তোমার হৃদয়ে আমি গরু হয়ে ঘাস খাই-৫(ছন্দ প্রকরণ)
লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ২৬ মে, ২০১৪, ১২:৫৭:২৭ দুপুর
তোমার হৃদয়ে আমি গরু হয়ে ঘাস খাই
ল্যাম্পোস্টকে জড়িয়ে বলি- ডার্লিং !!!!
ওপরের লাইনদুটো উচ্চাংগের গদ্যকবিতাংশ, যা মুক্তছন্দে লেখা। এটি মুক্তছন্দে লেখা হলেও কিন্তু ছন্দোবদ্ধ লাইন। এখানে ছন্দ আছে তবে অন্তমিল নেই। অল্পকথায় এই হলো মুক্তছন্দের বৈশিষ্ট্য।
মুক্তছন্দ বনাম গদ্যকবিতা
মুক্তছন্দ সম্পর্কে আলোচনা এ পর্বেই শেষ করবো এবং মুলছন্দ নিয়েই আমরা সামনে এগোবো। আমরা পদ্যের নাম শুনেছি, পাঠ্যবইয়ে দেখেছি পদ্যাংশ আর গদ্যাংশের বিভাজন। কবিতা-ছড়া ইত্যাদি যে অধ্যায়ে থাকে তাকেই জেনেছি পদ্যাংশ বলে, তাইতো?
তবে মুক্তছন্দের পাশাপাশি গদ্যকবিতার নামও অনেকে শুনেছি। গদ্য আর পদ্য'র মাঝখানে গদ্যকবিতা আবার কী জিনিস এবং গদ্যের আবার কবিতা হয় নাকি? জ্বি হয়, তবে তাও রীতমত মুক্তছন্দের কবিতা এবং কবিতার সব গুণই থাকে শুধু অন্তঃমিল ব্যতিরেকে। যদিও এই গদ্যকবিতার নামের আড়ালে পত্রিকার কলামের মতোন কিছু লাইন সাজিয়ে ছন্দহীনভাবে যা লেখা হয়, তা আদৌ গদ্যকবিতা পদবাচ্য নয়?
আগেই লিখেছি-কবিতার মতো কঠিন ব্যাকরণের মানসম্মত শিল্প তৈরি করা এতোই সহজ হলেতো সবাই লিখতে পারে কবিতা-ছড়া-গান পদ্যের আদলে বা পত্রিকার কলামের মতোন সাজিয়ে নিজেদের চিঠিপত্র, বাজারের লিস্টসমূহ দিয়েও? তাই অনেকেই হয়তো ভাববেন, তাহলে তো কবি হওয়া খুবই সহজ! এখানেই আমার মতো অনেকেরই আপত্তি যে, মুক্তছন্দে যেমন ছন্দ শব্দটা লাগানো আছে, গদ্যকবিতায় যেমন কবিতা শব্দটা যুক্ত আছে, তাহলে বুঝতে কি বাকি থাকে যে, ছন্দ আর কবিতা-ছড়া-গান পরস্পর ওতপ্রোতভাবেই জড়িত।
অর্থাৎ ছন্দই কবিতার প্রাণ আর কবিতা-ছড়া-গান মানেই ছন্দের খেলা? ছন্দছাড়া নিছক গদ্যই রচিত হতে পারে কিন্তু কবিতা-ছড়া-গান আদৌ নয়।
ছন্দ কী?
গাড়ির আগে ঘোড়া বা ঘোড়ার আগে গাড়িজোড়ানোর মতোই আমি আগে ছন্দসম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা দিলেও ছন্দ কী, তার তাত্ত্বিক বা একাডেমিক আলোচনা করিনি। কারণ আমরা যেমন-ব্যাকরণ পড়ে তবেই বাংলাভাষা শিখিনি তেমনই ছন্দের ব্যাকরণ আগে পড়লে বা জানলেই যে, ছন্দবিশেষজ্ঞ বা কবি হওয়া সহজ হয়, তা আমি বিশ্বাস করিনে। আমার অভজ্ঞতায় বেশি বেশি ছড়া-কবিতা-গান পড়লে ও আবৃত্তি করলেই ভাষারপ্তের মতোই ছন্দও রপ্ত করা সম্ভব। এরপর ছন্দসম্পর্কে পড়াশোনা করলেই ভালো কবিতালেখার ক্ষেত্র তৈরি হওয়া একদম সহজ হয়ে যায় আরকি?
তাই এবার ছন্দসম্পর্কিত হালকা আলোচনা করতে চাই-যাতে পাঠক বিরক্ত না হয়ে বরং মজা পায়।
ছন্দঃ কাব্য-কবিতা-ছড়া-গানের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে অনুভবযোগ্য অদৃশ্যমান সৌন্দর্য বা রিদম বা ঢেউ সৃষ্টি হয়, তাকেই ছন্দ বলা হয়। ছন্দ কখনোই দেখা যায় না তবে অনুভবে হৃদয়-মনে নৃত্য বা আলোড়ন বা আনন্দের দোলা তৈরি করে। যেমন মসৃণ পিচঢালা রাস্তায় গাড়িতে চালাতে যে, সুখ ও আনন্দ পাওয়া যায়, তা কি অমসৃণ ও বন্ধুর পথে চালিয়ে পাওয়া যাবে? নাকি অস্বস্তি ও বিরক্তিতে ভরে যাবে মন!!
ছন আর ছন্দহীনতার মাঝেও ফারাকটা সেরকমই আরকি? আমার একটা ছোট্ট ছড়া দেখুন তাহলে--মনে ছন্দের দোলা বা ঢেউ সৃষ্টি হয় কিনা?
শংকা রে!
ছন্দসুরে বিষ্টি নামে
বিষ্টি নামে বর্ষাতে
ছোট্ট রুমু খেলতে যাবে
বলোনা কোন্ ভরসাতে?
বিষ্টি নামে গানের তালে
গানের তালে ঝংকারে;
আজকে বুঝি হয়না খেলা
রুমুর মনে শংকা রে!!
পর্ব, অতিপর্ব ও উপপর্ব:
কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হলো পর্ব। পঙ্ক্তিশেষের পর্বাংশকে অতিপর্ব বলা হয় যার মাত্রাসংখ্যা পর্বের মাত্রাসংখ্যা থেকে সর্বদাই কম। এ ধরনের পর্বাংশ লাইনের শুরুতে থাকলে আমরা তাকে উপপর্ব বলে চিহ্নিত করবো।
যেমনঃ নিচের চারটি লাইনের একেকটি পর্বকে (/) চিহ্ন দিয়ে আলাদা করে দেখানো হয়েছে।
ছন্দসুরে/বিষ্টি নামে (এখানে ২টি পর্বমাত্র)
বিষ্টি নামে/বর্ষাতে (১মটি পর্ব, ২য়টি অতিপর্ব)
ছোট্ট রুমু/খেলতে যাবে (এখানে ২টি পর্বমাত্র)
বলোনা কোন্/ভরসাতে? (১মটি পর্ব, ২য়টি অতিপর্ব)
আশা করি পর্ব ও অতিপর্ব পরিস্কার হয়েছে। উপপর্ব সম্পর্কে সামনে জানা যাবে।
ছন্দের ভেতরে প্রবেশের আগে শব্দের শরীর সম্পর্কে জানতে হবে; তবে এর পূর্বে জানা দরকার স্বর বা ধ্বনি (Sound) কী? আর স্বর বা ধ্বনি (Sound) জানার পর শব্দের শরীর সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বাংলাস্বর বা ধ্বনিকে (Sound) দু'ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ১.বদ্ধস্বর ও ২. মুক্তস্বর
বদ্ধস্বর: যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় জিভ মুখের প্রবহমান বাতাসকে আটকে দেয়, তাদের বদ্ধস্বর বলা হয়। যেমন : ধর, পর, পড়, হায়, যাক, আঁক, থাক, দিন, ক্ষীণ, বই, ছই ইত্যাদি।
