নাটিকাঃ একাঙ্কিকা: অন্যরকম প্রতিবাদ
লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ০৭ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:১০:২৭ রাত
চরিত্রচিত্রণঃ
১। প্রথম বখাটেঃ বিদ্যালয়ত্যাগী ধনীর সন্তান তপু।
২। দ্বিতীয় বখাটেঃ এসএসসি ফেল মধ্যবিত্তঘরের সন্তান নজু।
৩। তৃতীয় বখাটেঃ এইচএসসি ফেল গরীবঘরের সন্তান সাজু।
৪। বোরকাপরিহিতা কলেজছাত্রীঃ চাকরিজীবীর সন্তান সুমনা।
৫। থ্রিপিচপরিহিতা কলেজছাত্রীঃ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পলি।
৬। জিন্সপ্যান্ট ও শার্টপরিহিতা কলেজছাত্রীঃ বিত্তশালী ব্যাবসায়ীর সন্তান কেয়া।
প্রথম দৃশ্যঃ
[স্থানঃ মেইনরোড থেকে বেশ দূরে নবসুন্দর কলেজরোড। গ্রীষ্মের সকাল। রাস্তায় দুয়েকটা রিক্সা ও বিক্ষিপ্ত কিছু পথচারী দেখা যাবে।
হালকা-রোদে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে কলেজে চলেছে তিনজন ছাত্রী। ঢাকা মহানগরীর নবসুন্দর গার্লস কলেজের ছাত্রী ওরা। সুমনা বাকিদের চে’ বয়সে বড়। তবে ধনীর দুলালী হলেও খুভ ভদ্র এবং কঠিন পর্দার সাথেই চলাফেরা করে; প্রায়ই বোরকাও পড়ে। কিন্তু কেয়া সিনেমাস্টাইলে একেকসময় একেকরকম খোলামেলা ও সেক্সি পোশাকে বাইরে বেরোয় এবং বেপরোয়া চলাফেরা করে। আরেক বান্ধবী পলি কখনো বোরকা না পরলেও উপযুক্ত শালীন পোশাক পরে। সালোয়ার-কামিজের ওপর ওড়না-চাদর ঝুলিয়ে শরীরের কাঠামো ঢেকেই চলাফেরা করে।
আজ তিনজনের অনেক তাড়া। কলেজের বেশ দেরি হয়ে গেছে। সুমনা সবার সামনে, পলি ওর পেছনে আর সর্বপেছনে হাঁটছে কেয়া। কিন্তু নিত্যদিনের মতোই কয়েক বখাটের ইভটিজিংয়ের শিকার হয় ওরা।]
প্রথম বখাটে তপুঃ (গলিরাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়) এ-ই নজু, দ্যাখ আইতাছে—
দ্বিতীয় বখাটে নজুঃ (অন্যদিকে মুখ ফেরানো অবস্থায়) কেরে, কার কথা কইস?
তপুঃ আরে ধ্যাৎ, (আঙ্গুল উঁচিয়ে কেয়াকে দেখায়) ওইযে নাইকা পপী আইতাছে-দ্যাখ, দ্যাখ----
নজুঃ (কেয়াদের দিকে মুখফিরিয়ে) ওহ তাইতো! তপু অহন কিছু কইস না, শিসও দ্যাস না। সুমনা আপারা আগে পার হইয়া লউক---
তপুঃ ঠিক আছে ওস্তাদ, যারে সম্মান দেওনের তারেতো দিতেই হইবো; আগে যাইয়া লউক ভাল আপারা-
[ততক্ষণে সুমনা আর পলি বখাটেদের অতিক্রম করে বেশ সামনে চলে গেছে আর জিন্সপ্যান্ট-শার্টপরা ওড়নাবিহীন কেয়া ওদের কাছাকাছি চলে এসেছে প্রসাধনীর উগ্র-ঝাঁঝালো গন্ধছড়িয়ে]
নজুঃ (কেয়াকে উদ্দেশ্য করে হাততালি দিয়ে গান ধরে) টেডিবউ সাজো গো, আরো সুন্দর লাগবে গো-বলো বলো, আরো বলো, লাগছে মন্দ নয়---
কেয়াঃ (বখাটেদের দিকে মুখফিরিয়ে মুচকিহেসে স্বগতস্বরে শুধু বলে) শয়তান কোথাকার----
তপুঃ (নজুর সাথে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কয়েকবার শিস দিয়ে এবার সমস্বরে গান ধরে) চিজ বড়ি হ্যাঁয় মাস্ত মাস্ত, চিজ বড়ি হ্যাঁয় মাস্ত---হেই-হেই-হেই----
পলিঃ (পেছনফিরে তা দেখেই সামনের সুমনাকে ডাক দেয়) সুমনা আপু, শুনছেন---বখটেরা আজো ধরেছে কেয়াকে----
সুমনাঃ (একটু দাঁড়িয়ে বখাটেদের দিকে মুখঘুরিয়ে) ধরবেনা আবার, ওর যে বেশভূষা! ছেলেদের টাইটফিট পোশাকপরার কী দরকার বলো--। এসব দেখে উত্তেজিত বখাটেরা তো সুযোগ নিতেই পারে? এমনিতেই যা দিনকাল খারাপ, সেটা বুঝতে হবেনা? চলো, আমাদের এতে জড়িয়ে বিপদে পড়ার দরকার নেই—
পলিঃ (দু’জনে এবার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে) ঠিক বলেছেন আপু। প্রায় দিনই তো ওকে ওরা যাতা বলে অপমান করে; তবুও কি একটু শালীন পোশাক পরা যায়না? কই আমাদের তো এভাবে বলেনা বরং সম্মান করে---
সুমনাঃ (বলতে বলতে দু’জনে কলেজে ঢুকে পড়ে এবং কিছু পরে ঢোকে কেয়াও) হ্যাঁ ঠিক তাই। আমাদের বুঝতে হবে যে, এটা সিনেমার রাজ্য নয় বাস্তব সমাজ। আমি হলে প্রথম অপমানেই শুধরে যেতাম রে (দীর্ঘশ্বাস)--
দ্বিতীয় দৃশ্যঃ
[কলেজছুটির পর বিকেল সোয়া পাঁচটা প্রায়। আবার তিনজনে একসাথে একই পথে বাসার দিকে পা বাড়ায়। কারণ ওদের বাসা একই পাড়ায়। কিছুক্ষণ পর ওরা সাহেবমোড়ে বখাটেদের আড্ডার কাছাকাছি চলে আসে, কেয়া হাঁটছে ওদের সামনে। সুমনা লক্ষ্য করে, ওরা তাদের দিকেই তাকিয়ে পচা ও বিদ্ঘুটে দাঁত বের করে হাসছে। বখাটে তপু কেয়ার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে নতুন আরেক বখাটেকে কী যেনো বলছে। এতে ঘাবড়ে যায় সুমনা ও পলি। ফলে পা টিপেটিপে অতি ধীরেধীরে এগুতে থাকে ওরা।]
সুমনাঃ (কেয়াকে ডাক দেয় এবং হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে পলিসহ) এ-ই কেয়া, একটু দাঁড়াও তো-----
কেয়াঃ (অধীর আগ্রহে ওদের কাছে এগিয়ে আসে) কেনো আপা, কী হয়েছে?
পলিঃ সকালবেলা বখাটেরা তোকে কী বলছিলো রে---কেয়া?
কেয়াঃ (আমতাআমতা করে ব্যাপারটা লুকানোর চেষ্টা করে) কই, নাতো—ওদের কথা বাদ দেতো পলি---
সুমনাঃ শোনো কেয়া, দিনকাল ভালো নয়, তাই বখাটেদের লাই দিতে নেই। ওদের ক্ষতি থেকে অবশ্যই আমাদের সাবধান থাকতে হবে। ওরা কখন কী করে বলা যায়না। কারণ ওরা বিকৃতমনা এবং ক্ষ্যাপা কুকুরের মতোন বেপরোয়া, বুঝলে---
কেয়াঃ (লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়) ঠিক আছে আপা, কিন্তু আমি কী করতে পারি বলেন তো---
সুমনাঃ (বখাটেদের চোখের ইশারায় দেখিয়ে) চলো আজ অন্যরাস্তা ঘুরে বাসায় যাই--। ওই দেখোনা, ওদের মতিগতি ভালো ঠেকছেনা। চলো—(কেয়ার হাত ধরে একপ্রকার টানমেরে অন্যপথে হাঁটতে থাকে।)
কেয়াঃ (প্রতিবাদের সুরে) না আপা, এভাবে পালাবো কেনো? চলেন আমরা বরং প্রতিবাদ করি---
সুমনাঃ (হাঁটতেহাঁটতে কাউন্সিলিং করে) না বোন, এভাবে নয়। আমরা পারবোনা ওদের সাথে। কারণ ওরা বখাটে-মাস্তান, ওরা পারেনা এমন কাজ নেই? তাই ওরা আমাদের গায়ে হাত দিলেই আমরা অপমানিত হবো; কিন্তু ওদেরতো মান-সম্মান নেই! আর আমরা ভদ্র-শিক্ষিত—ওদের অপমানের সুযোগ দেবো কেনো?
কেয়াঃ (কথাকেড়ে নিয়ে) কিন্তু আপা—
সুমনাঃ কিন্তু নয় বোন--কুকুর কামড়ালেও কি তাকে কামড়ানো চলে বরং আমাদের প্রতিবাদ হবে অন্যরকম? চলো যেতে যেতে বলি আমার জীবনের এক করুণ কাহিনী—
পলিঃ আপু আমিও কিন্তু শুনিনি আপনার কাহিনী, বলেন—বলেন—
সুমনাঃ (দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে) শোনো তাহলে, আমার আব্বা চাকরি করতেন রংপুরে ২০১২ সালে। রংপুর রোকেয়া কলেজের প্রথমবর্ষের ছাত্রী ছিলাম আমি। আমিও কেয়ার মতোই উগ্র পোশাক পরে চলতাম এবং আমাকেও বখাটেরা আজেবাজে টিজ করতো। কিন্তু আমি প্রতিবাদের বদলে মজাই পেতাম। একদিন এক বখাটে আমার পোশাক ও শরীর নিয়ে এমন নোংরা কথা বললো যে, আমি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কষিয়ে দেই একচড়। ব্যস আর যায় কোথায়, ওরা পরদিন সদলবলে আমাকে অপহরণ করতে গেলে আমি দৌড়িয়ে পালিয়ে বাঁচি। আমাদের বাসায় গিয়ে কত যে বিচ্ছিরি কাণ্ডও করে!
