একজন পথশিশু
লিখেছেন লিখেছেন বদর বিন মুগীরা ২৫ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:৩১:২৩ রাত
-স্যার,চা খাবেন?
পিছনে কারো আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফিরালো সাফওয়ান।ময়লা হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি গায়ে এক ৭ বছরের ছেলে চায়ের ফ্ল্যাস্ক নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
পড়ন্ত বিকেলে ফ্রি সময় পেয়ে ভার্সিটি লেকের পাড়ে একটি ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে আছে সাফওয়ান।সপ্তাহে ছযদিন টিউশনি থাকায় অন্যান্য দিনে বিকেলে সময় করে উঠতে পারেনা।কিন্তু যেদিন টিউশনি থাকেনা,সেদিন লেকের পাড়ের এই জায়গাটা অনেক প্রিয় হয়ে যায় সাফওয়ানের।
ছেলেটি সাফওয়ানকে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার মৃদুকন্ঠে বলে
-স্যার,চা খাবেন?
সাফওয়ান বাস্তবে ফিরে।ছেলেটিকে কাছে ডাকে।জিজ্ঞেস করে…
-নাম কি তোর?
-আব্দুল্লাহ।
-তোরা কয় ভাইবোন?
-তিন ভাই দুই বোন।আমি দুই নাম্বার।
-তুই স্কুলে যাসনা?
আব্দুল্লাহ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।কিছু বলার সাহস পায়না।যেখানে পরিবারে তিনবেলার খাবার জোগাড় হয়না,সেখানে স্কুলে যাওয়ার কথা চিন্তা করা বোকামি।
সাফওয়ান আব্দুল্লাহর মৌনতা লক্ষ্য করে আবার জিজ্ঞেস করে।
-কিরে জবাব দিলিনা?
-না স্যার।স্কুলে যাইনা।
-কেন যাসনা?
-কেম্নে যামু স্যার?পরিবারে সাতজন মানুষ।আব্বা ক্যাম্পাসে রিক্সা চালায়।রিক্সা চালাইয়া যা পায়,ঐডা দিয়ে মদ,গাঞ্জা খায়।আমগোরে কিছু দেয়না।মায়ও হারাদিন অন্যের বাড়িতে কাম করে।ঐডা দিয়ে আমগো হয়না।হেল্লাইগা আমরা বড় দুই ভাই হারাদিন চা বেঁচি।একদিন চা বেচতে না পারলে ঐদিন না খাইয়া থাকতে হয়।তাইলে স্কুলে যামু কেম্নে?
সাফওয়ানের অন্তরাত্না কেঁপে উঠে।ছোট সময়ের এক ঘটনা হূদয়ের মানসপটে নাড়া দিয়ে যায়।
সাফওয়ান মোটামুটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় অভাবের তাড়না কোনদিন বুঝতে পারেনি।কিন্তু হঠাৎ ধরা পড়লো,সাফওয়ানের আম্মুর পেটে টিউমার হয়েছে।অপারেশন করতে অনেক টাকার দরকার হবে। আব্বু উনার আয়ের একমাত্র দোকানটি বিক্রি করে,জমি-জমা বন্ধক রেখে আম্মুর অপারেশনের টাকা জোগাড় করে।দুই বছর পরে যখন আম্মু পুরোপুরি সুস্হ হয়,তখন পরিবারের অবস্হা অনেক নাজুক।অভাবের তাড়নায় সাফওয়ানের পরাশুনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।এই সময়ে আম্মুর ওষুধ কিনার জন্য অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে আব্বু আবার তার ব্যবসা দাড় করাতে সক্ষম হয়।
-স্যার!চা দিবো?
আব্দুল্লাহর ডাকে অতীত থেকে বাস্তবে ফেরে সাফওয়ান।আব্দুল্লাহর দিকে তাকায়।
-এক কাপ চা দে।
একটু পরে পুনরায় জিজ্ঞেস করে…
-সারাদিনে কত টাকার চা বিক্রি করতে পারিস?
কাপে চা ঢালতে ঢালতে আব্দুল্লাহ বলে….
সারাদিনে ৩০-৪০ টাকা লাভ হয়।কোন কোনদিন ৫০ টাকাও হয়।
-তোর স্কুলে যেতে ইচ্ছে করেনা?
একটু চুপ করে থেকে আব্দুল্লাহ বলে…
-লগের সবাই ইস্কুলে যায়।খালি আমিই যাইনা।আমারও যাইতে ইচ্ছে করে।কিন্তু কেম্নে যামু?
-আমি তোর মায়ের সাথে কথা বলবো।তারপর তোকে স্কুলে ভর্তি করে দিবো।
সাফওয়ান চা শেষ করে আব্দুল্লাহর হাতে পাঁচশত টাকার একটি নোট ধরিয়ে দেয়।আব্দুল্লাহ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলে…
-স্যার,এইডা ভাংতি দিমু কেম্নে?
-তোর ভাংতি দিতে হবেনা।এটা রেখে দে। আর স্কুলে ভর্তি করে দিলে পড়বি তো?
-হ স্যার,পড়মু।তয় মায়ের লগে কতা কয়ে হেরপর জানামু।
-আচ্ছা।আগামীকালই আমাকে জানাবি।
-আইচ্ছা। স্যার,এহন যাই।
সাফওয়ান পিছন থেকে আব্দুল্লাহর অপসৃয়মান প্রত্যয়দীপ্ত পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আর আগামীদিনের সম্ভাবনাময় একটি স্বপ্নকে মনের গহীনে বুনতে থাকে।।
বিষয়: বিবিধ
১০১১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্কুল না হয় যাবে, কিন্তু এটার কী হবে?-
একদিন চা বেচতে না পারলে ঐদিন না খাইয়া থাকতে হয়। তাইলে স্কুলে যামু কেম্নে?
আংশিক সমাধান প্রায়শঃই হোঁচট খেয়ে পড়ে-
সামষ্টিক প্রচেষ্টায় পূরোটাকে এক হিসাবে আনতে পারলেই স্থায়ী সমাধান হয়!
ফলপ্রসূ হয়!
(এটা আমার বাস্তবে দেখা অভিজ্ঞতার থেকে বললাম)
মন্তব্য করতে লগইন করুন