মুক্তস্বর: যেসব ধ্বনি উচ্চারণের সময় মুখের প্রবহমান বাতাস জিভের কোনো বাধা ছাড়াই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে, তাদের মুক্তস্বর বলে। যেমন: খা, হা, না, যা, মা, কা, হো, চা, গো, দি, লো, বা,প, বু ইত্যাদি।
তাহলে আলোচনা শব্দটিকে এখন বিশ্লেষণ করা যাক; এখানে আ+লো+চ+না এর মধ্যে বদ্ধস্বর একটিও নেই সবই মুক্তস্বর। আর পড়লাম শব্দের পড়+লাম এর মধ্যে দুটোই কিন্তু বদ্ধস্বর।
আপনারাই এখন ধ্বনিগুলো উচ্চারণ দেখুন যে, মুক্তস্বর উচ্চারণে জিভের বাধাছাড়াই বাতাস মুক্তভাবেই বেরিয়ে যেতে পারে আটকে যায়না। আর বদ্ধস্বরে জিভ মুখের চলমান বাতাসকে কিভাবে আটকে দিচ্ছে বলে সামনে আর এগোনো যায়না।
ছন্দের মূল আলোচনায় আসার আগে আরো একটি বিষয় জানাও জরুরি, নতুবা ছন্দ বুঝতে কঠিন হবে। তা হলো “মাত্রা”; তাই স্বর জানার পর মাত্রাসম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞানার্জন সহজ হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
বাংলা কবিতার সব ছন্দেই একটি মুক্তস্বর একটিমাত্র মাত্রা বহন করে। বিষয়টি ঠিক ইংরেজি সিলেবল (Syllable) এর মতোন, মুক্তস্বরে একবর্ণে একমাত্রা। কিন্তু একটি বদ্ধস্বর কখনো একটি আবার কখনো দু’টি মাত্রা বহন করে। কিছুটা ইংরেজির Di-Syllable এর মতোন।
তাই মাত্রার আলোচনার আগে আরো জেনে নেয়া দরকার যে, বদ্ধস্বর কোন অবস্থায় একটি এবং কোন অবস্থায় দু’টি মাত্রা বহন করে। যদিও তিনটি মুলছন্দের আলোচনার ভেতরেই আমরা এ বিষয়টি খুঁজে পাবো আশা করি।
এবার ওপরে আমার ছড়ার ছন্দবিন্যাস লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, প্রতিটি পর্বের মাত্রাসংখ্যা চার, এবং অতিপর্বের মাত্রাসংখ্যা তিন। এই কাব্যাংশে কোনো উপপর্ব নেই। অতিপর্ব সম্পর্কেও আমরা সামনে পর্যায়ক্রমে জানবো।
নিচে ফররুখ আহমদ এর সাত সাগরের মাঝি কবিতার কিয়দাংশ দেখুনঃ
কত যে আঁধার/পর্দা পারায়ে/ভোর হল জানি না/তা।
নারঙ্গি বনে/কাঁপছে সবুজ পা/তা।
দুয়ারে তোমার/সাত সাগরের জো/য়ার এনেছে ফে/না।
তবু জাগলে না?/তবু, তবু/তুমি জাগলেনা?
