নে ঘুমা! নাকে ত্যাল দিয়া ঘুমা! আমি আছি না!

লিখেছেন লিখেছেন ইসলামী দৃষ্টিকোণ ১১ আগস্ট, ২০১৪, ০৮:০১:১৩ রাত

দাদাবাবু কহিলেন- অনেক তো হইল, নে ঘুমা! আমি বলিলাম- কী করিয়া ঘুমাইব, ঘুম তো আসিতেছে না। চোখ মুদিলেই রাজ্যের সব অনাচার, অবিচার আর অত্যাচার দল বাঁধিয়া আমা পানে ছুটিয়া আসে।



উহারা বেশ কিছুক্ষণ আমার বুকের ওপর উঠিয়া উল্লাস নৃত্যের তাণ্ডব চালাইতে থাকে- আমার বুকের ধড়ফড়ানি বাড়াইয়া দেয়। তারপর উহারা আমার মুখমণ্ডল, কপাল, ঠোঁট, কান প্রভৃতি স্থানে উঠিয়া সগর্বে হাঁটাচলা করে। প্রথম দিকে যখন উহাদের দেখিলাম তখন তেমন একটি পাত্তা দিতাম না। উহারা খুব বেশি যাতনা করিলেও বেদনা অনুভব করিতাম না- বড়জোর চুলকানি অনুভব করিতাম। রাগে বা বিরক্তিতে নয়, বরং ইচ্ছা করিয়াই মাঝে মধ্যে উহাদেরকে ডলা দিতাম এবং পিষিয়া মারিয়া ফেলিতাম। এ কাজে আমার কোনো ভয়, ক্লান্তি বা কষ্ট ছিল না। কারণ উহাদের আমার বড়জোর পিঁপড়া বা উকুনের চেয়ে বড় কিছু মনে হইত না। বরং মারিবার সময় অদ্ভুত এক মজা অনুভব করিতাম। উহাদের চিৎকার বা আর্তি আমার কর্ণকুহুরে প্রবেশ করিত না। যখন উহাদিগকে মারিবার জন্য ডলা দিতাম, তখন উহারা মরিবার পূর্বে ফাটিয়া যাইত। পুট করিয়া একটি শব্দ হইত- বড়ই অদ্ভুত সুন্দর এবং মনোরম সেই শব্দটি ছিল অনেকটা উকুন বা ঘামাচি ফোটানোর শব্দের মতো।

আমার সেই দিন বা সেই শুভ দিন আর নাই। ইদানীং অত্যাচার, অনাচার আর অবিচারের পোকাগুলি আকারে বেশ বড় হইয়া গিয়াছে। চেষ্টা করিয়াও উহাদিগকে আর ছোট ভাবিতে পারিতেছি না। উহারা লায়েক হইয়াছে, উহাদের আকার আকৃতি বৃদ্ধি পাইয়া গোবরে পোকা, বোতলা, বিছা, চ্যালা ও ভীমরুলের মতো হইয়াছে। শুধু কি তাই; ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার খাইয়া উহাদের যৌন উত্তেজনা ভয়ানক বাড়িয়া গিয়াছে। ফলে গত অল্প কিছু দিনের মধ্যে উহারা ব্যাপক হারে বংশবৃদ্ধি ঘটাইয়া বিরাট এক অজেয় বাহিনীতে পরিণত হইয়াছে। উহারা বড় হইবে কিংবা বংশ বৃদ্ধি ঘটাইবে তা যেমন ভাবিতে পারি নাই, তেমনই এ কথা ভাবিতে পারি নাই যে, উহারা নিজেরা নিজেরা সঙ্গী সাথী জুটাইয়া এত বড় বাহিনী বানাইয়া ফেলিবে।

দাদাবাবু আমার কথাগুলি মনোযোগসহকারে শুনিলেন। তারপর স্মিতহাস্যে আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দিলেন। বলিলেন, বাজারে লাল রঙের নবরত্ন ত্যাল আসিয়াছে। নাকে ও মাথায় মাখিলে বেশ শীতলতা অনুভব হয়। তুই শুইয়া পড়, আমি তোর নাকে- মাথায় ত্যাল মাখিয়া দিই।

দাদার আন্তরিকতায় আমি বেশ মুগ্ধ। কিন্তু তিনি আমার নাকের গভীরে আঙুল ঢুকাইয়া ত্যাল মালিশ করিবেন কিংবা মাথায় ত্যাল মালিশ করিয়া দিবেন- এমনটা ভাবিতেই এক ধরনের ভয় ও শঙ্কা আমাকে পাইয়া বসিল। মনে হইতে লাগিল, ত্যালের সহিত হয়তো বিষ মাখাইয়া দিবেন। বিষন্ন মুখে দাদাবাবুর দিকে তাকাইয়া বলিলাম, লাগিবে না! ও আমি নিজেই করিয়া নিতে পারিব, আপনার আর কষ্ট করিতে হইবে না। দাদাবাবু কী বুঝিলেন, বলিতে পারিব না- তবে মুখখানা ভার করিয়া অন্য কামরায় চলিয়া গেলেন।

একা একা বসিয়া নবরত্ন ত্যালের বোতল লইয়া নাড়াচাড়া করিতে থাকিলাম এবং ভাবিতে চেষ্টা করিলাম, দাদাবাবুকে অবিশ্বাস করাটা কি ঠিক হইল? ইদানীং যে আমার কী হইয়াছে, তাহা আমি নিজেই জানি না! তবে কিছু একটা যে হইয়াছে তাহা বিলক্ষণ বুঝিতে পারি। কাহাকেও বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। আবার অন্যরাও আমাকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। আমার আশপাশের কাছের মানুষগুলো আমার ওপর এখন আর নির্ভর করিতে পারিতেছে না নতুবা ইচ্ছা করিয়াই নির্ভর করিতেছে না। যখন তাহাদের সামনে কথা বলি, তখন তাহারা হয় মাথা নিচু করিয়া থাকে নতুবা অমনোযোগী হইবার ভান করিয়া এদিক-ওদিক ইতিউতি করিয়া তাকাইতে থাকে। আমি অনেকটা বেহায়ার মতো তাহাদের চালাকি বুঝিবার পরও আমার বক্তব্য চালাইয়া যাইতে থাকি।

ইহার পর যখন আমার কর্মস্থলে ফিরিয়া দানখয়রাতের ভাণ্ড নিয়া বসি, তখন সেইগুলি গ্রহণ করিবার জন্য রঙ-বেরঙের মানুষের অভাব হয় না। ইহারা আসিয়া আমার পদতলে ঝাঁপাইয়া পড়ে। আমার মুখ পানে চাহিয়া হু হু করিয়া কাঁদিয়া ফ্যালে আর বলে, আমার জন্য নাকি তাহাদের বড়ই মায়া এবং মহব্বত।’ তাহারা আমার জন্য তাহাদের জান কোরবানির নিমিত্তে এতটাই উদগ্রীব যে, পারিলে তখনই লগার মধ্যে নিজেদের হাত ঢুকাইয়া কলিজাটা ছিঁড়িয়া আমার পায়ে বিসর্জন দিয়া ফেলে।

বহু বছর ধরিয়া এই ধরনের ছলচাতুরী আর ভণ্ডামি দেখিয়া আসিতেছি। ফলে মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণা বড়ই নিম্নমানের। কত মানুষ আমার কাছে আসিল- জ্ঞানবুদ্ধিতে কাহারো কাহারো মাথায় একটি চুল আর অবশিষ্ট নাই। বুদ্ধির চোটে সব উঠিয়া গিয়াছে। পুরা মাথা সাহারা মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করে। কাহারো কাহারো পেট বুদ্ধির যন্ত্রণায় ভীষণ ফুলিয়া উঠিয়াছে- ভাবখানা এমন, অচিরেই পেট যদি লোহা-তামা ও স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত দিয়া মুড়াইয়া দেওয়া না হয়, তাহা হইলে উহা যে কোনো সময় ফাটিয়া পৃথিবীতে প্রলয় ঘটাইয়া দিতে পারে। ভয়ে ভয়ে উহাদিগের সঙ্গে কথা বলিতে আরম্ভ করি এবং অচিরেই বুঝিতে পারি, তাহাদের মস্তিষ্ক আর পেট কী জিনিস দ্বারা ভর্তি রহিয়াছে। ইহার পরই আমার বমন ভাবের উদ্রেক হয়- মনে হয় পেট ফুটা করিয়া দেই। কিন্তু দুর্গন্ধের কথা চিন্তা করিয়া কোনো কিছুই করিতে পারি না।

ধর্মকর্মে দুর্বলতার কথা জানিয়া অনেক বকধার্মিক আমার দরবারে ভিড় জমায়। তাহারা লম্বা দাড়ি রাখিয়া, সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিয়া মাথায় মস্তবড় এক কিস্তি টুপি বসায়। ইহারা হাতে তসবি রাখে, গায়ে আতর মাখে ও কথায় কথায় সুবহানাল্লাহ বলিয়া চিল্লা মারে। তাহাদের চিল্লাবিল্লা শুনিলে মনে হয়, উহারা বোধহয় মারেফাতের সর্বোচ্চ মাকামে পৌঁছিয়া গিয়াছে! উহারা মহান আল্লাহর প্রেমে ফানাফিল্লাহ হইয়া গিয়াছে। রাসূল সা:-এর ওপর দরুদ না পড়িয়া উহারা বোধহয় সকালের নাশতা খায় না। কিন্তু কুরআন, হাদিস, ইজমা-কিয়াসের জ্ঞান গরিমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করিলে উহারা বড় বড় হেঁচকি তুলিয়া কেরামতি দেখাইবার চেষ্টা করে। উহাদের ব্যক্তিগত নৈতিক জীবনের অনাচার, ব্যভিচার আর নাফরমানির কথা শুনিয়া শুনিয়া মানুষজনের ধর্মকর্মের প্রতিই বিশ্বাস হারাইয়া ফেলিয়াছি। প্রথম প্রথম চুপ করিয়া থাকিতাম। পরে উহাদের নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলাম। শেষমেশ ব্যর্থ হইয়া শাস্তিদানের মাধ্যমে ঠিক করিতে না পারিয়া বিচ্ছুদিগকে উঠিতে বসিতে অপমান করিতে শুরু করি- ইতর প্রাণীদের মতো। ইহার পরও উহারা থামিয়া যায় নাই; বরং পাঞ্জাবি-পাজামা আরো সাদা করিয়াছে, নতুন নতুন আতর মাখিতেছে এবং চুল-দাড়িতে খেজাব মাখিয়া আমার গৃহের আশপাশে ঘুর ঘুর করিতেছে।

কিছু সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী নিত্য আমার দরবারে হাজিরা দেয়। উহারা কিসের সাংবাদিক এবং কিসের বুদ্ধিজীবী তা আমি আজ অবধি বুঝিতে পারিলাম না। সাংবাদিকেরা কোনো পত্রিকায় চাকুরী করে না। দু’কলম লিখে না। এমনকি ফেসবুক বা টুইটারে একটি স্ট্যাটাসও দেয় না। জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমরা করো কী? উহারা বলিল, আমরা চেতনার দণ্ড লইয়া ঘোরাফেরা করি। দণ্ডটিতে তৈল মর্দন করি এবং জায়গা বেজায়গায় সুযোগ পাইলে বিনামূল্যে দণ্ডের ব্যবহার করি।’ আর কী করো? দাঁত বাহির করিয়া উহারা বলিল, দেশ জাতি নিয়া সর্বদা চিন্তাভাবনা করি; সাংবাদিক সমাজের ভালোমন্দ নিশ্চিত করি। আমাদের মতো আত্মত্যাগী প্রাণী এই পৃথিবীতে নাই। আমাদের আত্মত্যাগ গরু-ছাগল ও মুরগি অপেক্ষাও উত্তম। এসব প্রাণী জন্ম নেয় কেবল অন্যের খাদ্য হইবার জন্য। মরিলে গোশত দেয় আর বাঁচিয়া থাকিলে দুধ দেয়, ডিম দেয়, গোবর, বিষ্ঠা দেয়। সাংবাদিকদের মধ্যে যাহারা কাজ করে আমরা বেকার থাকিয়া উহাদের কর্মের পরিবেশকে প্রতিযোগিতাহীন করি। উহারা দিবারাত্র কর্ম করে বলিয়া নিজেদের কথা এবং স্ত্রী-কন্যা-বোনদের কথা ভাবিতে পারে না। তাই আমরা কর্মজীবী সাংবাদিকদের অরক্ষিত ধন সম্পদ, পরিবার পরিজন, মানসম্মান এবং অন্যান্য স্বার্থ মাথায় করিয়া লাফাইতে থাকি। আমাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। চুপ থাকিয়া উহাদের কথা শুনিলাম এবং বমন বমন অবস্থার ইঙ্গিত অনুভব করিয়া বেসিনের নিকট গেলাম। ফিরিয়া আসিয়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের পানে তাকাইলাম। উহাদের পোশাক পরিচ্ছদ, অবিন্যস্ত কেশ, দাড়ি আর মোচ দেখিয়া হাইকোর্ট মাজারের কথা স্মরণে আনিলাম। কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করিতে সাহস পাইলাম না।

মানুষের কর্মযোগ, বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং অন্যান্য সুকুমারবৃত্তির ওপর আমি বিশ্বাস হারাইয়া ফেলিলাম কিছু শয়তানরূপী মনুষ্য পদবাচ্য পশুর কারণে। ইহাদের তাণ্ডবে সত্যিকার ভালো মানুষেরা অভিমান করিয়া আমায় ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। প্রথমে বুঝিতে পারি নাই কিন্তু যখন বুঝিলাম তখন চোখ মেলিয়া দেখি সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা পড়িলাম। বুঝিবার চেষ্টা করিলাম- জাহান্নামে বসিয়া কিরূপে পুষ্পের হাসি হাসিব। অনেক চেষ্টা করিয়াও ইদানীং হাসিতে পারিতেছি না। হাসার ভান করি যাহা হয়তো ভ্যাটকানি কিংবা বালখিল্য বলিয়া প্রতীয়মান হইতে পারে- কিন্তু কিছুতেই নির্মল ও পবিত্র হাসির মর্যাদা পায় না। যখন দেখিলাম মন্দ মানুষের দ্বারা অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত হইয়া গিয়াছি, তখন প্রায়ই ধৈর্য হারাতে শুরু করিয়া দিলাম। কারণ অকারণে মন্দ লোকদেরকে গালি দিতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু এতে করিয়া ফলাফল যে এতটা মারাত্মক আকার ধারণ করিবে তাহা স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারি নাই। ভালো লোকদিগকে মন্দ কথা বলিলে উহারা মুখ ভার করিয়া ফেলে- কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। অনেকে আবার রাগ করিয়া চলিয়া যায়। কিন্তু মন্দ লোকদিগকে ঝাঁটা মারিলেও তাহারা হাসিবে। যদি রাগ করিয়া তাহাদের কান কাটিয়া দেই তাহা হইলেও তাহারা বলিবে- উত্তম কর্ম হইয়াছে। যদি প্রকাশ্যে বেত মারি কিংবা আরো নির্যাতন করি তাহা হইলেও উহারা আমাকে ছাড়িয়া যাইবে না। উহাদের ধৈর্য সহ্য করিতে দেখিয়া প্রথম দিকে বড়ই মজা পাইতাম। রাতে সুন্দর ঘুম আসিত। সকালে জাগ্রত হইলে নিজেকে তরতাজা মনে হইত। কিন্তু ইদানীং সবকিছু উল্টাপাল্টা হইয়া গিয়াছে।

আমার জীবনে একান্ত গোপনীয় কিছু সুকর্ম রহিয়াছে। ওইগুলির কল্যাণে আমার বিবেকবোধ এখনো মরিয়া যায় নাই। বিবেক প্রায়ই ঘুমাইয়া থাকে অনেকটা কুম্ভকর্ণের মতো। তবে হঠাৎ হঠাৎ জাগিয়া উঠে এবং আমাকে কিছু উচিত কথা শুনাইয়া দিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়ে। সেই দিন বিবেক হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়া উঠিল- আমার মনমস্তিষ্ক এবং হৃদয় স্বল্প সময়ের জন্য হইলেও একত্রে কর্ম শুরু করিল। উহারা জানাইল যে, মহা সর্বনাশ ঘটিয়া গিয়াছে। আমি যাহাদের সহিত অর্থাৎ যেই সকল মন্দ লোক গালি দিয়াছি এবং মারধর ও অত্যাচার করিয়াছিলাম উহারা আমার সম্মুখ হইতে গিয়া সাধারণ মানুষের ওপর বেদম প্রতিশোধ নিয়াছে। অত্যাচার, অনাচার, অবিচার, ব্যভিচার, দুর্নীতি, লুটপাট, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি- এহেন অপকর্ম নাই যে, তাহারা করে নাই। মন্দ লোকেরা যেহেতু আমার সহিত চলাফিরা এবং উঠাবসা করে সেইহেতু লোকজন সব কিছুর জন্য আমাকেই দায়ী করিতেছে। বিবেকের কথামতো খোঁজখবর নেওয়া শুরু করিলাম এবং যাহা দেখিতে পাইলাম তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিব না। ইহার পর হইতেই ঘুমাইতে পারিতেছি না। চোখ বুজিলেই আশপাশের মন্দ লোকদের দ্বারা আহত, নিহত, অত্যাচারিত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত, প্রতারিত ও শোষিত মানুষজনের প্রবঞ্চিত আত্মা পিঁপড়ার বেশে আমার ঘুমন্ত চোখ, মুখমণ্ডল, গলা ও বুকের ওপর আসিয়া উল্লাসনৃত্য আরম্ভ করে। ঘুমের ঘোরে আমি ওইগুলিকে পিষিয়া মারিতাম। কিন্তু ইদানীং ওইগুলি যে কত বড় হইয়াছে তা ইতিপূর্বেই বলিয়াছি।

দাদাবাবুর দেওয়া নবরত্ন ত্যালের শিশিটি ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে দেখিতে আমার জীবনের ঘটিয়া যাওয়া উপাখ্যানগুলি নিয়া ভাবিতেছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করিলাম দরজার ফাঁক দিয়া দাদাবাবু উঁকি দিয়া চলিয়া যাইতেছেন। দ্রুত উঠিয়া বসিলাম এবং দরদভরা কণ্ঠে ডাকিলাম দাদাবাবু! ও দাদুবাবু, একবার আসুন তো, মাথাটি বড্ড ঘুরিতেছে। ঘুমাতে সাহস পাইতেছি না। আবার আপনার নবরত্ন ত্যালও মাখিতে ভয় পাইতেছি। দাদাবাবু ঘরে ঢুকিলেন এবং আমার বিছানার এক কোণে বসিলেন। তারপর বলিলেন, একবার কী ভাবিয়া দেখিয়াছ কেনো তোমার ঘুম আসে না কিংবা ঘুমের ঘোরে নানাবিধ দুঃস্বপ্ন তোমাকে তাড়া করে? কেনইবা রাজ্যে মন্দ লোকগুলি তাহাদের আদি নিবাস নরকালয় ছাড়িয়া তোমার আলয়ে আশ্রয় পায়? তোমার বচন পচিতে পচিতে উহার গন্ধ কতটা গগনবিদারী হইয়া উঠিয়াছে তাহা কি তুমি বুঝিতেছ? ভালো লোকেরা তোমার ত্রিসীমানায় আসে না, মনোহর পাখপাখালি তোমার বাগানে বসে না। প্রজাপতি, ফুল ফোটায় না। বর্ষা, বসন্ত কিংবা হেমন্তের নিমন্ত্রণ নিয়া বিধাতার বায়ু তোমার দক্ষিণের বাতায়ন দিয়া প্রবেশ করে না। তুমি কী মনে করিতে পারো- কতকাল আগে তুমি একটি হলুদিয়া পাখি দেখিয়াছিলে? কিংবা ‘বউ কথা কও’ পাখির ডাক তোমার কর্ণকে ধন্য করিয়াছিল। মৌমাছির গুঞ্জন, জোড়া শালিকের ডাক, আর বকুল ফুলের সৌরভের অভাবে তোমার চিত্ত মরিয়া যাইতেছে!

দাদাবাবু আরো বলিলেন- তোমার অস্থিরতার কারণে কেউ তোমাকে নির্ভরযোগ্য মনে করে না। তোমার মিথ্যাচারের কারণে কেউ তোমাকে বিশ্বাস করে না। তোমার অহঙ্কারের কারণে বসুন্ধরার বৃক্ষ, লতা, তরুরাজি এবং নির্বাক জন্তুজানোয়ার তোমাকে অভিসম্পাত দেয়। দেবদূতগণ তোমার বিরুদ্ধে বিধাতার নিকট নালিশ জানায়। তোমার ছলচাতুরীর জন্য তোমার আশপাশের লোক তোমাকে ভয় পায়, আর তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তোমাকে তুচ্ছজ্ঞান করে। তোমার অমানবিক নিষ্ঠূুরতা দিনকে দিন তোমার হৃদয়কে পাষান বানাইয়া ফেলিতেছে। পাষান হৃদয়ের কোনো প্রাণীর স্বাভাবিক চেহারা থাকে না- উহারা হাসিলেও কান্নার মতো মনে হয়- আর কাঁদিলে আশপাশের লোক সহানুভূতিশীল না হইয়া উল্টা উল্লাস প্রকাশ করিতে থাকে। পাষান পাষানীরা ক্রোধান্বিত হইলে উহাদের মুখ হইয়া যায় হায়েনার মতো আর শরীর হইয়া যায় সজারুসদৃশ। তোমার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ হইল- তুমি যদি কাউকে অনুগ্রহ বা করুণা করিতে চাও তবে সারা দুনিয়ার সকল প্রাণী, বৃক্ষলতা তরুরাজি তোমার করুণার ধনকে ঘৃণা করিতে থাকে। তাহারা সমাজ সংসারে অচ্ছুত হইয়া যায়। তাহার চাইতেও ভয়ঙ্কর সংবাদ হইল- তুমি যাহাকে তিরস্কার করো কিংবা ক্রোধান্বিত হইয়া অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাইয়া দাও, সেই লোকটির ভাগ্য খুলিয়া যায়। সারা দুনিয়ার মানুষ, পশুপাখি, বৃক্ষলতা, তরুরাজি এবং ফুলফলগুলি ওই মজলুমের পক্ষে তাহাদের বিধাতার নিকট ফরিয়াদ জানাইতে থাকে।

দাদাবাবুর কথা শুনিয়া বহুদিন পর সত্যিকার অর্থেই আমার কান্না পাইয়া বসিল। তিনি আমার কান্নাকে পাছে অভিনয় মনে না করেন এই ভয়ে বহু কষ্টে কান্না চাপাইয়া যাইতে চেষ্টা করিতে থাকিলাম। কিন্তু আমার দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষিত চুদ্বয় আজ আর আমার শাসন মানিল না। উহারা অঝোরে অশ্রু বর্ষণ করিতে থাকিল। লজ্জায় আমার চক্ষুদ্বয় মুদিত করিলাম। দাদাবাবু পরম স্নেহে আমার মাথায় অনেকখানি নবরত্ন ত্যাল ঢালিয়া দিলেন। মাথা মালিশ করিতে করিতে আমার কানের কাছে মুখ আনিয়া ফিসফিসাইয়া বলিলেন- আমার ট্যাপামণি! নে ঘুমা! আরাম করিয়া ঘুমা। আজ সারারাত আমি তোর শিয়রে বসিয়া থাকিব, তোর ঘুম পাহারা দিবে। আমি বাকি কথাগুলি আর শুনিতে পাইলাম না- কেবল এতটুকু মনে আছে যে, ঘুমাইবার পূর্বে পাশ ফিরিয়া শুইয়াছিলাম।

সাবেক সংসদ সদস্য

বিষয়: বিবিধ

১৪২৬ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

253480
১২ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:০০
বুড়া মিয়া লিখেছেন : ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File