নবজাতক ও চিরকুমারকাহিনী

লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ২০ জুলাই, ২০১৪, ১২:৩৫:৪২ রাত



রোজকার মতোই সদ্যজাত শিশুর ন্যায় মিষ্টিরঙ ছড়িয়ে অন্ধকার মাতৃজঠর ফুঁড়ে ধীরেধীরে উঠতে থাকে সূর্য। চারদিকের সবুজ গাছ-গাছালি, বাড়িঘর আর চলমান মানুষগুলোর মুখমন্ডলে ছড়িয়ে যায় তার মোহময় লালিমা! মানুষের শরীরে পতিত সেই গাঢ় আভা সৃষ্টি করে এক অনিন্দ্য-অনির্বচনীয় আবহ। এখন অগ্রহায়ণমাস হলেও রাত আর ভোরের দিকে কিছুটা শীতশীত লাগে। এবার হয়তো তাড়াতাড়িই নামবে শীত? ঠান্ডা আমেজে মিঠে-রোদমাখা পরিবেশ কোরিয়ার মনে ভালোলাগার একটা ভাবামত্মর সৃষ্টি করে। কিন্তু কিসের শোরগোলে হঠাৎ তার সব ভাবান্তর একেবারেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এই সাত-সকালেও দেখা গেলো, তাসু মাস্টারের বাড়িসংলগ্ন গলিতে কৌতুহলী মানুষের বিরাট জটলা! বড়রাস্টার ধারে সদর হাসপাতালের পাশেই গলিটা। কী ব্যাপার, এত ভিড় কেনো? নতুন একটা কৌতুহল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মনে। অতএব সে-ও ঢুকে পড়ে ভিড়ের ভেতর। চাক্ষুস দেখার আগেই একজন বৃদ্ধের কথায় বুঝতে বাকি থাকেনা তার, আহারে– মাসুম ছাওয়াটার কী হইবে এ্যালা?

-ক্যানে জারুয়া ছাওয়ার যা হয়, তা-ই হইবে- আরেকজনের মন্তব্য!

- বাবা-মা থেকেও যার কেউ নেই, তাকে জারজ বলবেন না প্লিজ –তৃতীয়জন মৃদূপ্রতিবাদ করে।

-আরে, ইয়ার দোষ কোনটে বাহে। যামরা আকাম-কুকাম কইরছে, তামরাই তো আসল জারুয়া! নয়তো নাড়ীছেঁড়া ধনোক কাও কি রাস্তাত ফ্যালে দ্যায়, বাবা? প্রথমজন আবারও ক্ষুব্ধপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

এধরণের কানাঘুষা ও বিক্ষিপ্ত মন্তব্য শুনে কোরিয়ার নরম মনটা সমবেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। ফলে সোৎসাহে ভিড় ঠেলে দ্রুত ছুটে যায় নবজাতকের দিকে। সকালের ঠান্ডা আবহাওয়ায় অনাবৃত শিশুটি জড়সড় হয়ে থত্থরে কাঁপছে। কী ফুটফুটে চেহারা! এমন জ্যান্ত মায়াময় ফুলকেও কেউ কফ-থুথুর মতো ছুঁড়ে ফেলতে পারে, কল্পনা করতেও কষ্ট হয় ওর। নিজে মাতৃহারা বলেই হয়তো পরিত্যক্ত ক্ষুদেমানবটির অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়। কিন্তু নিষ্পাপ শিশুটিকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্যেও কষ্টটা আরও বাড়ে। সকালের লালিমায় ক্ষুদে শরীরটা কাশ্মীরি আপেলের রঙ ধরেছে। এমন শিশুকে মানুষমাত্রেই কোলে না নিয়ে পারেনা। অথচ লোকগুলো কী নির্দয়, একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথেসাথে ওর চোখ ছলছল করে ওঠে। বাচ্চাটার হাত-পা ছোঁড়া দেখে মন চায়, এক্ষুনি কোলে তুলে নেয়। পরক্ষণে থমকে দাঁড়ায়, সে যে অবিবাহিত? একে নিয়ে করবেইবা কী ? ভাবনার ঘূর্ণিস্রোতে কখন যে শিশুটির কাছেই চলে এসেছে, টের পায়নি।



এইযে ভাই, বাচ্চাটা নেবেন নাকি ? নিন না, আল্লাহ আপনার ভালোই করবেন—র্শীণদেহী সম্ভবত অভাবগ্রসত্ম লোকটির অনুরোধে ভাবনায় ছেদ পড়ে ওর। পরমূহুর্তে সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পরমযত্নে কোলে তুলে নেয় নবজাতককে। সন্তানের ওপর পিতৃস্নেহ কিরূপ, তা সে জানেনা। কিন্তু নবজাত শিশুটিকে পেয়েই চোখে-মুখে ফুটে ওঠে চরমানন্দের ছাপ! ভিড় ততক্ষনে আরও বাড়ে। কোরিয়া, এই কোরিয়া–একি করছিস তুই? ক্লাশমেট ও প্রতিবেশি কামালের প্রশ্নে পেছন ফেরে সে– তুই না, চিরকুমার? কে লালন-পালন করবে ওকে—-

-কেনো, আমি—?

-কিন্তু তোর বাড়িতে তো মা-বাবা, ভাইবোন কেউ নেই। কিভাবে বাঁচাবি একে–কামাল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।

-ওসব বুঝিনা, আমার নজরে যখন পড়েছেই, ফেলে যেতে পারবো নারে ভাই। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা, বলেই হনহন করে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে।

ওর কান্ড দেখে কমবেশি সবাই বাহবা দিতে থাকে। দুয়েকজন বেরসিক বিরূপ মন্তব্য করতেও ছাড়েনা- ব্যাটা আস্তপাগল, নইলে বউ নেই-আবার বাচ্চার সখ?। একজনতো বলেই বসে, দেখেন গিয়ে ওরই কুকর্ম কিনা। এমন অনেক কথাই কানে যায় ওর। কিন্তু শেষের বাজে মন্তব্যে গায়ে যেন আগুণ ধরে যায়! মন চায়, গলাটিপে মেরে ফেলে ব্যাটাকে। কিন্তু অনেক ভেবেচিন্তে সামলে নেয় নিজেকে। মনেমনে বলে, সবই জানো তুমি আল্লাহ, কেনো নিলাম ছেলেটাকে। অথচ তোমার বান্দাদের মুখের কোনো লাগাম নেই, খোদা?

জুম্মাপাড়া গ্রাম এখান থেকে মাইল দেড়েক পথ। বড়রাস্তা ধরে আনমনে হাঁটে সে। লালমনিরহাট-ঢাকাগামী পরিচিত একটা বাস পাশ দিয়ে প্রচন্ড গর্জনে ছুটে গেলেই সে বুঝতে পারে, বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। ওর বাপ মরেছে শৈশবে আর মা এইচএসসি পাশের পর। দু‘ভাইবোনের অভাবী সংসারের হাল তখন তাকেই ধরতে হয়। ডিগ্রিপরীক্ষা দেয়া হয়না আর। বিবাহযোগ্য ছোটবোনের চিন্তাতেই দিশেহারা অবস্থা। বাড়িভিটে ছাড়া কিছু রেখে যায়নি গরীব বাপ। ফলে কলেজের পাঠচুকিয়ে নেমে পড়ে অর্থের ধান্ধায়। একসময় চাকরির আশা ছেড়ে বিদ্যুতের কাজ-কর্ম রপ্ত করে ফেলে। বিদ্যুতমিস্ত্রির কাজ করে এখন ভালোই চলে একার সংসার। বোনটির বিয়ে দেয়ার পর পাঁচবছর যাবৎ নিজেই রেঁধেবেড়ে খায় সে।

-ওটা কার ছাওয়া বাহে, কোরিয়া? জোহর আলী চাচার প্রশ্নে থমকে দাঁড়ায় হঠাৎ।

-রাস্তাত্ পানু চাচা, কোন্ জানোয়ারের বাচ্চা জানি ফ্যালে থুইয়া গেইছে! এতক্ষণেই অবৈধ জন্মদাতাদাত্রীর প্রতি জমে থাকা ক্ষোভটা ঝাড়ে সে। (চলবে)

বিষয়: বিবিধ

১০৮২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

246152
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ১২:৪৯
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২০ জুলাই ২০১৪ সকাল ১০:৫৬
191122
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভাল্লাগায় আপনাকেও ধন্যবাদ Good Luck
246170
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ০২:১৬
চোথাবাজ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২০ জুলাই ২০১৪ সকাল ১০:৫৬
191124
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : অনেক সুভেচ্ছা জানাই Good Luck Good Luck Good Luck
246182
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:৪২
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো
২০ জুলাই ২০১৪ সকাল ১০:৫৬
191126
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : খুব ভাল্লাগায় আমি খুশি

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File