এখানেও এই (/) চিহ্ন দিয়ে পর্ব, অতিপর্ব ও উপপর্বসহ মুক্তস্বর ও বদ্ধস্বরের মাত্রা বিভাজন করে দেখানো হয়েছে। এখন একটু মাথা খাঁটিয়ে ভাবুন, গবেষণা করুন পানির মতোই মনে হবে সব।
(চলবে)
যারা মিস করেছেন--
১নং পর্ব
২নং পর্ব
৩নং পর্ব
৪নং পর্ব
বিষয়: বিবিধ
১৮২৯ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ব্যাকরণের সিলেবলকেই একটু আলোচনা করেছি কবিতার স্বর বা ধ্বনিকে বোঝাতে।
শিরোনাম দেখে বুঝার উপায় নাই যে ভিতরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ।
সুন্দর পোষ্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
আর শেষে মিল না থাকলে যেন মনে হয় সেটা কবিতাই হয়নি। জানি এটা আমার ভুল ধারণা। তবুও মাঝে মাঝে মিলিয়ে মিলিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে। এই যে একটা লিখে ফেললাম। এটাকে মনে হয় ছড়া বলা হয়? কেমন হলো জানাবেন।
পদ্য আমি পড়তে জানি লিখতে জানি কম
যদিওবা লিখতে বসি লাগে পাহাড় সম
পদ্য যারা লিখেন তারা ভাবেন শুধু ভাবেন
শব্দ দিয়ে কথার মালা গাঁথেন শুধু গাঁথেন।
যায় না বুঝা তাদের দেখে ঘুমন্ত না চেতন
সকাল দুপুর যায় গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো কখন।
কাব্যকথার সেই মালাটা হিরার চেয়েও দামি
মূল্য বুঝেন তারাই শুধু যারা মানুষ নামি।
অনেক বিষয় ঘুরে মাথায় পেয়ে বসে নিশা
কোনটা ফেলে কোনটা লিখি পাই না খোঁজে দিশা।
ভ্রমর এসে ফুলের কানে বলল কিছু যেন
সেই কথাতে ফুলের মুখে হাসি ফুটে কেন?
প্রভাত রবির আলোর মত ছড়িয়ে দেব মেধা
জ্ঞান পিয়াসুর মিটবে তাতে জ্ঞানের যত ক্ষুধা।
কবে জানি ফুটবে হাসি গরিব দুঃখীর মুখে
সবাই মোরা মিলে মিশে থাকব সাধের সুখে?
গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরব মোরা কবে?
বিদেশ থেকে দিনের শেষে ফিরব বাড়ি যবে।
*।*।*।*।*।*
নিচের আরেকটি মন্তব্যে একটি কবিতা দেব তাও কেমন হল জানাবেন।
অপেক্ষাতেই ছিলাম তোমার আসলে না তুমি সময়ে
অসময়ে এসে তুমি কাঁদলে দু চোখ ভাসিয়ে
পাষান হতে পারিনি আমি, আমারও দু চোখ ভাসলো
অভিমানের মেঘ সরিয়ে প্রেমের সুর্য হাসলো।
দু হাত বাড়িয়ে তোমায় জড়িয়ে নিলাম হৃদয়আঁচলে
আলতো আদরচিহ্ন এঁকে দিলাম তোমার কপোলে।
আমাকে মনে হয় কবিতার চেয়ে ছড়ার প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে।
আরেকটি বিষয়। উপরের ছড়াটিতে আছি ছন্দ আর অন্তমিল দোটোই মনে হয় ঠিক রাখতে পেরেছি। কিন্তু নিচের কবিতাতে তা পারিনি। তাহলে বলা যায় এখানে আমি ভাল মতে খেয়াল করিনি। তাই না? আমারও তাই মনে হচ্ছে।
আচ্ছা ভাই। ধরুন ছন্দ আর অন্ত মিল ঠিক রেখে লিখলাম। তখন সেটাতো ছড়া নাকি কবিতা তা বুঝব কিভাবে?
আমি যে বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেই সেটা হল, না আটকে সুন্দর সুর তুলে পড়তে পারা। যেমন গাড়ি চলছে মসৃণ রাস্তায়। আর যদি ভাঙ্গা রাস্তায় গাড়ি চলার মত করে পড়তে হয় তাহলে আমার মতে সেটা কবিতাও হচ্ছে না, ছড়াতো হচ্ছেই না। হা হা হা। জানি না ঠিক না বেঠিক।
ছড়া-কবিতা-গান এর ফারাক তো আছে ভাই--সাথে থাকুন সামনে এসবও লিখবো।
তবে লিখতে না।
রাখালের পিটুনিতে আবার ঘড়ে ফিরে যাই।
হা হা হা হা হা হা হা হা হা
আমিও একলাইন লিখলাম।
শিক্ষনীয় পোষ্ট প্রথম দিকে পড়েছিলাম মাঝখানে বাদ পড়ে গেছে।
দেখি সময় করে পড়ে নেবো।
অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন