেই। সিলভী বলে কই আইলাম? কোকের অর্ডার দিয়ে বের হয়েও যেতে পারিনা। এর ভিতর যে চারটি মেয়ে ষ্টেজে ছিল তাঁদের ভিতর থেকে একজন নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। সুন্দর করে বাও করার মত করে আমার পাশে বসার অনুমতি চাইলো। সিলভীকে দেখিয়ে তাকে বুঝাতে চাইলাম আমার সাথে আছে, তোমাকে লাগবে না। সে নাছোড়বান্দা। আমার পাশে বসবেই! দুজনকে দুপাশে রেখে আমার মাঝে বসতে সমস্যা কোথায় সে বুঝতে পারছেনা। অবশেষে সিলভী তার হাত ধরে নিজের পাশে নিয়ে বসালো। সে সিলভীর পাশে বসে পিছন দিয়ে আমার ঘারে হাত তুলে দিল। বুঝলাম সে আমাদের মগা পেয়ে মজা নিতে চাচ্ছে। এতক্ষন তো হেসেছি। এইবার হাঁসি বন্ধ করে বললাম তুমি তাড়াতাড়ি খবর নাও আমার অর্ডারের কি হলো। সে সাথে সাথে উঠে খোঁজ নিতে গেল। একটু পর নিজেই হাতে করে নিয়ে আসলো। যতক্ষণ ছিলাম ঐ মেয়েকে দেখলাম আমার বউ এর সাথে কুটকুট করে গল্প করছে। অন্য কোন ছেলের কাছেও আর উঠে গেলনা। গেলে হয়তো এক্সট্রা টাকা পেত। আমরা বের হবার সময় মেয়েটির হাতে ২০ বাথ টিপস হিসাবে তুলে দিলাম। মেয়েটি টাকাটা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে থ্যাংকস জানালো। সিলভীর হাত চেপে ধরে বলল তুমি অনেক সুন্দর ও ভাগ্যবতী। তোমার লাইফ পার্টনার অনেক চমৎকার। বউকেও দেখলাম থাই মেয়েটিকে প্রশংসা করতে করতে বের হচ্ছে। ওখান থেকে বের হয়ে আবার বিচের পাড় ঘেঁষে হাটতে লাগলাম। কিছুদূর যেয়ে সমুদ্রের দিকে মুখ দিয়ে ফুটপাথের উপর বসে পড়লাম। ঐ দূরে পাহাড়ের উপর জ্বলজ্বল করে জ্বলছে লেখা PATAYA CITY আর সেই লাল নীল আলো এসে আঁচড়ে পড়ছে সমুদ্রের পানিতে। অন্যরকম আবহ তৈরি করছে চারপাশ। বউ এর দিকে তাকিয়ে দেখি লান নীল আলোর আভা তার মুখের উপর এসেও পড়ছে। তাকেও অন্যরকম লাগছে দেখতে। স্বপ্নিল পরিবেশে বউ এর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে খারাপ লাগছেনা। মনে হচ্ছে একটি জীবন আমি শুধু এই চোখের দিকে তাকিয়েই পার করে দিতে পারি।
স্বচ্ছ পানিতে আমি
রাত ১ টার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম। হোটেলে ঢুকতে যেয়ে দেখি গাছের নিচের কন্যারা হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। লবিতে মানিক সাহেবের সাথে দেখা, কালকের প্রগ্রাম কি করা যায় তার পরামর্শ চাইলাম। তিনি কোরাল দ্বীপে যেতে বলল। কাল তার বাহিনী কোরালের পথে রওনা দিবে। আমাদের দুজনের খরচ বাবদ ২০০০ বাথ দিয়ে দিলাম। তারাতারি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। সকালে রওনা দিতে হবে কোরাল দ্বীপের পথে।
যত রাত করে ঘুমাইনা কেন আমার অভ্যাস আযানের পর পর ঘুম থেকে উঠা। টয়লেট সেরে বাথরুমে বোকা সেজে চুপচাপ বসে আছি। কি করবো বুঝতে পারছিনা। টয়লেট শেষে পানি ব্যবহার করার কোন ব্যবস্থা নেই। সম্বল টিস্যু পেপার। মজার বিষয় হলো থাইল্যান্ডের সব হোটেল এমনি। সম্ভবত বিদেশীরা পানি নেয়না। টিস্যু ব্যবহার কইরা গায়ে সেন্ট স্প্রে মাইখ্যা ঘুইরা বেড়ায়। বাথরুমের একদিকে একটা কমোড, তার অপজিট পাশে বেসিন। বাকি ডান পাশের এলাকা জুড়ে বাথটাফ। বাথটাফের উপর ঝরনা ও একটি বাথ হ্যান্ড শাওয়ার। বেসিনের উপর এবং বাথ টাফের উপর ছাড়া কোথাও কোন ট্যাপ বা অন্যকোন পানি বের হওয়ার ব্যবস্থা নেই। কাল রাতে বিষয়টা খেয়াল করা হয়নি। এরপর বউ এর গলা শুনতে পেলাম- "কি হলো, এতক্ষন বসে কি করো?'' কি উত্তর দিব এর, একা একা অনেক্ষন হাসলাম। অবশেষে বাথটাফের উপর থেকে অনেক কষ্টে হ্যান্ড শাওয়ার নিচে নামিয়ে পানি ব্যবহার করতে হয়েছে। যে কয়দিন ছিলাম এভাবেই চলতে হয়েছে।
সাতটার ভিতর হোটেল লবিতে নেমে এলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে কোরাল দ্বীপে রওনা দিব। হোটেল ভাড়ার সাথে ব্রেকফাস্ট একমোডেশন আছে। এদের রেষ্টুরেন্ট টা পছন্দ হলো। অনেক সুন্দর করে সাজানো। ১১০ আইটেম দিয়ে বুফেট ব্রেকফাস্ট আয়োজন করা আছে। ইন্ডিয়ান ফুডের সাথে আছে সি-ফুড। সি-ফুডের ভিতর অক্টোপাসের ফ্রাই আর হাংগরের কারী অন্যতম। সি- এলাকায় যেয়ে সি-ফুড খেতে না পেরে বেজায় দুঃখ পেলাম।
সিলভীকে রেষ্টুরেন্টে রেখে আমি বাইরে এলাম। ডলার এক্সচেঞ্জ করতে হবে। এত সকালে ব্যাংক খুলেছে কিনা কে জানে!বাইরে এসেই ভুল ভাংলো। আমাদের ঢাকার শহরে যেমন, যেখানে সেখানে চায়ের দোকান দেখা যায় এখানে তেমনি মানি এক্সচেঞ্জের দোকান। সে এক এলাহি কান্ড। একটি দেশ কিভাবে শুধুমাত্র পর্যটনের উপর টিকে থাকে সেটা থাইল্যান্ডকে না দেখলে বুঝা যাবেনা।
আমরা ৮ টা বাজার আগে আগে মাইক্রো বাসে করে বিচ পয়েন্টে আসলাম। এশিয়ান হলিডেজের গ্রুপের সাথে আমরাও আছি। গন্তব্য কোরাল দ্বীপ। বিচ পয়েন্টে এসে অভিভুত হয়ে গেলাম। অজান্তেই মুখ দিয়ে ওয়াও বের হয়ে পড়বে। এত সুন্দর ডেকোরেটেড বিচ দেখে আমরা অভ্যস্ত নই। সাথে আল্লাহর দান নীল সমুদ্রের পানি। পাহাড়ে ঘেড়া চারিদিক। ঝকঝকে সাদা বালুর উপর নীল পানির ঢেউ এসে পড়ছে। গোসল করার সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এর বায়রে কেউ যেতে শপারবে না। পুরো নিরাপত্তা তদারকির জন্য স্প্রীড বোট নিয়ে নিরাপত্তা কর্মীরা এপাশ থেকে অপাশ ছুটাছুটি করছে। আমাদের দেশের মত সমুদ্রের পানিতে ভেসে যাবার ইতিহাস এদের নেই। বিভিন্ন রঙের মানুষের পদচারনা। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বালির উপর দেখি টাওয়েল বিছিয়ে শুয়ে আছে কিছু বিদেশিনী। যথারিতি কাপড়চোপড় ছাড়া। এদের সমস্যা কি বুঝলাম না। এই রোদের ভিতর কাপড় খুলে শুয়ে থাকার মানে কি! সিলভীকে জিজ্ঞেস করলাম বিষয়ডা কি? সে বলল সান বাথ নিচ্ছে। ওরে আল্লারে, পানি বাদ দিয়ে হেরা সানে বাথ লয়। বিষয়টা হলো তারা সাদা চামড়াকে রোদে পুড়িয়ে তামাটে করতে চায়। মানুষের মস্তিস্কের বিকৃতি ইবলিশ কিভাবে ঘটিয়ে রেখেছে ভাবতেই অবাক লাগে। এছাড়া বাকি যেসব পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা ব্রা প্যান্টি পড়া। ৬০ বছরের বুড়িকেও দেখি এই ড্রেসে ঘুইরা বেড়াইতেছে। কারও কোন বিকার নেই। এটাই যেন স্বাভাবিক দৃশ্য। আমরাই যেন অস্বাভাবিক। আমাদের সাথের মেয়েরা একটা জামার উপরেও আবার বাড়তি জামা পড়া। তাদের দিকে কেউ তাকিয়ে দেখছে না, বরং আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। এর ভিতরেই আমাদের স্প্রিড বোট এসে হাজির। এতে করেই সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে।
তিন বিদেশী আর পাচ বাংলাদেশী নিয়ে নীল সমুদ্রের পানি চিড়ে ছুটে চলছে আমাদের স্প্রিড বোট। আমার বউ ছাড়াও আরো দুইটি মেয়ে আছে আমাদের সাথে। ওই দুইজন দেখি চোখ বন্ধ করে আছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর স্প্রিড বোট ঝাপিয়ে পড়লে যখন পানি গায়ে এসে পড়ছে তখন তারা একবার করে চিল্লানি দিচ্ছে। আর আমার বউ শক্ত হয়ে বসে আমাকে খামচি দিয়ে ধরে তার হাতের নখ আমার শরীরে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টায় আছে। ভিতরে ভিতরে আমিও আতংকিত বোধ করছি। স্প্রিড বোট যখন একটা ঢেউয়ের উপর আচড়ে পড়ে তখন সরাসরি মাথায় আঘাত লাগে। মনে হয় স্প্রিড বোট ভেঙে মাঝ বরাবর দু-খন্ড হয়ে যাবে। এভাবে কিছুক্ষন চলার পর ফেরির মত দেখতে একটা প্লাটফর্ম ভাসতে দেখা গেল। আমাদের বোটের গতি কমে আসলো। ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম ঘেসে দাড়ালে আমরা নেমে পড়লাম।
কোরাল দ্বীপ দেখা যাচ্ছে
অনেক পর্যটক এখানে অবস্থান করছে। এখানে প্যারা ট্রুপের ব্যবস্থা আছে। প্যারাসুটের সাথে আপনাকে বেধে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। প্যারাসুটের সাথে ১০০০ ফিটের মত একটি দড়ি স্প্রিড বোটের সাথে বেধে টান দিয়ে অনেক দুর চলে যাবে আর আপনি তররর করে উপরে উঠতে থাকবেন। অনেক বড় এলাকা নিয়ে সমুদ্রের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। যখন উপরে উঠে যায় অনেক ক্ষুদ্র দেখা যায় একজন মানুষকে। অনেকে ৫০০ বাথ দিয়ে টিকিট কেটে লাইনে দাড়িয়ে আছে। একজন প্যারাসুট নিয়ে ফিরে আসছে আর একজন উড়ে যাচ্ছে। অনেক বলেও বউকে রাজি করাতে পারলাম না। পিচ্চি পিচ্চি পুলাপাইন দেখি উড়ে যাচ্ছে। উত্তাল সমুদ্রের মাঝে এইসব কাহিনী করতে অবশ্য মজবুত হার্ট দরকার। আমার হার্ট এত মজবুত না। তারপরও বউ এর কাছে নিজের বাহাদুরি ধরে রাখতে ৫০০ বাথ দিয়ে একটি টিকিট কেটে ফেললাম।
লাইনে দাড়ানোর পর দেখি শীতের মাঝেও ঘামছি। শুধু উড়িয়ে ফেরত নিয়ে আসলে ঘামটা মনে হয় হতোনা। এই ইভেন্টের ভিতর থ্রিল ভাব বেশি আনার জন্য প্যারাসুট যখন শেষ উচ্চতায় অবস্থান করে তখন স্প্রিড বোট দাড়িয়ে পড়ে। এসময় প্যারাসুট সহ মানুষটি ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। নামতে নামতে সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর পড়ে গেলে আবার স্প্রিড বোট দৌড় মারে, আবার মানুষটি আকাশে উঠতে থাকে। এসময়কার কথা ভেবে আমি বেশি চিন্তিত। আল্লাহ্ না করুক কোন ভাবে যদি দড়ি ছিড়ে আমি থেকে যাই তখন অবস্থা কি হবে!!!
দুই হাতের ভিতর দিয়ে বেল্ট বেঁধে দিল, আর একজন মাজার দিকে ক্লিপ লাগাচ্ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। অতিরিক্ত সেফটির জন্য লাইফ জ্যাকেট পড়ব কিনা ভাবছি। যা কিছু বাচ্চাকে ব্যহবার করতে দেখলাম। বাচ্চারা করুক আর যেই করুক এই রিস্ক আমি নিতে পারবো না। বউ শুধু দাত বের করে হাঁসে। আমিও বোকাদের মত হাঁসি। বোকা না হইলে এই ফ্যাসাদে কেউ পড়ে? উড়া দেখতে ভালোই লাগছিল, তাই বলে আমারও যে উড়তেই হবে এমন তো কোন কথা নেই। হটাত করে কি হলো বুঝতে পারলাম না। নিজেকে ফেরির ডেক থেকে শুন্যে আবিস্কার করলাম। আমাকে টেনে ফেরির বাইরে নিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি নিচে দাঁড়াবার কোন যায়গা নেই। নীল পানির বড় বড় ঢেউ দেখা যাচ্ছে। এতক্ষন ফেরিতে বসে ঢেউ গুলোকে এত বড় মনে হয়নি। লাইফ জ্যাকেট না পড়ে আসলেই মনে হয় ভুল করলাম।
তরতর করে উপরে উঠছি। ভিতরটা ফাকা হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের চাপে চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ মনে হয় বন্ধ করে রেখেছি। কিছুই দেখতে পারছিনা। ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। আমি বিশাল নীল সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ছি। দুর থেকে পাতায়া শহরটাকে দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের মাঝে মাঝে ছোট বড় পাহাড়। আমার পাশ দিয়ে আরো দুজনকে উড়ে যেতে দেখলাম। মনে হচ্ছে এখানেই অনন্তকাল থেকে গেলে মন্দ হতোনা। পাখির মত ভেসে বেড়াচ্ছি শুন্য আকাশে। যেখান থেকে উঠে এসেছি সেটা খুঁজে পাচ্ছিনা। কোন দিকে ফিরে যাবো সেটাও বুঝতেছিনা। এখন এটা বুঝতে পারছি সমুদ্রের ঢেউ আস্তে আস্তে বড় দেখা যাচ্ছে। তারমানে স্প্রীড বোট থেমে যেয়ে আমাকে নিচে নামার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি নিচে নেমে যেতে থাকলাম। ঘাড় থেকে মাজা পর্যন্ত ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। এইযে ঢেউ… এখনই আমাকে ধরে ফেলবে... পায়ে পানির ছিটা অনুভব করলাম। ভেবেছিলাম আমি পড়লে চারিদিকে পানি ছিটকে পড়বে। তেমন কিছুই হলোনা। আমি হেঁটে হেঁটে পানিতে নামলাম মনে হলো। ধীরে ধীরে মাজা পর্যন্ত তলিয়ে গেলাম। ঐ যে একটি বড় ঢেউ আমার দিকে ধেয়ে আসছে। এখনই আমি ঢেউয়ের নিচে চলে যাবো। এখনও কেন আমাকে টেনে নিচ্ছে না? দড়ি কি তাহলে সত্যি ছিঁড়ে গেছে? প্রিয়জনদের মুখ আর কি দেখতে পাবো না? সিলভী কি একা একা দেশে ফিরতে পারবে?
চারিদিকে পানি ছিটিয়ে, ঢেউয়ের ভিতর থেকে শাঁ করে আবার উপরে উঠতে থাকলাম। একি অনুভুতি আমার...! আমি যেন আজ সমুদ্রকে জয় করলাম। বীরের মত দু হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়ে মুখ দিয়ে আ.. আ..আ… করে শব্দ করতে করতে উপড়ে উঠে যাচ্ছি। এবার মনে হচ্ছে আমাকে আবারও ফেলে দিয়ে টেনে তুলুক। বারবার ফেলে দিক। হাত ছড়ানো অবস্থাতেই আমাদের প্লাটফর্ম এ চলে আসলাম। কি করে যেন ঠিক যায়গা মত আমাকে নামিয়ে নিয়ে আসলো। নিচ থেকে দুজন আমাকে জাপটে ধরে আমার ব্যালেন্স রক্ষা করলো।
আবার স্পীড বোটে যাত্রা শুরু হলো কোরাল দ্বীপের পথে। এটা ছিল কোরালের পথে মাঝ বিরতী।
ভেজা জামা কাপড় নিয়ে স্প্রীড বোটে বসে আছি। হোটেল থেকে আসার সময় অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে আসা হয়নি। সিলভী বুদ্ধি করে একটা টাওয়াল নিয়ে এসেছিল বিধায় মাথাটা মুছতে পেরেছি। তীব্র গতিতে বোট এগিয়ে চলছে। বউকে বসিয়ে রেখে বোটের সামনে চলে আসলাম। এবার দেখতে পারছি নীল সমুদ্রের রুপ কেমন হতে পারে! সুন্দরী নারী তুচ্ছ এই রুপের কাছে। মিনিট দশেক চলার পর সামনে একটি লঞ্চ দেখা যাচ্ছে। আমাদের আরিচা দউলেদিয়া ঘাটে যে লঞ্চ গুলো যাত্রী পারাপার করে এমন সাইজ হবে। আমরা ওদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। এখানেও নিশ্চই কোন ইভেন্টের ব্যবস্থা আছে।
ওরে বাবা... একি শুনি! একটু আগে ঘুরে আসলাম সমুদ্রের উপরের আকাশ দিয়ে এখন নাকি ঘুরতে হবে সমুদ্রের নীচ দিয়ে! স্বচ্ছ সমুদ্রের তলদেশ দেখার ব্যবস্থা এখানে। সমুদ্রের ডাইভিং করতে জনপতি আপনাকে ২০০০ বাথ গুনতে হবে। এখানকার পানি এত স্বচ্ছ যে পানির উপর দিয়ে অনেক নীচ পর্যন্ত দেখা যায়। এই এলাকার সমুদ্রের গভীরতা কম। ওদের ভাষ্যমতে ৮০ ফিট গভীর হলেও আপনি ৫০ ফিট পর্যন্ত অবলোকন করে আসতে পারবেন। যারা যেতে চায় তাদের জন্য ১০ মিনিটের টিপস দিয়ে দেয়। সবচেয়ে জরুরী টিপস হলো নিচে যেয়ে কোন সমস্যা অনুভব করলে চেইন টান দেওয়া। কিভাবে টান দিবেন ভালো ভাবে দেখে নিবেন। এই এলাকায় হিংস্র প্রানীর আনাগোনা কম। তারপরেও কিছু হাংগর চলে আসে।
চারজন করে এক একটা গ্রুপ তৈরী করা হয়। এই চার জন সমুদ্রের তলদেশে একসাথে ডাইভিং করবে। প্রয়োজনে এক জন অন্যজনের পাশে দাড়াতে পারে। আমার গ্রুপে আমি আর বাকি তিন বিদেশী। আমি নিজে নিজে ডাইভিং কস্টিউম পড়ে নিলাম। নিজেকে দেখতে অদ্ভুত লাগতেছে। ভুঁড়ি উচু ডলফিন মাছের মত। ভুঁড়িটা চেপে ভিতর দিকে রাখার চেষ্টা করতেছি। সিলভী ভুঁড়ি সমেত ছবি তুলতে গেলে ঘুরে দাঁড়ালাম। নিজেকে এখন ডুবুরী ডুবুরী মনে হচ্ছে। আমাদের দেশের দমকল বাহিনীর ডুবুরী না, একেবারে সমুদ্রের ডুবুরী। আমাদের পিছনে একটি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগিয়ে দেওয়া হলো, মুখে লাগিয়ে নিলাম অক্সিজেন মাস্ক সাথে চোখের গগলস। বউ কে বললাম বিদায় দাও, যদি না ফিরে আসি ….,, এমন গুরু গম্ভীর কথার পরেও বউ হাঁসে। সাথে পরামর্শ দিলো – সময় পাইবা ৩০ মিনিট, এর আগেই আবার ফিরে এসোনা। জীবনে আর এই সময় সুযোগ হবে কিনা ঠিক নাই। সুযোগের ১০০% ইউটিলাইজড করো। আমি ভাবলাম তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলবে বেশিক্ষন থাকার দরকার নেই, এ দেখি উল্টা বলে!
চারজন একসাথে হাত ধরে কাউন্টিং এর তালে পিছন ফিরে বসা অবস্থায় সমুদ্রে ঝাপ দিলাম। কোথায় হাত ধরা আর কোথায় কি! আশে পাশেই কাওকে দেখা যাচ্ছেনা। ঢেউয়ের তালে এক একজন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। উল্টাভাবে পড়ে এক ডিগবাজী খেয়ে আমি সোজা হয়ে গেছি। একা একাই নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছি। স্বচ্ছ পানি আর মাথার সাথে লাগানো লাইটের আলোয় চারিদিকে আলোকিত। আমার দলের একজন কে দেখতে পেলাম। প্রথম দেখে ভয় পেয়েছি কোন ভয়ঙ্কর প্রানী ভেবে। কাছেই কিন্তু কেন যেন দূরে দূরে মনে হয়। বৃদ্ধা আগুল দেখিয়ে আমাকে সঙ্কেত দিল। আমি নিচে নামার সাথে আমার সঙ্গীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। মজার একটা জিনিস বুঝতে পারছি এখানে। আমরা ইচ্ছা করলেই সাঁতার কেটে মাথা উপরে বা নিচে, নিচে থাকা অবস্থায় সামনের দিকে, যেভাবে ইচ্ছা চলাফেরা করতে পারি। দুজন হাত ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। বুকে এবং কানে চাপ অনুভব করছি। আমাদের দুজনের মাঝ দিয়ে দৌড় দিল একঝাক টেংরা মাছের সাইজের কিছু মাছ। নিচের দিকে হটাত করে চোখ আটকে গেল! একি খোদা… , পৃথিবীর উপরিভাগ ও পানির নিচেরভাবের ডিজাইন প্রায় একই রকম। নিচে দেখি পাহাড়ের মত সারি। একটা ছোট একটা বড়। স্রোত তেমন অনুভুত হয়না। ইচ্ছামত মুভমেন্ট করা যাচ্ছে। এগিয়ে গেলাম শেওলা ঘেরা পাহাড়ের দিকে। একঝাক জেলি ফিশ আর দেখি শেওলা দিয়ে বসে আছে। কাছে যেয়ে ধরতে গেলাম হাত দিয়ে, সরে যায় আবার যায়না। বোঝার চেষ্টা করে আমি কি ক্ষতি করবো …, জেলি ফিশের নামটাই বলতে পারলাম, কারন এই নামটাই শুধু জানি। বাকি যেসব লাল নীল বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন রকমের যে সব মাছ দেখা যায় তার নাম আমার জানা নেই। প্রজাপতির মত মাছ আছে কিছু। সেগুলো সব সময় দেখলাম চারপাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার সাথের সঙ্গী সব তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আমি দেখায় ব্যস্ত। তার কাছে ওটারপ্রুফ ক্যামেরা আছে। আরো একটু সামনে এগিয়ে যেতেই সে আমাকে টেনে ধরলো। হাত দিয়ে ইশারা করলো সামনে না যেতে। দেখি সে ক্যামেরা তাক করছে। খুব কদাকার কিছু প্রানী চোখে পড়লো। সারা শরীর ভরা শুড় জাতীয় কিছু। একটু পরেই বুঝলতে পারলাম এই গুলো অক্টোপাস। বাচ্চা অক্টোপাসের ফ্রাই করা দেখেছি হোটেলে কিন্তু বড় অক্টোপাস এত কদাকার দেখতে চিন্তার বাইরে। শুনেছি এরা অনেক ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে পানির তলে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলে অক্টোপাস গুলো দৌড় মত দিল, সাথে সাথে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। সামনে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। বইয়ে পড়েছিলাম অক্টোপাস বাঁচার জন্য এক ধরনের রঙ ছেড়ে দেয় পালানোর সময়। এটাই সেই রঙ কিনা জানিনা। নিচের দিকে যাবার জন্য সাঁতার দিলাম। দেখি নিচে নামতে পারছিনা। এক যায়গায় স্থীর হয়ে আছি। পিঠের সাথে চেইনের সাথে টান লাগছে। বুঝতে পারলাম আমরা ৫০ ফিট নিচে চলে এসেছি। এর থেকে বেশি কোথায় চলাফেরা আমরা করতে পারবো না। পিছনে পিছাতে থাকলাম। এর ভিতর বাকি সঙ্গীদের খুঁজে পেয়েছি। এক জন আমাদের ইশারা করে নিয়ে গেল আরো পিছনের দিকে। দেখি পাহাড়ের ভিতর গুহার মত দেখতে একটি যায়গা। মনে হয় আদীম কালের কোন গুহার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দেড় থেকে দুই ফিট হবে গুহার মুখ। এই মুখ দিয়ে একটি কিছুক্ষন পর পর একটি মাছের মাথা বের হচ্ছে আবার ঢুকে যাচ্ছে। যখন মাথাটা বের হয় দেড় ফুট ফাকা যায়গাটা পুরোপুরি ভরে যায়। বিশাল আকৃতির কোন মাছ হবে। আমাদের ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা তাক করছে। এর ভিতর দেখি গুহা মুখ ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। ঘটনা কি আল্লাহ্ মাবুদ জানে। আমরা সবাই একটু আগে পিছে হলেও একই যায়গায় ধরা যায় কিন্তু গুহা মুখ বা মাছটি দূরে চলে যাচ্ছে। এরপরেই বুঝতে পারলাম বিষয়টা। আমাদেরকে উপর থেকে চেইন টেনে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কি আর করার আছে। সময় শেষ হয়েছে। উপরে তুলে না নিলে আমরাই বিপদে পড়বো। কারন অক্সিজেন সিলিন্ডার ছোট মাপের হওয়ায় এক ঘন্টার বেশি টিকে থাকা যাবে না। একজন লঞ্চের ডেক থেকে টেনে আমাকে উপরে তুলল। সারা গা থেকে পানি ঝরে পড়ছে। বাকিরাও উঠার পর আমার ইচ্ছা করছিল জানতে ঐ ক্যামেরা দিয় যে ছবি তুলছিল তার সাথে কথা বলতে। সেকি তুলতে পেরেছিল প্রানীটির ছবি? জিজ্ঞেস করার পর দেখি সে রাগে গজগজ করছে। অস্পষ্ট কিছু ছবি সে তুলতে পেরেছে। সে ছবি তুলতে যাবার আগেই আমাদের উপরে তুলে ফেলা হয়েছিল।
আবারও শুরু করেছি স্প্রীড বোটের জার্নি। এখনও তো পৌঁছাতে পারিনি আমাদের আসল গন্তব্য কোরাল দ্বীপ ….
বিচ পয়েন্ট
ঐ দূরে চোখে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সবুজ পাহাড়। যেন সবুজের চাঁদর জড়িয়ে আছে গায়ে। সাগরের মাঝে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে পানি আর মাঝ বরাবর হটাত হটাত এই পাহাড় দেখা যায়। পানির তলদেশে যে পাহাড় গুলো আছে আর উপরে মাথা বের করে যেগুলা দাঁড়িয়ে সব একই পাহাড়। ওগুল উচ্চতা কম হওয়ায় পানির নিচে পড়ে আছে আর এগুলোর উচ্চতা বেশি বিধায় পানির উপরে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। থাইল্যান্ড মুলত পাহাড়ে ভরা। ধীরে ধীরে আরো পরিষ্কার হয়ে উঠছে কোরাল দ্বীপ। ছোট খাটো একটা দ্বীপ। পাতায়া উপকুল এলাকা থেকে মাত্র ৮ কিঃমিঃ সমুদ্র গভীরে অবস্থিত। সরাসরি স্প্রীড বোটে গেলে মাত্র ২০ মিনিট সময় লাগে। পর্যটকদের আনন্দ দেবার জন্য এবং তাঁদের ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ গ্রহন করিয়ে আপনাকে কোরাল দ্বীপে নিয়ে যাবে। কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ঘুরতে গেলে তাঁরাই আপনাকে ব্যবস্থা করে দিবে কিন্তু নিজে নিজে গেলে আপনি খুব সহজেই বিচ পয়েন্ট থেকে বোট ভাড়া করতে পারবেন। কোরাল দ্বীপের ৬০ ভাগ এলাকা পানির তলে আর বাকি এলাকা স্থল ভাগ। ভাটার সময় আরো কিছু অংশ ভেসে ওঠে। এই ৪০ ভাগের আবার ২০ ভাগেই পাহাড়। একেবারে হাতে আঁকা ছবির মত দেখতে এই দ্বীপটি। স্প্রীড বোট নিয়ে পাড়ে নামা যায়না, হাটু পানিতে থাকতেই নেমে যেতে হয়। হাটু পানিতেই আপনি পানির নীচ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখে দেখে পথ চলতে পাববেন। এক প্রকার শেওলা জমে জমে এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে, কাঁদাহীন কাঁকর আর ঝকঝকে বালুর বিছানা বিছানো দ্বীপ। আমাদের হাটু পানি থাকতেই নামিয়ে দিলো। আমি হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে সিলভীকে হাত ধরে নামিয়ে দেখি তার মাজা পর্যন্ত তলিয়ে গেছে। তার উচ্চতা এভাবেই মাঝে মাঝে আমার কাছে ধরা পড়ে, যদিও সে স্বীকার করে না।
হেঁটে হেঁটে পাড়ের দিকে আমরা সবাই এগিয়ে গেলাম। এখন মনে হচ্ছে এটা ওয়েল প্লান করে বানানো একটি দ্বীপ। দ্বীপের চারিদিকে পাহাড় দিয়ে বেষ্টিত। সামনের অংশটি খোলা, এটাই সৈকত হিসাবে ব্যবহার হয়। সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। সারি সারি বসানো আছে বিচে বসার খাটিয়া। স্কুলের বেঞ্চের মত দুই তিনটি সারি করা। এগুলোর ভিতর দিয়ে ডানে বায়ে না তাকিয়ে সামনের দিকে হেঁটে গেলাম। বউকে পাশে রেখে ডানে বায়ে তাকানো খুবই বিব্রতকর। পাতায়া বিচের থেকে এখানকার অবস্থা আরো বেশি খারাপ। ওখানকার বিচে দেখেছিলাম দুই একজন সান বাথ নিচ্ছে, এখানে দেখি বাথ নেবার দরকার নেই। স্বাভাবিক অবস্থাতেই সব কিছু খোলা। স্প্রীড বোট থেকে নামার সময়েই মনে হয় সব বিসর্জন দিয়ে দ্বীপে নেমেছে। হেঁটে হেঁটে আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য একটা ট্রাউজার ও টিশার্ট জাতীয় কিছু কেনা। এখানে বেশ কিছু দোকানপাট নিয়ে একটা মার্কেটের মত গড়ে উঠেছে। এই দ্বীপে কোন বসতী নেই কিন্তু সারা দিন মানুষের আনাগোনা। একটি ট্রাউজার আর টিশার্ট কিনে ফিরে আসলাম। পাতায়া বিচে নামা হইনি। এখানে নামতে হবে। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
৯৪০৫ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বেশ উপভোগ করেছি- প্যারাসুট আর ডাইভিং এর এডভেঞ্চার। পোস্টটি স্টিকি করা যেতে পারে।
লেখাটি ষ্টিকি করা হোক। ধন্যবাদ
ওরে বাপরে ! লেন্থ দেখে ভয় পাইলাম ।
ওয়েলকাম -
মাই হোম
ধন্যবাদ আপনাকে ।
থাইল্যান্ড এর প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেক সুন্দর হওয়া সত্বেয় কেন তারা তাদের নারিদের বিক্রি করে আয় করতে চায় সেটা বুঝতে কষ্ট হয়।
যদি বলা হয় , যা খরচ হবে তা তাকেই দিতে হবে ; তখন কি তার এই এক্সাইটমেন্ট আগের মত থাকবে ?
ভাল লাগলো পোস্ট টি ।
এত সুন্দর একটা জায়গায় বেড়াতে গেছেন , চেহারা এরকম বাংলা পাঁচ করে আছেন কেন ? না কি চেহারা এরকমই ?
কিছু ছবি না দিলেও পারতেন , বিশেষ করে এই ছবিটি ।
এই ছবিটি কি না দিলেই হত না , না কি কাহিনীর বর্ণনায় এটা না দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না ?
এসব ছবি পোস্টে দেবার সময় ভাবীর অথরাইজেশন নিয়েছিলেন কি ?
মন্তব্য করতে লগইন করুন