হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসঃ লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সারের কারণ

লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ১৮ মার্চ, ২০১৪, ০২:০৪:৪১ দুপুর



বিশ্বে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকারক ভাইরাস হেপাটাইটিস-বি, যার সংক্রমণ ঘটছে খুব দ্রুত। এর ভয়াবহতা এইডসের চেয়েও ভয়ঙ্কর, যা সমগ্র মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস অ্যাকিউট হেপাটাইটিস বা জন্ডিসের উল্লেখযোগ্য কারণ এবং ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী লিভার ডিজিজের প্রধান কারণ। মানবদেহের লিভার বা যকৃৎ কোনো কারণবশত এ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে তাকে ভাইরাল হেপাটাইটিস বলা হয়। অনেকে যাকে জন্ডিস বা আঞ্চলিক ভিত্তিতে ‘কামেলা’ রোগ বলে থাকেন। লিভারের একিউট এবং ক্রনিক সংক্রমণের জন্য দায়ী মোট ৫ ধরনের লিভার ভাইরাস হচ্ছে - হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-ডি এবং হেপাটাইটিস-ই।



বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারাবিশ্বে শুধু হেপাটাইটিস বি ও সি’র সংক্রমণে মারা যাচ্ছে প্রায় ১১ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি বাহক এবং এদের ২০ শতাংশ লিভার ক্যান্সার ও সিরোসিসে মারা যেতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর ২ থেকে ৫ লাখ নবজাতক হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে যারা ভবিষ্যতে এই রোগের বাহক হয়। বলা হয়, বাস্তবে হেপাটাইটিস-বি এইডসের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি সংক্রামক এবং প্রতিবছর এইডসের কারণে পৃথিবীতে যত লোক মৃত্যুবরণ করে তার চেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করে হেপাটাইটিস-বি’র কারণে।



বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে প্রবেশের পূর্বশর্তই হলো হেপাটাইটিস-বি’র পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যে, সংশ্লিষ্টের শরীরে হেপাটাইটিস-বি’র জীবাণুর সংক্রমণ আছে কিনা। যদি শরীরে হেপাটাইটিস-বি’র জীবাণু পাওয়া যায় তবে বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চাকরি বা কাজ করতে যাওয়া বাধাগস্ত হয়।

হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমণে সংঘটিত হতে পারে পৃথিবীর অন্যতম প্রাণঘাতি রোগ লিভার সিরোসিস এবং লিভার ক্যান্সার। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস মূলতঃ লিভারকে আক্রমণ করে এর কোষগুলোকে ধ্বংসের মাধ্যমে লিভার অকেজো করে দেয়। লিভারে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলে। ক্রনিক হেপাটাইটিস দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে একসময় লিভার সিরোসিসের উৎপত্তি হয়।



লিভার সিরোসিস লিভারের মারাত্মক রোগ। এ রোগে লিভারের স্বাভাবিক কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং লিভারের ভেতর ফাইব্রাশ টিস্যুঘেরা নডিউল সৃষ্টি হয়। ফলে লিভারের কর্মক্ষমতা কমে যায় বা বিনষ্ট হয় এবং লিভারের ভেতর দিয়ে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়। একপর্যায়ে জন্ডিসে আক্রান্ত লিভারটি বিকৃতভাবে গলে-পচে গিয়ে মানুষের প্রাণশক্তি কেড়ে নেয়।



হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় একলাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। বর্তমানে এদেশে ১২ শতাংশ লোক এ রোগে আক্রান্ত, যারা আমাদের অসাবধানতা এবং অসচেতনতার কারণে প্রতিদিন আরো হাজার হাজার লোককে আক্রান্ত করছে। সারাবিশ্বে ৩০ থেকে ৪০ কোটি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন লোক ক্রনিক আকারে সংক্রমিত। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫ ভাগ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি বাহক।



এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। কিন্তু যেভাবে এইডস্ ছড়ায়, প্রায় একই পন্থায় এ রোগেও মানুষ নিজের অজান্তেই আক্রান্ত হয়। সংক্রমিত সুচেঁর মাধ্যমে রক্তদান, রক্তগ্রহণ বা সংক্রমিত রক্তগ্রহণ, সংক্রমিত লোক বা বাহক থেকে অন্যের মধ্যে সংক্রমণ (টুথব্রাশ, ইঞ্জেকশনের সুঁচ, রেজার, চায়ের কাপ, পানির গ্লাস, মুখের লালা ইত্যাদির মাধ্যমে), জন্মের সময় বাহক মাতা থেকে নবজাতকে সংক্রমণ এবং সংক্রমিত পুরুষ থেকে নারী বা নারী থেকে পুরুষে যৌনমিলনের মাধ্যমে সংক্রমণ এ রোগের জন্য দায়ী। হেপাটাইটিস-বি এমন একটি রোগ যা তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করে শরীরে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে কিন্তু ততদিনে রোগীর লিভার বা যকৃৎ অনেকটাই ধ্বংস হয়ে যায়।



রক্তপরীক্ষা করলে বোঝা যায় শিরায় বিলিরুবিনের মাত্রা অর্থাৎ জন্ডিস কতটা ও হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আছে কিনা, অর্থাৎ এইচবিএসএজি পজিটিভ কিনা। এর আগে বুকের ডানপাশে হালকা ব্যথা হতে পারে। অজীর্ণ বা বদহজমের ভাব এমনকি আলসারের মতো উপসর্গও দেখা দিতে পারে। সুতরাং একমাত্র রক্তপরীক্ষার মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, কারো শরীরে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আছে কিনা। রক্তপরীক্ষায় ভাইরাস না থাকলে যে কেউ আত্মরক্ষার্থে আগাম টিকা নিয়ে এ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি গড়ে তুলতে পারে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে রক্তপরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হলে অর্থাৎ এই হেপাটাইটিস বি’র উপস্থিতি প্রমাণিত হলে অবশ্যই তাকে দ্রুত এবং যথাযথভাবে চিকিৎসা করাতে হবে।



এ রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগপ্রতিরোধই উত্তম। সুতরাং এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র উপায় হলো, এ রোগের বিরুদ্ধে নিজের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা অর্থাৎ আগাম টিকা নেওয়া। হেপাটাইটিস-বি এর টিকা ৪টি ডোজ নিতে হয়। প্রথম ৩টি ডোজ ১ মাস পরপর এবং ৪র্থ ডোজটি প্রথম ডোজের ১২ মাস বা ১ বছর পর নিতে হয়। অর্থাৎ ০, ১, ২ ও ১২ মাস। এছাড়া আরেক ভাবেও এ টিকা দেওয়া যেতে পারে। ০, ১ ও ৬ মাস অর্থাৎ ১ম ডোজের ১ মাস পর ২য় ডোজ এবং ৬ মাস পর ৩য় ডোজ দিতে হবে। শিশুর জন্য এ টিকা খুবই জরুরি।



তবে বি-ভাইরাসজনিত ক্রনিক হেপাটাইটিস সময়মতো চিকিৎসা করলে রোগের অগ্রগতি বন্ধ করা সম্ভব এবং লিভার সিরোসিস প্রতিকার করা সম্ভব। হেপাটাইটিস-বি এর চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ আবিস্কৃত হয়েছে, তা বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। একটানা দুই বছরের বেশি সময় ধরে চিকিৎসা করে শতকরা ৫০ জনের ক্ষেত্রে আশানুরূপ ভালো ফল পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ করে এ ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হচ্ছে।



আরো প্রমাণিত হয়েছে, যতো বেশিদিন চিকিৎসা দেওয়া যায়, রোগীর জন্য তা ততো উপকারী। এমনকি গবেষণায় এও দেখা গেছে, আবিস্কৃত ওষুধ ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করতে না পারলেও লিভারের কর্মক্ষমতায় উন্নতি ঘটায় এবং সিরোসিস হ্রাসেরও কারণ ঘটায়। আশার কথা আমাদের দেশেও এখন এ ওষুধের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। একদিন হয়তো লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে।(তথ্যসূত্রঃ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, উইকিপিডিয়া এবং ইন্টারনেট)

বিষয়: বিবিধ

২৩৬৫ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

194061
১৮ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০৩:৩৬
নীল জোছনা লিখেছেন : ধন্যবাদ অনেক অনেক ধন্যবাদ সতর্ক করার জন্য।
১৮ মার্চ ২০১৪ বিকাল ০৪:২২
144670
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : আমি জণ্ডিসে পড়ে ৪মাস খুব ভুগেছি কিনা?
194132
১৮ মার্চ ২০১৪ বিকাল ০৫:০৪
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : অনেক অনেক ধন্যবাদ সতর্ক করার জন্য।
১৮ মার্চ ২০১৪ রাত ০৮:৪১
144833
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ধন্যবাদ
194650
১৯ মার্চ ২০১৪ দুপুর ১২:০৭
নামহীন আমি অনামিকা লিখেছেন : ভালো লাগলো পিলাচ
১৯ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০৩:২৪
145214
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : Good Luck Good Luck Good Luck
195336
২০ মার্চ ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২১
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালো লেগেছে।
২০ মার্চ ২০১৪ রাত ০৯:২৯
145696
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : ভাললাগায় ধন্যবাদ
195910
২১ মার্চ ২০১৪ রাত ১০:৫১
প্রবাসী মজুমদার লিখেছেন : আমার মা জন্ডিেসের জন্য নিজেই স্বপ্নে পাওয়া ওষন দিতেন। তিন দিনেই শেষ। ধন্যবাদ বিস্তারিত লিখার জন্য।
২২ মার্চ ২০১৪ সকাল ০৯:৩৬
146147
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : টা আমি মানি, এখানেও এক বুড়ির কথা শুনেছি যিনি আপনার মায়ের মতই ওষুধ দেন এবং ভাল হয়ে যায়। লাইন দিয়ে অষুধ নিতে হয়। কিন্তু আমি হাসপাতালে থাকায় তার সুযোগ নিতে পারিনি।
201778
০২ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫৯
সুমাইয়া হাবীবা লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাই। চালিয়ে যান।
০৪ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১২:৩৪
151911
শাহ আলম বাদশা লিখেছেন : অনেক শুভেচ্ছা

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File