তথ্য কমিশনের বিচারিক কার্যক্রমঃ ২০১১-২০১৩
লিখেছেন লিখেছেন শাহ আলম বাদশা ১৮ মার্চ, ২০১৪, ০৯:০১:৫৬ সকাল
বাংলাদেশ সরকারের একটি যুগান্তকরী পদক্ষেপ হচ্ছে- দেশের সরকারী-বেসরকারী দপ্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাপ্রতিষ্ঠা এবং সর্বগ্রাসী দুনীতিরোধের লক্ষ্যে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনেই ‘’তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’’ পাশ করা।
অতঃপর ২০০৯ সালের পয়লা জুলাই তথ্য অধিকার আইন কার্যকর করে আইনটির সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠন করা হয় একটি ‘’তিনসদস্যবিশিষ্ট তথ্য কমিশন।‘’
দেশের অন্যান্য স্বাধীন কমিশন এবং তথ্য কমিশনের মধ্যে মূল পার্থক্য এই যে- এটাই হচ্ছে একমাত্র আধাবিচারিক ক্ষমতার অধিকারী কমিশন, যে ক্ষমতা অন্য কোনো কমিশনের নেই। এমনকি বিচারিক প্রশ্নে তথ্য কমিশনকে এমনই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের রায়ই হচ্ছে চূড়ান্ত এবং এ রায়কে অন্য কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়না। অর্থাৎ তথ্য কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেমন আপিল করা যায়না, তেমনি তা রিভিউয়েরও কোনো সুযোগ নেই। তবে প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে শুধু রিট মামলা দায়ের করা যায়।
আর ’তথ্য অধিকার আইন-২০০৯’’ এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো- এটি জনগণকে ক্ষমতায়িত করার সবচে বড় ও শক্তিশালী একটি হাতিয়ার। কারণ অন্যান্য সকল আইনে সরকার বা প্রশাসন কর্তৃক জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা হলেও, একমাত্র তথ্য অধিকার আইনদ্বারা জনগণই প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘’জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক’’ একথার হুবহু ও সরাসরি প্রতিফলন ঘটেছে কেবল তথ্য অধিকার আইনেই। এ আইন জনগণকে এতটাই ক্ষমতায়িত করেছে যে, জনগণ দেশের যেকোনো দপ্তরের নোটসীট ব্যতীত যেকোনো তথ্যজানার অধিকার প্রয়োগ করে প্রশাসনের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত করতে পারে, তেমনি দুর্নীতিরোধেও সরাসরি ভূমিকা পালন করতে ক্ষমতাবান।
তাই তথ্য কমিশনের অন্যতম একটি কাজ হচ্ছে- জনগণের অর্থে পরিচালিত দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমের যেকোনো তথ্যজানা এবং প্রাপ্তির আইনগত অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুনিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের নির্ধারিত ফর্মেটে তথ্যপ্রাপ্তির আবেদনের পর আপীল করেও যদি কেউ কাঙ্ক্ষিত তথ্য না পায়, তবে তথ্য কমিশনে সরাসরি অভিযোগদায়ের করা যায়। অভিযোগপ্রাপ্তির পর তা আমলে নিয়ে কমিশন সংশ্লিষ্ট দু’পক্ষকেই সমনজারি করে থাকে এবং উভয়পক্ষের শুনানীগ্রহণের মাধ্যমে তথ্যবঞ্চিত জনগণের তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে।
কমিশন প্রথম বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিশনে সর্বমোট ৫১৩টি অভিযোগদায়ের হয়। এর মধ্যে ৫০৭টি অভিযোগের নিষ্পত্তি করা হয়েছে এবং বাকী ৬টি অভিযোগ নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। অর্থাৎ বিচারিক কার্যক্রম শুরুর পর অভিযোগনিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তথ্য কমিশন তিনবছরে ৯৮% এর ওপর সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে, যা একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
তথ্যবঞ্চিত জনগণের অভিযোগনিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্তও প্রদান করেছে তথ্য কমিশন, যা মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তন্মধ্যে তথ্যপ্রার্থীকে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশভ্রমণসংক্রান্ত তথ্যপ্রদান, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক রাজনৈতিক দলসমূহের আয়ব্যয়ের রিপোর্ট, পিএসসি বা সরকারী কর্মকমিশন কর্তৃক বিসিএস পরীক্ষার্থীকে লিখিত নম্বরের পাশাপাশি ভাইভার নম্বরপ্রদান, এনজিও প্রশিকা কর্তৃক চাকরীচ্যুত মেটালী চাকমা ও মানসী চাকমাকে জিপিফাণ্ডের তথ্যসহ প্রাপ্য জিপিএফ এর অর্থ, খুলনার চিংড়ীচাষীদের ন্যূনতম মজুরি, বিভিন্ন এলাকার খাসজমির পরিমাণ এবং জমির নামজারিসংক্রান্ত তথ্যপ্রদানের রায় উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও প্রার্থিত তথ্যপ্রদানে অস্বীকৃতিজ্ঞাপন, হয়রানীকরণ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যপ্রদানের অভিযোগেও তথ্য কমিশন একাধিক কর্মকর্তাকে জরিমানাসহ তিরস্কার করেছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাঃ গোলাম মোস্তফা কর্তৃক তথ্যপ্রার্থীকে হয়রানীকরণ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যপ্রদানের অপরাধে একহাজার টাকা এবং তথ্যপ্রদানে অস্বীকৃতিজ্ঞাপনের অপরাধে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বা পিআইও আবদুল বাছেদকে পাঁচশত টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখ্য যে, তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ এর বিধান অনুযায়ী না দেয়ায় তথ্য কমিশন বেশকিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জরিমানার দণ্ডাদেশ বা তথ্যপ্রদানের নির্দেশ দেয়ায় কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে এ পর্যন্ত মোট ৫টি রিট পিটিশন দায়ের হয়। তন্মধ্যে একহাজার টাকা জরিমানার দণ্ডপ্রাপ্ত ডাঃ গোলাম মোস্তফার রিটটি খারিজ করে কমিশনের সিদ্ধান্তই বহাল রেখেছে হাইকোর্ট।
সুতরাং তথ্য কমিশন মনে করে, জনগণ তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে যতবেশী জানবেন, ততবেশীই তারা ক্ষমতায়িত হবেন। আর তথ্যজানা ও প্রাপ্তির আইনগত অধিকার যতবেশী প্রয়োগ করবেন, প্রশাসনের দুর্নীতি ততোই কমে যাবে এবং স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতাও বাড়বে। তাই আসুন, আমরা তথ্য কমিশনের হাতকে শক্তিশালী করি।
বিচারিক ভিডিও দেখুন
বিষয়: বিবিধ
১০০৩ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাগর রুণি হত্যায় আমরা নীরব। বিশ্বজিত হত্যায় নীরব। দিগন্ত ইসলামিক টিভি বন্ধের কোন যৌক্তিকতা আজও খুজে পাইনি। কারন কাগজে বন্ধী আইন বড় অসহায়।
ধন্যবাদ।
আপীল কর্মকর্তা ১৫ দিনের মাঝে আপনাকে হয় তথ্য দিতে বলবেন না হয় আপনার আপীল খারীজ করবেন।
এরপর আপনি তথ্য কমিশনে মামলা করবেন নির্ধারিত ফর্মেটে এবং কমিশন সমন পাঠাবে দুইপক্ষকেই এবং শুনানীশেষে ন্যায়বিচার করে থাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন