আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য বনাম সেকেলেভাষা ও সাহিত্য
লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ২৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১০:৫০:৫০ সকাল
আমাদের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। যদিও কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। কারণ আমরা অধিকাংশ বাঙালিই জন্মগতভাবে আঞ্চলিক বাংলাভাষায় কথাবলি। ভূমিষ্ঠ হবার পর আমরা যা শিখি ও বলি তা 'প্রমিত বাংলাভাষা' নয় বরং 'আঞ্চলিক বাংলাভাষা।' সে অর্থে আমাদের প্রকৃত মাতৃভাষা হচ্ছে আঞ্চলিক বাংলা, যা আমাদের জন্মগত ও মজ্জাগত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রমিত বা চলিত বা কথ্যভাষাই হচ্ছে স্বীকৃত আধুনিক বাংলাভাষা, যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতিও পেয়েছে।
আমাদের আরেকটি লেখ্যবাংলা হচ্ছে সাধুভাষা, যা আধুনিক বাংলার ভিত্তিমূল। অন্যান্য ভাষার ন্যায় বাংলার এই তিনটি রূপই কিন্তু পরিবর্তনশীল। হাজারবছর যাবত বাংলার পরিবর্তন হয়ে আসছে। সেজন্যই ভাষাকে নদীর সাথে তুলনা করা হয়। নদী যেমন গতিপথ পরিবর্তনকারী ও সতত প্রবহমান তেমনই যেকোনো ভাষাও। ব্যাকরণ দিয়ে ভাষাকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খল করা হলেও ভাষার পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যাকরণও কিন্তু ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হতে বাধ্য। তাই ভাষা ও সাহিত্যের পরিবর্তনকে যারা মানতে পারে না, তারা আধুনিক মনস্ক নয় সেকেলেপন্থী।
বাংলাসাহিত্যের আদিযুগ, মধ্যযুগ এবং বর্তমান আধুনিক যুগের কিছুসাহিত্যের নমুনা তুলেধরলেই আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার হবে যে, আমাদের সাহিত্যে আমরা মূলত কোন ভাষার চর্চা করবো? তাকি সাধু-চলিতের মিশ্রণে, শুধুই সাধুভাষায়, শুধুই চলিতভাষায় নাকি আঞ্চলিক ভাষায়? নাকি এসবের মিশ্রণেই আমরা সাহিত্যচর্চা করবো?
প্রাসঙ্গিকভাবে বিভিন্নযুগের বাংলাভাষায় রচিত কিছুপদ্যের নমুনা দেখা যাকঃ এখানে আদি বাংলাভাষায় রচিত চর্যাপদের উল্লেখ করা হলো--
‘গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ’–গঙ্গা যমুনার মাঝে নৌকা চলে।
‘সনে ভরিলী করুনা নাবী’–সোনায় ভরা আমার করুনা নৌকা।
‘নিসি অন্ধারি মূসার চারা’–অন্ধকার রাত, ইঁদুর চড়ছে।
মধ্যযুগের মহাকবি বডু চণ্ডিদাসের রচিত “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” মহাকাব্যের নমুনা দেখুন--
“আকুল শরীর মোর বে আকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মোর আউলায়লোঁ রান্ধন।।”
আমি মধ্যযুগের আধুনিক কবি আব্দুল হাকিমের বাংলাভাষার প্রতি প্রেমসংক্রান্ত বিখ্যাত কবিতার কয়টি পঙক্তি দিলাম, দেখুন-
"যেজন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।"
চতুর্দশ শতকের শেষদিকের বৈষ্ণব পদাবলীর নমুনাঃ
‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ’
বাংলাসাহিত্যের আধুনিক যুগের শুরু হয় ১৮০০ সাল থেকে আর ১৮২৫ সালে জন্মগ্রহণকারী আধুনিক যুগসন্ধিক্ষণের শক্তিশালী কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তাঁর অধিকাংশ কবিতা ব্যাঙ্গবিদ্রুপে ভরা। তার বাংলায় রচিত একইংরেজ রমণীর উদ্দেশ্যে লেখা কবিতার দু'টি চরণ দেখুন--
“বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছোটে
আহা তায় রোজ রোজ কত রোজ ফুটে”
সেসময়ের শক্তিশালী এই কবিদের বাংলাভাষার এ হচ্ছে নমুনা। এখন আমাদের কাছে হাস্যকর, কিছুটা দুর্বোধ্য ও বেখপ্পালাগলেও মনের ভাবপ্রকাশে এমন বাংলাই ছিল তাদের সাহিত্যের অবলম্বন। যুগের সাথে তালমিলিয়ে তখনকার এই আধুনিক ভাষাই ছিল তাদের কাছে বিকল্পহীন প্রিয়মাতৃভাষা।
এরপর আমরা আধুনিক যুগসন্ধিক্ষণ এবং অত্যাধুনিক যুগের আরোকিছু শক্তিশালী কবি-সাহিত্যিকের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পর্যায়ক্রমিক নমুনা দেখবো। ১৮৬১ সালে জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথের কিছু আধুনিক পদ্যের নমুনা দেখলে ঈশ্বর গুপ্তের থেকে তার ভাষা ও রচনার ফারাক কতটুকু, তা সহজেই বোঝা যাবে।
* রবীন্দ্রনাথের কবিতা-পদ্য দেখুন---
তোমারে কি বারবার করেছিনু অপমান।
এসেছিলে গেয়ে গান
ভোরবেলা;
ঘুম ভাঙাইলে ব'লে মেরেছিনু ঢেলা
বাতায়ন হতে,
পরক্ষণে কোথা তুমি লুকাইলে জনতার স্রোতে।
ক্ষুধিত দরিদ্রসম
মধ্যাহ্নে, এসেছে দ্বারে মম।
----------------------------------------------
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।
--------------------------------------------------------
অযুত বৎসর আগে হে বসন্ত, প্রথম ফাল্গুনে
মত্ত কুতূহলী,
প্রথম যেদিন খুলি নন্দনের দক্ষিণ-দুয়ার
মর্তে এলে চলি,
* এবার দেখুন ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণকারী কাজী নজরুলের কবিতা-পদ্যের নমুনাঃ
ওরে আয় !
ঐ মহা-সিন্ধুর পার হ’তে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায়-
ওরে আয় !
ঐ ইসলাম ডুবে যায় !
যত শয়তান
সারা ময়দান
জুড়ি’ খুন তার পিয়ে হুঙ্কার দিয়ে জয়-গান শোন্ গায়!
--------------------------------------------------------
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
--------------------------------------------------------
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
* ১৯১৮ সালে জন্ম নেয়া কবি ফররুখের কবিতা দেখুন--
সকল রুদ্ধ ঝরোকা খুলে দাও
খুলে দাও সকল রুদ্ধ দরোজা।
আসুক সাত আকাশের মুক্ত আলো
আর উচ্ছল আনন্দের মত
--------------------------------
ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠল ফুটে বনের ফুল।
সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।
* ১৯২৯ সালে জন্ম নেয়া কবি শামসুর রহমানের কবিতা-
লতাগুল্ম, বাঁশঝাড়, বাবুই পাখির বাসা আর
মধুমতি নদীটির বুক থেকে বেদনাবিহ্বল
ধ্বনি উঠে মেঘমালা ছুঁয়ে
ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়।
-----------------------------------------
স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
* ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণকারী কবি মাহমুদের কবিতা এবার--
হারিয়ে কানের সোনা এ-বিপাকে কাঁদো কি কাতরা?
বাইরে দারুন ঝড়ে নুরে পড়ে আনাজের ডাল,
তস্করের হাত থেকে জেয়র কি পাওয়া যায় ত্বরা –
সে কানেট পরে আছে হয়তো বা চোরের ছিনাল !
-------------------------------------------------
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে ?
হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
---------------------------------------------------
* ১৯৪৫ সালেজন্ম নেয়া কবি নির্মলুন্দু গুণের কবিতা---
কে কবে বলেছে হবে না? হবে,বউ থেকে হবে ।
একদি আমিও বলেছিঃ 'ওসবে হবে না ।'
বাজে কথা । আজ বলি,হবে,বউ থেকে হবে ।
বউ থেকে হয় মানুষের পুনর্জন্ম,মাটি,লোহা,
সোনার কবিতা, ---কী সে নয়?
--------------------------------------------
হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।
* ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণকারী কবি হেলাল হাফিজের কবিতা--
নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।
---------------------------------------
তোমাকে শুধু তোমাকে চাই, পাবো?
পাই বা না পাই এক জীবনে তোমার কাছেই যাবো।
ইচ্ছে হলে দেখতে দিও, দেখো
হাত বাড়িয়ে হাত চেয়েছি রাখতে দিও, রেখো
----------------------------
সামান্য উদাহরণ দিলাম, এখন আপনারা আদি, মধ্য, আধুনিক ও এই অত্যাধুনিক যুগের সেরাকবিদের ভাষারীতি এবং কবিতা-পদ্যে ব্যবহৃত তাদের ভাষার পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন লক্ষ্য করুন। আধুনিক যুগের শুরুতে রবিবাবুসহ নজরুলের কাব্যভাষা পরিবর্তিত হয়ে শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজদের কাব্যভাষা পর্যন্ত দেখুন।আমাদের আধুনিক বাংলায় পদ্য লিখবেন নাকি কালিদাস, আব্দুল হাকিম, রবিবাবু, নজরুলের সাধু-চলিতভাষার মিশ্রণে লিখবেন নাকি আল মাহমুদ, হেলাল হাফিজদের মতো বাংলায় লিখবেন?
বিষয়: বিবিধ
১৪২৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন