কমন স্যার এবং আহত বেদনা
লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ১৯ জুলাই, ২০১৪, ১০:৩২:৩০ সকাল
শেষ পর্ব
নুরুল হুদার কথামতো কায়েস এখন আর প্রেমসঞ্জাত প্রাপ্তিযোগে আপত্তি না করে বিনা বাক্যব্যয়ে সবকিছু খেয়ে নেয়! কিন্তু মানুষতো ফেরেস্তা নয় যে, প্রচন্ড গতিশীল হৃদয়কেও সহজে লাগাম পরিয়ে দেবে ? ফলে মনের অজান্তে তারও দুর্বলতা তৈরী হয়ে যায়। রহস্যময়ী মেয়েটাকে দেখারও সাধ জাগে মনে। বিশেষ করে শিউলীর চাচাসম্পর্কের একজন মুরুব্বী যেদিন সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন, সেদিন থেকে কেমন একটা ভাল্লাগাভাবও অন্তরে দোলা দিতে থাকে। বিবেক তাকে প্রতিনিয়ত শাসালেও উদগ্র বাসনা দিনদিন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। এমন যুক্তিও মনে হানা দিতে শুরু করে, বিয়ে করতে হলে পাত্রীতো দেখতেই হবে? সেই দেখাটা শিউলীকেই দেখিনা কেন ? অবশেষে তার সুপ্ত প্রেমিক মনেরই জয় হলো। একবিকেলে পরিকল্পনামতো সংগোপনে সে বাসায় ঢোকার সময় দেখে নেয় শিউলীকে। মানানসই সেলোয়ার কামিজের পাশাপাশি আকর্ষণীয় ওড়নায় মাথাঢাকা থাকলেও মিষ্টি মুখখানা চিনে নিতে একটুও কষ্ট হয়না। সুশ্রী মুখচ্ছবিটা যেন অন্তরে একদম আঁকা হয়ে যায়। এরপর অবশ্য একদিনমাত্র মুখোমুখি দেখা হয় দু’জনার, সেও দৈব্যক্রমে। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে মেসের গলিতে বাঁক নিতেই দেখে, সেই অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানা। ওদের গেটের সামনের বড়রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিক্সা বিদায় করছে। হঠাৎ চোখাচোখি আর মুচকী হাসির বিনিময় হয়ে যায় আরকি!
সময় থেমে থাকে না। বরং বছরখানেক যেন দ্রুত কেটে যায় শিক্ষকজীবনের। প্রতিমাসে লালমনিরহাটে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের দেখে আসে কায়েস। সাতবছর যাবত সে তাদের ভরন-পোষন করে। সে এক করুণ ইতিহাস। তখন সবেমাত্র পঞ্চমশ্রেণীর ছাত্র সে। মা’র অসুস্থতার অজুহাতে তার প্রিয়বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বসেন। শীঘ্র অসুস্থ মা আরোগ্যলাভ করলেও সর্বনাশ যা হবার তা হয়েই যায়। সন্তানবাৎসল্য পিতার মতিগতির অস্বাবিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে তাদের বিমাতার মন জুগিয়ে চলাছাড়া আর গত্যন্তর থাকেনা। অন্যথায় শারিরীক নির্যাতন কিংবা আরোপিত অনশন হয়ে দাঁড়ায় তাদের ভাগ্যলিপি। সৌভাগ্যবশত: প্রাথমিক ও জুনিয়রবৃত্তি পাওয়ায় এসএসসি র্পযন্ত পড়াশুনাটা স্বাচ্ছন্দে চালিয়ে নিলেও ইন্টারমিডিয়েটে এসে সব লণ্ডভণ্ড হয়। দুঃখিনী মায়ের বুকফাঁটা কান্নাও তাদের বিপর্যয়রোধ করতে পারে না। একতরফাভাবে জুদা করে দেয়া হয় তাদের । সুতরাং সমস্ত ভরন-পোষণের দায়ভার এসে চাপে জাগ্রতবিবেক কিশোর কায়েসের ঘাড়ে। তখন থেকে অবিরাম টিউশনী হয় তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। পাশাপাশি ডাক্তারী পড়ার সপ্নসাধকে চিরবিসর্জন দিয়ে কোনমতে এমএ পাশের পর তাকে ছুটতে হয় যেনতেন একটা চাকরীর পেছনে।
চলতিমাসেও বেতন নিয়ে বাড়ী চলে যায় সে। দু’দিন পর আজই চলে আসে ভারাক্রান্ত মনে। মা’র খুব অসুখ, মরণাপন্ন অবস্থা। বহু টাকার দরকার। মা কি তবে বিনাচিকিৎসায় মরে যাবে- মনে তার কাঁন্নার প্রবল উচ্ছ্বাস! এ মুহুর্তে সোনালী-মধুর বিকেলটাকে কেন যেন মনে হয়, তার মায়েরই পান্ডুর মুখ। শিউলির মায়াভরা মুখ কিংবা মধুর স্মৃতিগুলোও ভাল্লাগে না আর। অতএব কাপড়চোপড় পাল্টিয়ে বের হয়ে পড়ে টাকার ধান্ধায়।
ঠিক এশার নামাজের পর মেসে ফেরে সে। অবসন্ন-ক্লান্ত দেহটা ঘুমাতে চায় কিন্তু ঘুমের বদলে রাজ্যের টেনশন তাকে কুরেকুরে খেতে থাকে। কাঙ্খিত অর্থের জোগার হয়নি এখনো। খুব ভোরে আরেকবার বেরোতেই হবে। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকে যতসব আকাশ-পাতাল। মাস্টার সাব, আছেন নাকি- রহিম চাচার ডাকে চিন্তার জাল সহসা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ইনি শিউলীর আত্মীয়, বেশ রাশভারী লোক।
: চাচা আছি, আসেন ভেতরে আসেন, কায়েস ঝটপট স্বাভাবিক হয়ে সাড়া দেয়।
: কী ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি এলেন যে এবার, বাড়ীর খবর ভালোতো?
: ইয়ে, মানে হ্যাঁ চাচা- কী বলবে জবাব খুজে পায়না সহসা।
: তা, জরুরী একটা ব্যাপারে এলাম। আপনিতো আবার ক্লান্ত- তিনি কথাপাড়ার মওকা খোঁজেন।
: না–বলুন অসুবিধে নেই, কথাকেড়ে নিয়ে সম্মতি দেয় কায়েস।
: তাহলে মেসে নয় বাইরে চলুন- এ প্রস্তাবে ঘাবড়ে যায় সে। কী বলবেন ইনি, কিসের জরুরী কথা? অনাহুত টেনশনে ঢিবঢিব করতে থাকে বুক। মুর্হুতে অন্যজগতে চলে যায় সে। এমনকি অসুস্থ মায়ের কাতরানীর কথাও ভুলে যায় সে, এ-ই তার দোষ। কেউ জরুরী কিছু বলার আভাস দিলেই হলো- না শোনা পর্যন্ত বুক দুরুদুরু বাড়তেই থাকবে। শিউলীর ব্যাপারে কোন অভিযোগ নয়তো- সন্দেহটা অন্তরে উঁকি দেয়ামাত্র একটা অপরাধবোধও জাগে তার মনে।
