তোমার হৃদয়ে আমি গরু হয়ে ঘাস খাই-২ (ছন্দ প্রকরণ)

লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ১২ মে, ২০১৪, ০৩:৪৬:৫৫ দুপুর

তোমার হৃদয়ে আমি গরু হয়ে ঘাস খাই

ল্যাম্পোস্টকে জড়িয়ে বলি- ডার্লিং !!!!





ওপরের লাইনদুটো উচ্চাংগের আধুনিক কবিতাংশ, যা মুক্তছন্দে লেখা। এটি মুক্তছন্দে লেখা হলেও কিন্তু ছন্দোবদ্ধ পঙক্তি। এখানে ছন্দ আছে তবে অন্তমিল নেই। অল্পকথায় এই হলো মুক্তছন্দের গদ্যকবিতার বৈশিষ্ট্য

''মনের কথাগুলো বলেছেন। ছন্দছাড়া যদি কবিতা হয়, তাহলে পৃথিবীতে প্রেয়সীকে লক্ষ্য করে লিখা ভালবাসার সব চিঠিই গদ্যকবিতা।

গভীর রাতে তোমাকে স্মরণে আতকে উঠি।

হারিয়ে যাই তোমার ভালবাসার অচিনপুরে।

যেখানে শুধু আমি আর তুমি।

এ চিঠিটিই বর্তমানে গদ্যকবিতা। শুধুমাত্র প্রত্যেকটি লাইনকে আলাদা করে দেয়া। এসব কবিতা কোন ভালো আবৃত্তিকার দিয়ে ঢং করে না পড়ালে মজা নেই। কাজেই যারা এ আবৃত্তি জানেনা, তাদের কাছে এসব কবিতার কোন রস নেই।


আমার লেখা পড়ে ওপরের এমন মন্তব্যই করেছেন একজন পাঠক। তার সাথে আমি আংশিক একমত পোষণ করি। আসলেই ছন্দোবদ্ধ চিঠিও হতে পারে মুক্তছন্দের আধুনিক কবিতা। তার উদ্ধৃত চিঠির লাইন দুটোও ছন্দোবদ্ধভাবে রচিত, যাকে কবিতার পংক্তি বলাই যায়। ছন্দ তৈরি করতে চাইলে গদ্যের বাক্যগঠন আর পদ্য বা কবিতার বাক্যগঠন ও শব্দচয়নের সুস্পষ্ট কিছু ফারাক বুঝতে হবে। কবিতায় থাকবে তাল, লয়, ছন্দ, উপমা-উৎপ্রেক্ষাসহ আরো অনেক কিছু।

কবিতার ভাষা কখনোই গদ্যের আদলে রচিত হবেনা। কারণ গদ্য গদ্যই আর পদ্য পদ্যই। গদ্যে কোনো ছন্দ থাকেনা কিন্তু পদ্যের ছন্দই আসল রস ও আকর্ষণ। যেমন উদাহরণস্বরূপ নিচে আমার একটা মুক্তছন্দের কবিতা দিলাম---দেখুন-

আমার নামটাও ভুলে যাই

আজকাল কেনো যেনো হয় বড্ড মতিভ্রম

নিজেকেও আর বিশ্বাস হয়না আমার

কিংবা মনে হয়না কোনো জ্বলজ্যান্ত মানুষ;

কী আশ্চর্য, আমার অনিন্দ্য-সুন্দর নামটাও ভুলে যাই

এমনকি ভুলি চৌদ্দপুরুষেরও নাম

হঠাৎ বনে যাই যখন জাতি-ধর্মবিমুখ এক ভাষাহীন!

আমার বিবেকের সকল তন্ত্রী ছিঁড়ে যায়--

হৃদয়কন্দরে বাজে নিষিদ্ধসুর

আয়নায় দাঁড়ালেই দেখি নিজেকে দাঁতাল

হায়েনার মতোন হয়ে গেছি ভীষণ ভয়ংকর জীব?



তখন শুধু খুবলে খুবলে খাই কোমল শরীর

বিষাক্ত লালায় ঝলসে যায় কতো নন্দিত মুখ।

আবার কেটে গেলে ভ্রম, খোলে বিবেকের দ্বার---

সত্যি, আমি কি মানুষ, কেনো এমন হয়ে যাই!!


ওপরের কবিতায় বাক্য ও শব্দগঠন প্রক্রিয়ায় ছন্দের সাথে উপমাও সৃষ্টি করেছে। ছন্দ মুলতঃ দেখা যায়না কিন্তু অনুভব করা যায়, যা মনকে দোলা দেয় আন্দোলিত করে। ভাষা ও ব্যাকরণের নিখুঁত গাঁথুনিই তৈরি করে ছন্দ, যা শুধুমাত্র উচ্চারণের সঙ্গেই সম্পৃক্ত।

তবে একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, একজন ভালো কবির সব লেখাই যে মানোত্তী্র্ণ হবে এমন কথা কথা নেই। মেশিনের ছাচের জিনিসেও মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক হয়, খুঁত তৈরি হয়। আর মানুষের লেখায় এমন গড়মিল হওয়াই তো স্বাভাবিক। তাই দেখা যায়, অনেক নামকরা কবির লেখাও কখনো দুর্বল ছন্দের হয়ে যায়।



এবার দেখুন সুকান্তের গদ্যকবিতা ছন্দহীন কিনা-

ছাড়পত্র

যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে

তার মুখে খবর পেলুম:

সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,

নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার

জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।

খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত

উত্তোলিত, উদ্ভাসিত

কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।

সে ভাষা বোঝে না কেউ,

কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।

আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা

পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের—

পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর

অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস॥


ছন্দের প্রাথমিক ধারণা

ছন্দছাড়া যারা মুক্তছন্দের ছন্দ শব্দটা ভুলে গিয়ে ছন্দহীনভাবে পত্রিকার কলামের মতোই স্রেফ গদ্য লিখে যায় আর ভাবে কবিতা হয়ে গেছে, তাদের জন্যই মূলতঃ এ লেখা। কাজেই কবিতা মানেই ছন্দের খেলা--গদ্যকবিতা মানে ছন্দহীন নয়--মুক্তছন্দ মানেই অন্তমিলবিহীন ছন্দোবদ্ধ কবিতা, এটা আমাদের বুঝতে হবে।

ছন্দ দেখা যায় না বটে কিন্তু পড়লেই অনুভব করা যায় এবং আবৃত্তি করলেই ছন্দোবদ্ধ কবিতা-ছড়া মনে বেশ দোলা দেয়-মনকে ছন্দায়িত করে। পিচঢালা মসৃণ পথে কার চালিয়ে যেতে কী আরামবোধ হয়, সুখে ঘুম পায় তাইনা? কিন্তু বন্ধুর ও লক্করঝক্কর মার্কা রাস্তায় গাড়িয়ে চালিয়ে কি সেই সুখ পাবেন?? ছন্দও ঠিক তাই, যে কবিতা-ছড়ায় ছন্দ যতো নিখুঁত তা আনন্দও দেয় প্রচুর, আর যার ছন্দ নেই--তা পড়লেই মন বিগড়ে যায়?

আজকাল দেখা যায় প্রিন্ট মিডিয়া বা পত্রিকার মতো সম্পাদনা বা মডারেশন না থাকায় এবং সহজলভ্য হওয়ায় অনলাইনে সবাই যেনো কবিতা লেখা শুরু করেছে--ছন্দের প্রাথমিক জ্ঞানছাড়াই। আবার অনেক ছন্দবিশারদ ছন্দ নিয়ে এমন কঠিন করে লেখেন যে, আমিও বুঝতে পারিনে তাদের ব্যাখ্যা। তাই আমি সেই পথ ছেড়ে একাডেমিক ও তাত্ত্বিক আলোচনা ছাড়াই রসাত্মক পন্থায় তা লিখছি যাতে সহজেই বোঝা যায়।

ছন্দ

''শিল্পসাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠমাধ্যম কবিতা, সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই তাল, লয়, সুর ইত্যাদির সংমিশ্রণে ভাষার মালা হয়ে মানুষের মনে দোলা দিয়ে আসছে। অক্ষর ও শব্দের নানামুখি চালে এ মালা তৈরীর প্রক্রিয়া বা নিয়মই আদতে ছন্দ।

কালের বিবর্তনে, অতিক্রান্ত সময়ের সন্ধিক্ষণে উৎকৃষ্ট কবিতানির্মাণের জন্য বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রায় সব ভাষার বিশিষ্ট কবিরা তৈরি করেছেন সুনির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত নিয়ম। বাংলাকবিতাকেও অন্যান্য ভাষায় রচিত কবিতার মতো বাঁধা হয়েছে ছন্দের শৃঙ্খলে। আর একপর্যায়ে ভেঙেও দেয়া হয়েছে সেই শৃঙ্খল, কিন্তু ভাঙার সেই প্রক্রিয়াও তৈরী করেছে নতুন ধ্বনিমাধুর্য, নতুন ছন্দ যা মুক্তছন্দ নামে পরিচিত।

ইটতৈরির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন উৎকৃষ্ট মাটির। মাটিকে আবর্জনামুক্ত করে স্বচ্ছ পানি মিশিয়ে হাত দিয়ে বা মেশিনের সাহায্যে বারবার নেড়ে চেড়ে নরম করার প্রয়োজন পড়ে। তারপর এই মাটি ফর্মায় ঠিকমতো পুরতে পারলেই মাটি আর মাটি থাকেনা, ইটে পরিণত হয়। আবার এই নরম ইটকে শক্ত করার জন্য উচ্চতাপে দগ্ধ করা হয়। লক্ষণীয় যে, নরম মাটিকে হাত দিয়ে পিটিয়ে বা মেশিনে নেড়ে চেড়েই ইটের রূপ দেয়া যায় না। দরকার একটি ফর্মা যা কিনা মাটিকে সুন্দর একটি ইটের আকার দিতে পারে।

কবিতার প্রসঙ্গেও এইভাবে বলা যায়, প্রথমেই প্রয়োজন সুন্দর একটা বিষয়। যদিও যে কোনো বিষয়েই উৎকৃষ্ট কবিতা তৈরীর প্রমাণ যথেষ্ট রয়েছে, তথাপি কবিতালেখার শুরুর দিকে বা তরুণ কবিদের ক্ষেত্রে বিষয়ের গুরুত্ব অবহেলা করা যায়না। বিষয় স্পষ্ট হলে, তাকে ভাষায় রূপ দেয়ার জন্য দরকার শব্দ। বিষয় ও শব্দের একত্র মেলবন্ধনে গঠিত হয় কবিতার ভাব, যা ইটতৈরির পূর্বের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করে। এখন প্রয়োজন ফর্মার। কবিতার ক্ষেত্রে এই ফর্মাই হলো ছন্দ। বিষয় এবং শব্দকে যদি নির্দিষ্ট ছন্দের মধ্যে গ্রন্থিত করা যায় তবে অন্তত দগ্ধ করার আগে কাঁচাইটের মতো মোটামুটি একটা কবিতা দাঁড়িয়ে যায়। তারপর একে পরিপক্ক করার জন্য প্রয়োজন হয় উপমা, অনুপ্রাস, চিত্রকল্প ইত্যাদির।'' (চলবে)

একনম্বর পর্ব পড়ুন

বিষয়: বিবিধ

১৪৯৪ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

220602
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫২
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৮
168221
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ধন্যবাদ Good Luck Good Luck Good Luck
220605
১২ মে ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৭
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : ছন্দ ছাড়া কবিতা পড়ে মজাই পাই না। যেমন শামসুর রাহমানের কবিতা।

স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
১২ মে ২০১৪ বিকাল ০৪:০১
168222
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : একজন ভালো কবির সব লেখাই যে মানোত্তী্র্ণ হবে এমন কথা কথা নেই। মেশিনের ছাচের জিনিসেও মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক হয়। আর মানুষের লেখায় এমন গড়মিল হওয়াই স্বাভাবিক। তাই দেখা যায়, অনেক সময় নামকরা কবির লেখাও কখনো দুর্বল ছন্দের হয়ে যায়।

এটাও বিখ্যাত কবিতা; তবে এরচে আরো ভাল কবিতার পালায় পড়লে ভাল লাগতেও পারে। গদ্য কবিতা আমারও পছন্দের নয় ভাই
220614
১২ মে ২০১৪ বিকাল ০৪:০৭
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : ভাই আপনার কি হৈছে এত ভুলে যান কেনো? এই যে একটা সুন্দর গদ্যময় কবিতা লিখলেন সেটাও কি ভুলে গেছেন?
১৩ মে ২০১৪ সকাল ১১:১০
168468
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : না ভাই ভুলিনি--তবে আমিও মাঝে মাঝে যুগের সাথে তাল দিয়ে গদ্য কবিতা লিখার চেষ্টা করি আরকি? Good Luck
220632
১২ মে ২০১৪ বিকাল ০৪:২৪
বাকপ্রবাস লিখেছেন : সুন্দর পোষ্ট, চলতে থাকুক
১৩ মে ২০১৪ সকাল ১১:১১
168469
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ
220639
১২ মে ২০১৪ বিকাল ০৪:৫১
মুজিব সেনা লিখেছেন : তোমার হৃদয়ে আমি গরু হয়ে ঘাস খাই। Thumbs Up Thumbs Up Rolling on the Floor Rolling on the Floor
১৩ মে ২০১৪ সকাল ১১:১১
168470
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : এ লাইন দুটোরও সুন্দর শানে নুজুল আছে-পড়ে লিখবো ভাই
220644
১২ মে ২০১৪ বিকাল ০৫:২২
নীল জোছনা লিখেছেন : Big Grin Big Grin Big Grin Thumbs Up Thumbs Up আপনি তো বেশ সুন্দর কবিতা লিখতে পারেন। তবে কবিতার ভাষা অনেক কঠিন ভাইয়া। পড়তে দাঁত ভেঙে গেলো Broken Heart Broken Heart
১৩ মে ২০১৪ সকাল ১১:১৩
168471
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : কবিতার ভাষা কঠিন না হওয়াই ভালো কিন্তু কখনো হয়ে যায়---সরি-- এবার সহজ কবিতা দেব Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck
220690
১২ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১৬
অনেক পথ বাকি লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ ।
১৩ মে ২০১৪ সকাল ১১:১৩
168473
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভাললাগায় অনেক ফুলেল শুভেচ্ছা (~~)
220716
১২ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৩
আঁধার কালো লিখেছেন : জাজাকাল্লা খাইরান.. অনেক ভালো লাগলো পড়ে
১৩ মে ২০১৪ সকাল ১১:১৪
168474
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File