নবজাতক ও চিরকুমারকাহিনী

লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ২০ জুলাই, ২০১৪, ১১:৩৩:১৭ সকাল

পূর্বপ্রকাশিতের প



ওর বড়িতেও দ্রুত ভিড় জমে যায়। সকাল আটটা বাজে প্রায়। সূর্যের তেজবাড়ার পাশাপাশি কর্মজীবী মানুষও ছড়িয়ে পড়ে চৌদিকে। কিন্তু আজ ওর কাজে যাওয়া হয়না। নবজাতককে নিয়ে গ্রামের উৎসুক মেয়েদের মধ্যেও কাড়াকাড়ি পড়ে যায় যেন। ময়নাতো রীতিমত ছেলের মা-ই বনে যায়! কোরিয়ার হাত থেকে বাচ্চাকে একপ্রকার ছোঁমেরে নিয়েই বাড়ির দিকে দে‘ ছুট। যেতে যেতে বলে, কোরিযা ভাই, বিয়াও না-ই করতে যখন ছাওয়ার বাপ হইনেন, যাও ছাওয়ার কাপড়-চোপড় কিনবার যাও। মুই ছাওযার গাও ধুইয়া আনোং।

ময়নার কথায় ভিষণ লজ্জা পায় সে। জোহর চাচার মেয়ে, বয়স ২১/২২ বছর হবে। সন্তান হয়না বন্ধ্যা; এই অপরাধে তিনবছর থেকে স্বামীপরিত্যাক্তা। কোরিয়ার কাছে ব্যাপারটা কক্ষনোই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বন্ধ্যাত্ব তো একপ্রকার চিকিৎসাযোগ্য রোগ, এজন্য ময়নার কী দোষ? তাই বলে চিকিৎসা না করে বছর যেতে না যেতেই তালাক দিতে হবে নাকি! ওর স্বামীরও তো একই সমস্যা থাকতে পারে, ময়নার গমণপথের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবতে থাকে সে। গরীব পরিবারের স্বামীপরিত্যাক্তা কন্যার দ্বিতীয় বিয়ে হয়তো সম্ভবপর; কিন্তু সমাজে বন্ধ্যানারীর স্বামী মেলাও কি সহজসাধ্য? খুব সুন্দরী না হলেও মেয়েটা মিশুক ও চঞ্চলা। যথেষ্ট হাসিখুশি এবং বিনয়ী স্বভাবাও। তবুও যৌতুকছাড়া স্বামী মেলেনা। ওর জন্য মাঝেমাঝে মনটা কাঁদে কোরিয়ার। তবে ওর আজকের ব্যবহারে ভিষণ চমৎকৃত হয় সে। কারণ আবেগের বশে অসহায় শিশুটিকে তুলে আনলেও বাড়িতে এসেই কিন্তু কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যায়। মাতৃহারা নবজাত শিশুর জন্য অবিবাহিত এক যুবক কি আসলেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে? পাড়াপড়শির নানাকথার মুখে এমন প্রশ্ন নিজেকে সে শতবার করেছে। অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, ওর একার পক্ষে একে বাঁচানো অসম্ভবপ্রায়! এসময় ময়না মাতৃস্নেহে এগিয়ে আসায় আশার আলোই খুঁজে পায় সে। বিক্ষিপ্ত ভাবনার অথৈসমুদ্রে নিজেকে হারিয়ে ফেলে কোরিয়া। সহসা জোহর চাচার ডাকে চমক ভেঙ্গে যায়–কী বাহে, ছাওয়াটার কাপড়-চোপড় আর দুধ আনো ক্যানে? ওহ্ হ্যাঁ, যাং চাচা –বলে ছুটে যায় বাজারে।

আধঘন্টা পর পোশাক, লোশন, গুঁড়োদুধ ও ফিডার মিলে প্রায় পাঁচশো টাকার খরচ নিয়ে ময়নাদের বাড়িতে হাজির। ময়না গোসল করিয়ে আদর-যত্নে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে ছেলেটাকে। অতপর নতুন পোশাক পরিয়ে বানিয়ে ফেলে এক আদরের দুলাল! দৃশ্য দেখে কোরিয়ার মনে হয়, ও যেন ময়নারই কলজের টুকরো। এমূহুর্তে নবজাতকের প্রতি ময়নার অপত্যস্নেহ ও আন্তরিকতাপূর্ণ সোহাগ দেখলে মনে হবে, এ ওরই গর্ভজাত সন্তান। কোরিয়ার অন্তরে বিষয়টি গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আনমনে দেখতে থাকে ওর কর্মকাণ্ড। উঠানে বসে ময়না বাচ্চাকে নিয়ে নিদারুণ ব্যস্ত। ওর গালে-কপালে ফুটে ওঠে বিন্দুবিন্দ ঘামের বুদ্বুদ এবং ফর্সামুখটা রোদে হয়েছে লাল! এসব দেখেশুনে আজ মনে কেমন একটা পুলক দোলা দিয়ে যায় ওর। এতদিন পর নারীর প্রতি চরম ঘৃণাবোধের স্থলে প্রবল একটা আকর্ষণ জেগে ওঠে। মনে পড়ে কলেজজীবনের স্মৃতি! ক্লামমেট কাকলী ওকে কতই না ভালোবাসতো। রঙ্গিন স্বপ্ন দেখাতো, ঘরবাঁধার স্বপ্ন? মধ্যবিত্ত পরিবারের অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে কেন যেন ওকেই পছন্দ করে এবং ভালোবাসে, ভেবে পায়না সে। গভীর প্রণয় গড়ে উঠলেও ওদের সম্পর্কটা ছিলো মূলত: ক্যাম্পাসভিত্তিক। বেপরোয়া বা আপত্তিকর সম্পর্কগড়ার পক্ষে কোনোমতেই সায় ছিলোনা কাকলীর। রক্ষণশীল পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙ্গে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রকাশ্য মেলামেশা বা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও ছিলোনা ওর। কিন্তু কোরিয়োর মন-মানসিকতা ছিলো তার উল্টো। এ নিয়েই শুরু হয় দু’জনের মতবিরোধ এবং একটা মারাত্মক ভুলেই শেষপর্যন্ত সম্পর্কচ্ছেদে গড়ায় ব্যাপারটা!



এইচএসসি দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রছাত্রী দু'জনেই। একদিন টিফিনে কোরিয়া কাঁঠালতলায় ডেকে বসায় কাকলীকে। এ-ই কাকলী, আজ এখানে কেনো বসলাম জানো?

-নাতো—? আবার কোনো কুমতলব নাকি—– কাকলী খোঁচা মারে।

-আরে নাহ, তুমি শূধুশুধু সন্দেহ করো! আচ্ছা কাকলী, তুমিতো অন্যদের মতো আমার সাথে সিনেমায় যাওনা বা ঘুরেও বেড়াও না? এমন নিরস প্রেম কেউ করে নাকি, তুমিই বলো? কোরিয়ার অভিমানী প্রশ্ন।

-অবশ্যই করে, আরে সত্যিকার ও পবিত্র প্রেমতো এমনই হয়। ভদ্রঘরের সন্তানরা প্রেমের নামে বেলেল্লাপনা-বেপরোয়া কাজ করতেই পারেনা, তা বোঝোনা কেনো?

-বাঃ রে, একাত্ম দুটো মন একত্রে ঘুরবে, স্ফূর্তি করবে; এতে বেলেল্লাপনার কী আছে, কেরিয়া ঘোরতর আপত্তি জানায়।

-কেনো, তুমিই বলো আমরা স্বামী-স্ত্রী নাকি যে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরবো! এসব করতে গিয়েই তো প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকা ধর্ষিতা হয়, প্রেমিক কর্তৃক অবৈধ গর্ভধারণ এবং সন্তানের পিতৃপরিচয়ের দাবীতে প্রেমিকার দূর্গতির খবর পড়োনি পত্রিকায়? তাছাড়া প্রেমের নামে অবৈধ সম্পর্কগড়ার পর বিয়ে করতে অস্বীকার করায় প্রেমিকার আত্মহত্যার খবরতো প্রায়ই শোনা যায়—

-ওরে বাপরে, থামাও থামাও তোমার লেকচার, অধৈর্য হয়ে কাকলীকে বাধা দেয় সে– তোমার একটাই দোষ, ধর্ম মেনে যে প্রেম হয়না তা তুমি বুঝতেই চাওনা?

-ঠিক আছে, তুমিই বোঝো আমি ক্লাশে চললাম, বলে রাগে গড়্গড়্ করে চলে যায় কাকলী।



-এইযে ছাওয়ার বাপ, হঠাৎ ময়নার ঠাট্টায় স্রোতস্বিনী ভাবনায় ছেদ পড়ে যায় ওর। ছাওয়াটার একনা ভাল্ নাম থোয়ার কথা ভাবেন বাড়িত্ যায়য়া, মুই ইয়াক দুধ খোয়য়া দিয়া আসিম এ্যালা— বুঝনেন?

-ধুর্ ময়না, তুই এইগ্লা কী কইস্, এ্যাঁ—লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে যায়–ঠিক আছে মুই গেনু বলে চলে যায় কোরিয়া।

ওদের দু’জনের বাড়ির পারস্পারিক দূরত্ব তিনশো গজ প্রায়। সকাল এখন এগারোটা বাজে। ভাগ্যিস, আজ ভোরে নাস্তাসহ দুপুরের ভাত একত্রেই রেধে রেখেছে। গ্রামের মানুষ এবং ঝামেলা কম বলে সকালের নাস্তা হিসেবে প্রায়শ: ভাতই খায়। বেশীর ভাগক্ষেত্রে সকালেই দুপুরের তরকারীও রেধে রাখে। কোনদিন রাঁধতে না পারলে ডিমভাজি ও আলুভর্তা দিয়েই দিব্যি চালিয়ে নেয়। আজ এসব ঝামেলায় তরকারী রাঁধতে পারেনি বলে চিন্তায়ও পড়ে যায়। ময়না ছেলেটাকে দিয়ে গেলে রান্নার আর সুযোগই পাবেনা বলে তড়িঘড়ি তরকারী রান্নায় নেমে পড়ে সে। ছয়টা দেশী-বিদেশী মুরগী আছে বলে ওর ডিমের অভাব হয়না। তিনকাঠার বাপের ভিটিতে আট-দশটা আম-কাঁঠালের গাছও আছে। টিনের একটা ঘরে সে ঘুমায় আরেকটা ঘরে মালামার থাকায় সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। আরেকটা হচ্ছে রান্নাঘর। টিউবয়েলের পানি আনতে গিয়ে নজরে পড়ে দুটো মোরগ-মুরগীর অভিসারের দৃশ্য। কেন যেন হাসি পায় ওর, ভাবে–পৃথিবীতে এই জিনিসটাই যত অঘটনের মূল! নতুবা মাথায় কী চাপলো, আর অমনি বেসামাল হয়ে কাকলীকে জড়িয়ে ধরবোই বা কেন? ছিঃ ছিঃ সব দোষতো আমার, কাকলীর কী দোষ? আর ছ্যাঁক খেয়ে বিয়ে করিনি বলে সবাই ডাকে আজ চিরকুমার! বয়সও তো ত্রিশ পার হতে চললো, এভাবে আর কদ্দিন—একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার রান্নাঘরে ঢোকে কোরিয়া। অতঃপর চুলায় ডিমচড়িয়ে পুনরায় তলিয়ে যায় ভাবনার অথৈ সাগরে। (চলবে)

আগের পর্ব এখানে দেখুন

বিষয়: বিবিধ

১১২৮ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

246237
২০ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০১:১৭
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২০ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০১:৩৬
191156
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ Good Luck
246242
২০ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০১:১৮
চোথাবাজ লিখেছেন : দারুনস। চলুক
২০ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০১:৩৬
191157
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভাল্লাগায় আমিও খুশি ভাই
246271
২০ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:১৩
আমির হোসেন লিখেছেন : ভালো লাগলো
২০ জুলাই ২০১৪ দুপুর ০৩:৪১
191183
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ধন্যবাদ
246319
২০ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০৬
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : সুন্দর লিখেছেন ,অনেক ভালো
২০ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৯
191227
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদGood Luck Good Luck Good Luck
246440
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:১২
মু. মিজানুর রহমান মিজান (এম. আর. এম.) লিখেছেন : বেশ ভালোই লিখেছেন ভাই।
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:৫২
191353
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভাল্লাগায় আপনাকে অনেক ধন্যবাদGood Luck Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File