: কথা হলো কী, শিউলীর তো বিয়ের কথাবার্তা চলছে? আপনি, মানে শুনেছিলাম- আমতা আমতা করেন চাচা। কায়েসের নাড়ীর গতিও বেড়ে যায় যেন। হ্যাঁ, শুনেছিলাম শিউলী আপনার ব্যাপারে খুব আগ্রহী আর আপনিও নাকি অর্থাৎ আপনার মতামতটা আরকী- তার শেষকথায় মাটিতে মিশে যাবার অবস্থা কায়েসের। তবু নিজেকে সামাল দিয়ে দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। নাহ- এভাবে আর লুকোচুরি নয়। শিউলীর স্মৃতিগুলো এমূহুর্তে কেন যেন বিষের ফলার মতো বিঁধতে থাকে হৃদয়ে। এক্ষণে সবকিছু ছাপিয়ে মৃতপথাযাত্রী মায়ের ফ্যাকাশে মুখটাই আবার চোখের সামনে ভাসতে শুরু করে। হ্যাঁ- তাকে মায়ের মুখেই হাসিফোটাতে হবে আগে? প্রবল দ্বন্দ্বে পড়ে অথৈই সাগরে কিছুক্ষণ হাবুডুবু খায় সে
: কী মাস্টার, চুপ থাকলেন যে, কিছু বলেন- চাচার প্রশ্নে বাস্তবতায় ফিরে আসে আবার।
: জ্বী চাচা, আসলে কাউকে ভালোলাগাটা দোষের কিছু নয় বরং স্বাভাবিক। কিন্তু আমার অবস্থাতো জানেন, নিতান্ত বাধ্য হয়ে সামান্য বেতনের চাকরী করি। মানে, বুঝতে পারছেন বয়স হলেও বিয়ের কথা এখন ভাবছিনা। এতটুকু বলে কায়েস এমন একটা দূর্বোধ্য অথচ অস্ফুটহাসি ছড়িয়ে দেয়, যার মর্মোদ্ধার বড়ই কঠিন।
: এই কথা আপনার? রহিম চাচার কন্ঠে আহত বিস্ময়, বহুত ধন্যবাদ, খুশি হলাম শুনে- এ বলে যেন কিছুটা ঘৃণাচ্ছলেই হন্ হন্ করে চলে যান তিনি।
কখন ফজর নামাজ শেষ হয়েছে। লাল টুকটুক শাড়ীপড়া সূর্যটা সবেমাত্র পূর্বাকাশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আজ নিত্যদিনের চেয়ে একঘন্টা আগে নাস্তা আসার কথা। তীর্থের কাকের মতো তাই অপেক্ষায় আছে কায়েস। এক্ষুনি টাকার খোঁজে বেরোতে হবে। অতপর ধরতে হবে আটটার বাস। চরম উৎকণ্ঠায় কাঁপছে যেন। এমন সময় কাজের লোক নাস্তা নিয়ে হাজির। ভূতদেখার মতোই চমকে ওঠে সে। আরে, ইনিতো নাস্তা দেননা কখনো- ! মনে পড়ে, প্রথমদিকে দু’একদিনমাত্র এ বৃদ্ধলোকটি খাবার নিয়ে এসেছেন। এরপর আর কোনদিন আসেননি।
: আজ হঠাৎ আপনি যে, সুমিরা কেউ নেই নাকি- অকস্মাৎ মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় প্রশ্নটা। না বাহে, সগায় (সবাই) আছে, শিউলীই ওমাক (ওদের) আইসপার (আসতে) দিল না। ওমরা (ওরা) আর আইসপার (আসবে) নয় (না)। এ্যালা (এখন) থাকি মুই আসিম (আসবো)– বৃদ্ধ একটানে বলে যান কথাগুলো।
: কেন কী হয়েছে– তাজ্জ্বব বনে যায় যেন? ততক্ষণে মনেমনে কিছু একটা অাঁচও করতে পারে বোধ’য়।
: কী জানি বাপু(বাবা) কাইল আইত(রাত) থাকি শিউলী মা’র যে কী হইছে, কবার(বলতে) পাংনা(পারিনা)। মনটাও খুব খারাপ। আইতোৎ(রাতে) শুতি শুতি (শুয়েশুয়ে) কাঁনছেও(কেঁদেছেও) ম্যালা(অনেক)। আচ্ছা বাহে- মুই গেনু(গেলাম) বলে আর দাঁড়ান না তিনি। সংগে সংগে কায়েসের অন্তরটাও আহত বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। সেখানে বয়ে যায় প্রবল জলোচ্ছ্বাস এবং প্রচন্ড একটা ঝড়!! (সমাপ্ত)
আগের পর্ব
বিষয়: বিবিধ
১০৬৫ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন