আমার বাবাই শ্রেষ্ঠ বাবা।
লিখেছেন লিখেছেন নিভৃত চারিণী ২৩ মার্চ, ২০১৪, ০৫:৩৫:৫২ বিকাল
আমার বাবা, গম্ভীর রাশভারী একজন সুপুরুষ।আর বাবা মানেই তো মাথার উপর বিশাল একটা বটবৃক্ষের ছায়া। ছোটবেলা থেকেই দেখছি,বাবা নিজের কাজের পাশাপাশি মা’কে সবসময় সংসারের কাজে সাহায্য করেন।সংসারের ভালোমন্দ, অভাব অনটনে দুজনে লড়েছেন একসঙ্গে।নিজের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হবে এই মতবাদ থেকে বাবা যোজন যোজন মেইল দূরে অবস্থান করেন। যেকোনো কাজেমায়ের সাথে পরামর্শ করেন। বহু ভাগ্যগুণে আমার মা বাবার মতো একজন স্বামী পেয়েছেন। আর বাবার সবচেয়ে ভালো লাগে যেইদিক টা সেটা হল সন্তানের সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ।ভাইয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পরও দেখি কেমন গলা জড়িয়ে, কাঁধে হাত রেখে কথা বলছেন।ব্যবসায়িক শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি বৌ বাচ্চার সম্পর্কের মাঝে বিন্দুমাত্র দুরত্ব আনতে দেননি কখনো।আর আমার বাবার মধ্যে একটা অভ্যাস লক্ষ্য করি, তাহলো একসাথে সবাই মিলে খেতে বসা।বাবা বলেন এতে করে নাকি পরিবারের সকলের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
আমার মনেহয় প্রত্যেকটা পুরুষ যদি আমার বাবাকে আইডল বানাত, তাহলে সব সংসারেই ভরেও উঠত হাসিখুশি এবং ভালোলাগা ভালোবাসায়।এটা জাস্ট আমার একটা ধারনার কথা বললাম।
এবার আসি আমার গল্পে-ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে আমার সখ্যতা একটু বেশী।ছোটবেলা বললে ভুল হবে বরং জন্মের পর থেকেই।পৃথিবীতে আসার ৮ঘন্টা পার হয়ে গেলেও আমি নাকি কান্নাকাটি তো দূরে থাক, চোখ মেলে পর্যন্ত তাকাইনি কারো দিকে।এদিকে মায়েরও জ্ঞান ফিরছিল না।সব মিলিয়ে এক প্রকার কান্নাকাটির রোল পড়ে গেছিলো রিলেটিভদের মাঝে।
আর আমার বাবা! যেন নির্বাক, নিস্প্রান নিথর একটি দেহ। দাদী বাবাকে বললেন - মসজিদে গিয়ে নামাজে দাঁড়া, আল্লাহ আছেন,সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।বাবা দৌড়ে গেলেন মসজিদে।কয়েক ঘণ্টা বাদে ফিরে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন তিনি।ঠিক তখনই নাকি সর্বপ্রথম পিটপিট করে তাকিয়েছিলাম বাবার দিকে। বাবা তো মহাখুশি, চিৎকার করে শুকরিয়া আদায় করলেন।সেই থেকেই সখ্যতার শুরু।আর আমিই বাবা-মা'র প্রথম সন্তান হওয়ায় আদর ভালোবাসার পরিধিও ছিল অন্য সবার চাইতে একটু ব্যতিক্রম।
এদিকে আমার যখন ১বছর ৫মাস বয়স, তখন পৃথিবীকে আলোকিত করে জন্ম নেয় আমার ছোটভাই তানভীর।তখন থেকে বাবাই আমার সব কিছু।কারণ একসাথে দুইজনকে সামাল দেয়া একা মায়ের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। খাওয়া দাওয়া, গোসল ঘুম ঘুরতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি আমার সব দায়িত্ব বাবার কাঁধে।যখন একটু বড় হলাম, আধো আধো বুলি বের হচ্ছে মুখ থেকে তখন বাবাকেই আমি ডেকেছিলাম। তাও আবার ‘’মাম” বলে। এভাবেই করেই বাবার আঙ্গুল ধরে আস্তে আস্তে বলতে শিখেছি,হাঁটতে শিখেছি, ভালোমন্দ বুঝতে শিখেছি।ফুলের প্রতি ভালাবাসাও সর্বপ্রথম আমার বাবার কাছ থেকেই শিখেছি আমি। প্রতিদিন ফজরের নামায পড়ে আসার সময় আমার জন্য শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতেন বাবা।
প্রথম মাদ্রাসায় যাওয়ার স্মৃতি এখনো আবছা আবছা মনে আছে আমার।পাঁচ বছর বয়সে এলাকার একটা মসজিদের মক্তব ভর্তি হতে যাই বাবার হাত ধরে।সেদিন সকালে বাবার আঙ্গুল ধরে গুটি গুটি পায়ে রওয়ানা হলাম মাদ্রাসার দিকে।হালকা হালকা শীত ছিল বোধহয়। তাই আম্মু গোলাপি রঙয়ের টুপিওয়ালা কার্টিগানটা পরিয়ে দিয়েছিলো।ঢাকা শহরের ব্যাস্তময় রাস্তাগুলো তখন ছিল একেবারেই নীরব সুনসান নীরবতা আর বাতাসের শব্দ।সাথে বাপ বেটির পটর পটর আলাপন। মাদ্রাসায় যাওয়ার পর বেশ ভালোই ছিলাম।আমার মতই আরও অনেক সঙ্গী সাথী পেলাম।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো যখন আব্বু আমাকে রেখে চলে যাচ্ছিলো তখন।ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। মনে পড়লে এখনো লজ্জায় এতোটুকুন হয়ে যাই।
আর এখন বড় হয়ে গেছি আমি।সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন হয়েছে আমার চারিধার।ভালোই লাগে না। ইশ ! সারাজীবন যদি ছোট-ই থেকে যেতে পারতাম!
এইতো সেদিনের ঘটনা।সকাল নয়টার দিকে মা ফোন করে বললেন, তোর বাবা আসছেন আজ তোদের বাসায়। আমিতো মহা খুশি। অনেকদিন পর আজ আবার বাবা আসছেন আমাদের বাসায়। ব্যবসা বানিজ্য ও বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে তেমন একটা আসতে পারেন না আমার কাছে। অথচ আগে প্রায় প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও এসে আমায় দেখে যেতেন বাবা। অবশ্য আর কত! বয়স তো তাঁর আর কম হল না। আমিও আর আগের মতো ছোট্ট খুকিটি নই। আমিও বেশ বড় হয়েছি। মায়ের বাসায় যাওয়ার জন্য এখন আর রাত-বিরাতে পাগলামি করিনা। ফোন করে কান্না-কাটি করিনা।
তো সেই সকাল থেকে অপেক্ষা ......।বাবার পছন্দের কয়েকটা আইটেম করে সেই যে বসে আছি। এখনো তাঁর আসার খবর নেই। অথচ এত সময় লাগবার কথা নয়।একটু দুশ্চিন্তাও হচ্ছে এখন। কলিংবেল বাজলেই ছুটে যাচ্ছি এই বুঝি বাবা এলেন। না এখনো তিনি আসেননি। ফোন দিয়ে জানতে পারলাম কেবল কাকরাইল মোড়। বললেন আসতে আসতে জুম্মার সময় হয়ে যাবে। নামাযটা পড়েই ঘরে ঢুকবো। বাসায় আসলে জামাত ছুটে যেতে পারে।বললাম আচ্ছা। তবে নামাজ পড়ে কিন্তু দেরী করা চলবে না হুম...... মগবাজার থেকে পুরান ঢাকা। রাস্তায় এত জ্যাম ! ছুটির দিনগুলোতেও ঢাকাবাসী একটু শান্তিতে কোথায় যেতে পারে না। এ জ্যাম যেন জন্ম জন্মান্তরের......। এদিকে অপেক্ষা করে করে আমি অস্থির।
ধ্যাত ! কতদিন পর আসছেন। বাপবেটি মিলে একটু গল্প করবো তাও বুঝি আর হবে না। কারণ দুপুরে খেয়েই বাবা আবার কোথায় যাবেন। আগে থেকেই কথা দিয়ে রেখেছিলেন।
সে যাই হোক! নামায শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। সবাই খাবার সামনে নিয়ে অপেক্ষা করছি।এখনো বাবা আসছেন না। আবার কোথায় আটকে গেলেন। এসব বলাবলি করছিলাম। এসময়ই দরজায় বাবার সালাম। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলেই একরাশ অভিমান নিয়ে বললাম – এমনিতেই দেরী, আবার কোথায় গিয়ে সময় পার করলেন? বললেন তোর জন্য টক বরই আর চিপস খুঁজতে খুঁজতে দেরী হয়ে গেলো। আমারই ভুল হয়েছে। এমনিতেই আজ শুক্রবার, নামাজের পরপরই দোকানপাট খোলা না থাকারই কথা।ওমনি আমার বর বলে উঠলোঃ টক বরই আর চিপসকে বিশেষিত করার দরকার কি ছিল আব্বা ?তাছাড়া ও তো এখন আর ছোট নেই যে চিপস খাবে!!! বাবা বললেন ! ও তো মিষ্টি বা ফলফলাদি কিছু খেতে চায় না তাই এসব নিয়ে আসা।
বাবার কথা শুনে ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠলো। এত বড় হয়েছি, এখনো বাবা-মায়ের কাছে ছোটোই রয়ে গেছি। সেই ছোটবেলার মতই খেয়াল করেন আমার পছন্দ –অপছন্দের বিষয়গুলো।আল্লাহর অশেষ দোয়া সন্তানের জন্য স্বীয় বাবা- মায়েরা। কেউ এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসে না পৃথিবীতে একমাত্র বাবা- মা ছাড়া। ভাবতে ভাবতে গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো একফোঁটা জল !
আমার এই গম্ভীর চুপচাপ ভাল মানুষ আব্বুটাকে আমি প্রচন্ড ভালবাসি। কিন্তু কোনদিন আমার এই আব্বু টাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারি নি, আব্বু আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালবাসি।
দোয়া করি সুস্থ থাকো, ভালো থাকো যেমন আমদের জন্য তুমি কামনা করো বাবা।
বিষয়: Contest_father
২২৪৩ বার পঠিত, ৪৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
টক বড়ই
চিপুস চিপুস
খুব ভালো লাগ্লো পিল্লাচ.......
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ভাই
একদম হুবহু মিলে গেলো। অনেক ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
ভোট দিয়্যুম দিয়্যুম কই আই মিছিল করিলাম
অ্যাই কেন্নে ভোট দির্য়ুম আর বাপযে নাই।
আগের কোন স্মৃতি নিয়ে লিখে ফেলেন না,
ভোট কিন্তু দিতেই হবে হ্যাঁ!
একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আব্বুকে ভালোবাসার কথা বলে ফেলেন। এরপর দেখবেন আর কোন সংকোচ কাজ করবে না।
শুভকামনা রইলো।
ধন্যবাদ আপু তোমাকে।
চমৎকার লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ
ধন্যবাদ আপু।
যার পাশে ম্লান জীবনের সমস্ত বৈভব....
আমি যা বলবো আরোহী বলেই দিয়েছে। আদুরে গলায় বলে ফেলুন, বাবা এত্তোগুলা ভালোবাসি তোমাকে......
আমার বাচ্চারা উঠতে বসতে ভালোবাসি বলে আমাকে। ওদের আই লাভ ইউ শুনতে শুনতে বিরক্ত লাগে মাঝে মাঝে। কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য যখন চোখের আড়াল হয়, ঐ ভালোবাসার স্মরণ আমার চোখে জড়ো হয় শিশির কণার মত...! অধরা সেই অনুভূতি, অপ্রকাশ্য সেই শব্দরা...!
তাই জানি সন্তানের মুখে ভালোবাসি শব্দটি কত মধুর বাবা-মার কাছে।
অনেক অনেক দোয়া ও শুভকামনা রইলো আপনাদের সবার জন্য।
এখনো মা হইনি তো, তাই সেরকমভাবে এখনো ফিল করতে পারি না হয়ত। কিন্তু আপনার কথায় কেমন একটা অনুভূতি নাড়া দিয়ে গেলো।
ধন্যবাদ আপু। আপনার ও আপনার সন্তানের জন্য আমার পক্ষ থেকে শুভকামনা রইলো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ।
আপনার প্রাইজ কনফার্ম, ইনশাআল্লাহ...
না পাইলে কিন্তু এবার আপনাদের বাড়ীতে হানা দেবো।
ধন্যবাদ
কেউ কিছু জানলে জানাও প্লীজ !
মন্তব্য করতে লগইন করুন