সঠিক আক্বীদা ও তার পরপন্থী বিশ্বা..আল্লাহ্র প্রতি ঈমান
লিখেছেন লিখেছেন ইসলামী দৃষ্টিকোণ ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:২৮:৫৭ সকাল
আল্লাহ্র প্রতি ঈমানের প্রথম কথা হলো এই বিশ্বাসই স্থাপন করা যে, তিনিই ইবাদতের একমাত্র যোগ্য, সত্যিকার মা‘বুদ, অন্য কেউ নয়। কেননা, একমাত্র তিনিই বান্দাহদের স্রষ্টা, তাদের প্রতি অনুগ্রহকারী এবং তাদের জীবিকার ব্যবস্থাপক। তিনি তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত এবং তিনি তাঁর অনুগত বান্দাকে প্রতিফলদানে ও অবাধ্যজনকে শাস্তি প্রদানে সম্পূর্ণ সক্ষম। আর এই ইবাদতের জন্যেই আল্লাহ্ তা‘আলা জ্বিন ও ইন্সানকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের প্রতি তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ্ বলেন:
﴿وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ مَآ أُرِيدُ مِنۡهُم مِّن رِّزۡقٖ وَمَآ أُرِيدُ أَن يُطۡعِمُونِ ٥٧ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلرَّزَّاقُ ذُو ٱلۡقُوَّةِ ٱلۡمَتِينُ﴾ [الذاريات:56-57]
“আমি জ্বিন ও ইনসানকে কেবল আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের নিকট কোন রিজিক চাইনা, এটাও চাইনা যে, তারা আমাকে খাওয়াবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ নিজেইতো রিজিকদাতা, মহান শক্তিধর ও প্রবল পরাক্রান্ত”। (সূরা যারিয়াত: ৫৬,৫৭)
আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ٢٢﴾ [البقرة: 21-22]
“হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রভূ প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী সকলকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার। তিনিই সেই প্রভূ যিনি তোমাদের জন্যে পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ, আকাশকে ছাদ স্বরূপ তৈরী করেছেন এবং আকাশ হতে বৃষ্টিধারা বর্ষণ করে এর সাহায্যে নানা প্রকার ফল-শষ্য উৎপাদন করে তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন। অতএব, তোমরা এসব কথা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করোনা”। (সূরা বাকার : ২১,২২)
এ সত্যকে স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য এবং এর প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়ে এর পরিপন্থী বিষয় থেকে সতর্ক করে দেয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ যুগে যুগে বহু নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন ও কিতাবসমূহ নাজিল করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন:
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [النحل:36]
“প্রত্যেক জাতির প্রতি আমি রাসূল পাঠিয়েছি এই আদেশ সহকারে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর এবং তাগুত (শয়তানি শক্তি) এর ইবাদত থেকে দুরে থাক”। (সূরা নাহল-৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ﴾ [الأنبياء:25]
“প্রত্যেক জাতির প্রতি আমি রাসূল পাঠিয়েছি এই আদেশ সহকারে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহ্রই ইবাদত কর এবং তাগুত (শয়তানি শক্তি) আর কোন মা‘বুদ নেই। অতএব, তোমরা কেবল আমারই ইবাদত কর”। (সূরা আম্বিয়া: ২৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿كِتَٰبٌ أُحۡكِمَتۡ ءَايَٰتُهُۥ ثُمَّ فُصِّلَتۡ مِن لَّدُنۡ حَكِيمٍ خَبِيرٍ ١ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّا ٱللَّهَۚ إِنَّنِي لَكُم مِّنۡهُ نَذِيرٞ وَبَشِيرٞ﴾ [هود:1-2]
“ইহা এমন একটি কিতাব যার আয়াতসমূহ এক প্রজ্ঞাময় সর্বজ্ঞ সত্তার নিকট থেকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত এবং সবিস্তারে বিবৃত রয়েছে, যেন তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না কর। অনন্তর, আমি তাঁরই পক্ষ হতে তোমদের প্রতি একজন ভয় প্রদর্শনকারী ও সুসংবাদদাতা”। (সূরা হূদ : ১.২)
উল্লেখিত ইবাদতের প্রকৃত অর্থ হলো: যাবতীয় ইবাদত একমাত্র আল্লাহ্ পাকের তরেই নিবেদিত করা। প্রার্থনা, ভয়, আশা, নামায, রোজা, জবেহ, মানত ইত্যাদি সর্বপ্রকার ইবদত তাঁরই প্রতি পূর্ণ ভালোবাসা রেখে শ্রদ্ধাপূর্ণ ভয় ও পূর্ণ বশ্যতা সহকারে সম্পাদন করা। কুরআন শরীফের অধিকাংশ আয়াত এই মহান মৌলিক নীতি সম্পর্কেই অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
﴿ِ فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ٢ أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُۚ﴾ [الزمر:2-3]
“অতএব তুমি এক আল্লাহ্রই ইবাদত কর, দ্বীনকে একমাত্র তাঁরই জন্যে খালেছ কর। সাবধান, খালেছ দ্বীনতো একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য”। (সূরা যুমার: ২, ৩)
আল্লাহ্ পাক বলেন:
﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ﴾ [الإسراء:23]
“তোমার প্রতিপালক এই বিধান করে দিয়েছেন যে, তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করবে, অন্য কারো নয়”। (সূরা ইসরা: ২৩)
মহান আল্লাহ আরো বলেন:
﴿فَٱدۡعُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ﴾ [غافر:14]
“অতএব, তোমরা আল্লাহকেই ডাক, নিজেদের দ্বীনকে কেবল তাঁরই জন্যে খালেছ ভাবে নির্দিষ্ট কর, কাফেরদের কাছে তা যতই দুঃসহ হোক না কেন”। (সূরা গাফের: ১৪)
মু‘আয রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে, ‘বান্দার উপর আল্লাহ্র অধিকার হলো তারা যেন কেবল তাঁরই ইবাদত করে এবং এতে অন্য কাউকে তাঁর সাথে অংশীদার না করে’।
আল্লাহর প্রতি ঈমানের আরেকটি দিক হলো-ঐ সমস্ত বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থপন করা, যা আল্লাহ্ পাক তাঁর বান্দাগণের উপর ওয়াজিব ও ফরজ করেছেন। যথা: ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ:
(১) সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্র রাসূল ।
(২) নামাজ প্রতিষ্ঠা করা
(৩) যাকাত দেয়া
(৪) রমজানের রোজা পালন
(৫) বায়তুল্লাহ শরীফে পৌঁছার সামর্থ থাকলে হজ্জব্রত পালন করা ইত্যাদি সহ অন্যান্য ফরজগুলি, যা নিয়ে পবিত্র শরীয়তের আগমন ঘটেছে।
উপরোক্ত স্তম্ভ বা রুকনগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান করুন হলো এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহুর রাসূল। এটিই হলো কালিমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’এর প্রকৃত মর্মার্থ। কেননা, এর যথার্থ অর্থ হলো-আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্যিকার কোন মা‘বুদ নেই। সুতরাং তাঁকে ব্যতীত যা কিছুর ইবাদত করা হয়, সে মানব সন্তান হোক আর ফেরেশতা, জ্বিন বা অন্য এই যাই হোক সবই বাতেল। সত্যিকার মা‘বুদ হলেন কেবল সেই মহান আল্লাহ তা‘আলাই। আল্লাহপাক বলেন:
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ﴾ [الحج:62]
“তা এই জন্যে যে, আল্লাহই প্রকৃত সত্য এবং তাঁকে বাদ দিয়ে ওরা যারা ইবাদত করছে তা নিঃসন্দেহে বাতেল”। (সূরা হজ্জ: ৬২)
ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ এই যথার্থ মৌলিক বিষয়ের উদ্দেশ্যেই জ্বিন ও ইন্সান সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে তা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং হে পাঠক; বিষয়টি ভাল করে ভেবে দেখুন এবং এ সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করুন। আপনার কাছে নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে উঠবে, অধিকাংশ মুসলিম উক্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতি সম্পর্কে বিরাট অজ্ঞতার মধ্যে নিপতিত রয়েছে। ফলে তারা আল্লাহ্র সাথে অন্যেরও ইবাদত করছে এবং তাঁর প্রাপ্য ও খালেছ অধিকার অন্যের তরে নিবেদিত করে চলছে।
এ বিশ্বাসও আল্লাহ্ পাকের প্রতি ঈমানের অন্তর্ভুক্ত যে, তিনিই সর্ব জগতের সৃষ্টিকর্তা, তাদের যাবতীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপক এবং আল্লাহ্ যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে স্বীয় জ্ঞান ও কুদরতের দ্বারা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি দুনিয়া-আখেরাতের মালিক ও সমগ্র জগৎবাসীর প্রতিপালক। তিনিই আপন বান্দাহগণের যাবতীয় সংশোধন, তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল ও কল্যানের প্রতি আহবান জানানোর উদ্দেশ্যে রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। ঐ সমস্ত ব্যাপারে পবিত্র আল্লাহ তা‘আলার কোন শরীক নেই। তিনি আল্লাহ্ বলেন:
﴿ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ وَكِيلٞ﴾ [الزمر:62]
“ আল্লাহই প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনিই সর্ব বিষয়ের যিম্মাদার”। (সূরা যুমার-৬২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ يُغۡشِي ٱلَّيۡلَ ٱلنَّهَارَ يَطۡلُبُهُۥ حَثِيثٗا وَٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَ وَٱلنُّجُومَ مُسَخَّرَٰتِۢ بِأَمۡرِهِۦٓۗ أَلَا لَهُ ٱلۡخَلۡقُ وَٱلۡأَمۡرُۗ تَبَارَكَ ٱللَّهُ رَبُّ ٱلۡعَٰلَمِينَ﴾ [الأعراف:54]
“নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভূ হলেন আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডল ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠলেন হলেন। তিনি রাতকে দিনের অনুসরণ করে চলে। আর তিনি সৃষ্টি করেছেন সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি সবই তাঁর নির্দেশে পরিচালিত। জেনে রাখো, সৃষ্টি আর হুকুম প্রদানের মালিক তিনিই। চির মঙ্গলময় মহান আল্লাহ তিনিই সর্বজগতের প্রভূ”। (সূরা আল-আ’রাফ-৫৪)
আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি ঈমানের আরেকটি দিক হলো, কুরআন শরীফে উদ্ধৃত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে প্রমাণিত আল্লাহর সর্ব সৃন্দর নামসমূহ ও তাঁর সর্বোন্নত গুণরাজির উপর কোন প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরন, গঠন বা সাদৃশ্য আরোপ না করে বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ﴾ [الشورى:11]
“কোন কিছুই তাঁর সাদৃশ্য নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা”। (সূরা শূরা-১১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿فَلَا تَضۡرِبُواْ لِلَّهِ ٱلۡأَمۡثَالَۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ﴾ [النحل:74]
“সুতরাং তোমরা আল্লাহ্র কোন সদৃশ্য স্থির করো না, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ই জানেন, তোমরা জান না”। (সূরা নাহল : ৭৪)
এই হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ ও তাঁদের নিষ্ঠাবান অনুসারী আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আকিদা বা বিশ্বাস। ইমাম আবুল হাসান আল-আশ’আরী রহিমাহুল্লাহ্ তাঁর ‘আল-মাকালাত আন আসহাবিল হাদীস অ আহলিস-সুন্নাহ’ গ্রন্থে এই আকীদার কথাই উদ্ধৃত করেছেন। এভাবে ইল্ম ও ঈমানের বিজ্ঞজনেরাও বর্ণনা করে গেছেন। ঈমাম আওযায়ী রহিমাহুল্লাহ বলেন: ইমাম যুহরী ও মাকহুলকে আল্লাহ্র গুণরাজি সম্পর্কিত আয়াতগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা বলেন: এগুলি যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবেই মেনে নাও। ওয়ালীদ বিন মুসলিম রহিমাহুল্লাহ বলেন ইমাম মালেক, আওযায়ী, লাইছ বিন সা‘দ ও সুফইয়ান ছাওরীকে আল্লাহর গুণরাজি সম্বন্ধে বর্ণিত হাদিসসমূহ জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা সকলেই উত্তরে বলেন: ‘এগুলি যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবে মেনে নাও’। ইমাম আওযায়ী বলেন: বহুল সংখ্যায় তাবেয়ীগণের জীবদ্দশায় আমরা বলাবলি করতাম যে, আল্লাহ পাক তাঁর আরশের উপর বিরাজমান রয়েছেন এবং হাদীস শরীফে বর্ণিত তাঁর সব গুণাবলীর উপর আমরা বিশ্বাস স্থাপন করি।
ইমাম মালেকের উস্তাদ রাবীআ বিন আবু আব্দুর রহমান রহিমাহুল্লাহকে (আল্লাহ তাঁরই আরশের উপর উঠা) সম্পর্কে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তিনি বলেন: আল্লাহ তাঁর আরশের উপর উঠা অজানা ব্যাপার নয়; তবে এর বাস্তব ধরণ আমাদের বোধগম্য নয়। আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে রিসালাত, আর রাসূলের দায়িত্ব হলো স্পষ্টভাবে এর ঘোষণা করা এবং আমাদের কর্তব্য হলো এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ কে [الاستواء] সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেন: উপরে উঠা আমাদের জ্ঞাত আছে তবে এর বাস্তবধরণ অজ্ঞাত, এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য এবং এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা বিদ‘আত। উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে ঐ একই অর্থে হাদীস বর্ণিত আছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআ‘ত আল্লাহ তা‘আলার জন্যে ঐসব গুণাবলী সাদৃশ্যহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন, যা তিনি স্বীয় কোরআন শরীফে অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহীহ হাদীসসমূহে আল্লাহর জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁরা আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাদৃশ হওয়া থেকে এমনভাবে পবিত্র রাখেন যার মধ্যে তা‘তীল বা গুণমুক্ত হওয়ার কোন লেশ থাকেনা। ফলে তারা পরস্পর বিরোধী আস্থা থেকে মুক্ত হয়ে দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে আল্লাহর গুণাবলীর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে থাকেন।
বস্তুত: আল্লাহ পাকের বিধানই হলো, যেন মানুষ রাসূলগণের মাধ্যমে প্রেরিত সত্যকে আঁকড়ে তাঁর সমুদয় সামর্থ সে পথে ব্যয় করে এবং নিষ্ঠার সাথে এর অম্বেষায় থাকে, তবেই তাকে আল্লাহ সত্যের পথে চলার তৌফিক দান করেন এবং তার বক্তব্যকে বিজয়ী করে দেন। আল্লাহ পাক বলেন:
﴿بَلۡ نَقۡذِفُ بِٱلۡحَقِّ عَلَى ٱلۡبَٰطِلِ فَيَدۡمَغُهُۥ فَإِذَا هُوَ زَاهِقٞۚ وَلَكُمُ ٱلۡوَيۡلُ مِمَّا تَصِفُونَ﴾ [الأنبياء:18]
“বরং আমিতো বাতেলের উপর সত্যের আঘাত হেনে থাকি, ফলে তা অসত্যকে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষনাৎই বাতেল বিলুপ্ত হয়ে যায়।” (সূরা আম্বিয়া : ১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরেকটি আয়াতে বলেন:
﴿وَلَا يَأۡتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ وَأَحۡسَنَ تَفۡسِيرًا﴾ [الفرقان: 33]
“আর যখনই তারা তোমার সম্মুখে কোন নুতন কথা নিয়ে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে আমি এর জবাব তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি এবং অতি উত্তমভাবে মূল কথা ব্যক্ত করে দিয়েছি”। (সূরা ফুরকান: ৩৩)
হাফেয ইবনে কাছির রহিমাহুল্লাহ তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থে আল্লাহ পাকের বাণী:
﴿إِنَّ رَبَّكُمُ ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ﴾ [الأعراف:54]
“বস্তুত তোমাদের প্রভু সেই আল্লাহ যিনি আকাশ মন্ডল ও পৃথিবীকে ছয় দিনের মধ্যে সৃষ্টি করেন, অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠেন”। (সূরা আরাফ: ৫৪)
এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে অতি সুন্দর কথা বলেছেন যা অত্যন্ত উপকারী বিধায় এখানে প্রণিধানযোগ্য মনে করি। তিনি বলেন, এ প্র্রসঙ্গে লোকদের বক্তব্য অনেক, এর বিস্তারিত বর্ণনার স্থান এখানে নয়। আমরা এ ব্যাপারে ঐ পথই গ্রহণ করবো, যে পথে চলেছেন পূর্বেকার সুযোগ্য মনীষী ইমাম মালেক, আওযায়ী, ছাওরী, লাইছ বিন সা‘দ, শাফেয়ী, আহমদ বিন রাহওয়া সহ তৎকালীন ও পরবর্তী মুসলিমদের ইমামগণ। আর তা হলো: আল্লাহর গুণাবলীর বর্ণনা যেভাবে আমাদের কাছে পৌঁছেছে ঠিক সেভাবেই তা মেনে নেয়া, এর কোন ধরণ, সাদৃশ্য বা গুণ বিমুক্তি নির্ণয় ব্যতিরেকেই। সাদৃশ্য পন্থিদের মস্তিষ্কে প্রথম লগ্নেই আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে যে কল্পনার উদয় ঘটে তা আল্লাহপাক থেকে সম্পূর্ণরূপে বিদুরিত। কেননা কোন ব্যাপারেই কোন সৃষ্টি আল্লাহর সদৃশ হতে পারে না। তাঁর সমতুল্য কোন বস্তু নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তদ্রুপই, যেরূপ শ্রদ্ধেয় ইমামগণ বলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে ইমাম বুখারীর উস্তাদ নায়ীম বিন হাম্মাদ আল খুজায়ী অন্যতম। তিনি বলেছেন: যে লোক আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে কোন ব্যাপারে সদৃশ মনে করে সে কাফের এবং যে আল্লাহুর সব গুণরাজি অস্বীকার করে যা দ্বারা তিনি নিজেকে বিশেষিত করেছেন, সেও কাফের। কেননা আল্লাহকে স্বয়ং তিনি বা তাঁর রাসূল যেসব গুণরাজির দ্বারা বিশেষিত করেছেন, সৃষ্টির সাথে সেগুলির কোন সাদৃশ্য নেই।
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার জন্যে কুরআন শরীফের স্পষ্ট আয়াত ও সহীহ হাদীসসমূহে বর্ণিত গুণরাজি এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করে যা, আল্লাহর মহত্বের সাথে মানানসই হয় এবং তাঁকে যাবতীয় অপূর্ণতা, খুঁত বা ক্রটি-বিচ্যুতি থেকে পাক-পবিত্র রাখে সে ব্যক্তিই হেদায়াতের পথ সঠিকভাবে অনুসরণ করে চলে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৬৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লং পোস্ট হলে পড়তে অনীহা জাগে।ধন্যবাদ|
মন্তব্য করতে লগইন করুন