তাই আব্বা বদলী হয়ে এলেন ঢাকায়। আর আমি নিজেই তওবা করে ইজ্জতবাঁচাতে নামজ আর বোরকা ধরলাম--। পড়াশোনা একবছর নষ্ট হলেও মান-ইজ্জত নিয়ে এখন আমি খুব নিরাপদই আছিরে—(হাঁফছাড়ে)
পলিঃ (উচ্ছ্বসিত হয়ে) তাইতো! এই ছেলেগুলো আপনাকে দেখেই চুপ হয়ে যায়। আর আমিও শালীনভাবে চলি বলে আমাকেও কিচ্ছু বলেনা—
সুমনাঃ ঠিক বলেছো পলি, শালীন মেয়েদের সাধারণত ওরা টিজ করেনা বরং আমার মতোই সম্মান করে। এমনকি পর্দানশীন মেয়েদের সামনেও অন্যকে টিজ করতে লজ্জা পায়--। (কেয়ার দিকে তাকিয়ে) তাই পোশাকের যে কী যাদু, একটু পরীক্ষা করলে কেয়াও হাতেনাতে প্রমাণ পাবে-আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি—
কেয়াঃ (উত্তেজিতস্বরে) তা কেমনে আপা, একটু বুঝিয়ে বলেন তো---
সুমনাঃ (কেয়ার আগ্রহ দেখে মুচকিহেসে কৌতুকের সুরে) তুমি যদি কথা দাও যে, পোশাকের যাদুর পরীক্ষায় অংশ নেবে, তবেই বলতে পারি—
কেয়াঃ ঠিক আছে আপা, আমি রাজী। বলুন--
তৃতীয় দৃশ্য
[পরদিন কেয়া এবং সুমনা বোরকা পরে আর পলি আগের পোশাকেই কলেজের পথে রওনা দেয় ঠিক বখাটেদের আড্ডাস্থলের কাছে এলেই বখাটেরা ওদের তিনজনকে দেখে ভড়কে যায়। পলি ও সুমনাকে ওদের চিনতে একটুও ভুল হয়না। কিন্তু শুধু চোখখোলা আরেকজনকে চিনতেই পারেনা।]
তপুঃ ওস্তাদ দ্যাখছো নি খেল? আমাগো খেল খতম হইয়া গ্যাছে। টেডি মাইয়াও সুমনা আপাগোর লাহান পথ ধইরছে মনে অয়! দ্যাখো, দ্যাখো—হেও বোকরা পইরা আমাকে হিক্ষা দিয়া ছাড়লো গো---
নজুঃ (বিরক্তির সুরে)_ম্যালা বকিস নাতো তপু? সুমনা আপারা আইয়া পড়ছে, চুপ কর—। আর আমাগোর লাইগা টেডি মাইয়া যদি ভালাই অইয়া যায়, ছোয়াবতো আমরাও পামু ব্যাটা---
[সুমনারা বখাটেদের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। তপু, ও নজু ওদের মুখের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে কাউকে খুঁজতে থাকে এবং একে অপরের মুখের দিকে বোকার মতো বারবার তাকায়। নতুন বখাটে সাজু কিছুই বুঝতে না পেরে একবার সুমনাদের দিকে আরেকবার বন্ধুদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে থাকে]
সাজুঃ [সুমনারা পার হয়ে যাবার পর তপুর দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে ] হেই দোস্ত, পপি নাইকারে দেখাইলি কই? আর কিসব কইতাছোস দুইজনে, বুঝবার পারলাম না---
তপুঃ (সাজুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নজুর দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে) ওস্তাদ ঠিক কইছি না, টেডি মাইয়া টেডি ছাইড়া দেশী মাইয়া অইয়া গ্যাছে--। হায়হায় আমরা তো হাগোলই থাইকা গ্যালাম গো—
নজুঃ (কেয়া বোরকাপরায় নজুর মনে বেশ দাগকাটে এবং ওর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়) শোনো তপু, সাজু—অমন একখান মাইয়া আমাগো ডরে যদি হিন্দীফিল্ম ছাইড়বার পারে—তয় আমরা পারুম না ক্যান? চল-আমরাও ভালা অইয়া যাই ভাই, কী কস!!
তপু, নজু ও সাজুঃ (হাতে হাতরেখে সমবেতকণ্ঠে বলবে এবং প্রস্থান করবে) আমরা আর কোনো মাইয়ারে টিজ করুম না। আমরা কাল থাইকা ভালা অইয়া যামু----(পর্দা পড়বে)
বিষয়: বিবিধ
১১৪১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্তু আমাদের দেশের নারিরা যে কেবল হিন্দি সিরিয়ালের নকল করতে চায়।
কর্তাদের হুশ নেই বলেই এমন হচ্ছে তারা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন