রোজার রকমফের
লিখেছেন লিখেছেন জুম্মি নাহদিয়া ২৭ মে, ২০১৪, ০৪:১৪:০৩ বিকাল
জার্মানিতে প্রথম রমজান মাস পেলাম দু বছর আগে । খুব মিক্সড অভিজ্ঞতা হল ।বাংলাদেশে রোজা শুরুর দিন পনের আগে থেকেই মনের ভেতর কেমন যেন একটা বাতাস বইতো । তেঁতে ওঠা দুপুরবেলায় কোন যানবাহন না পেয়ে অগত্যা পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার সাথে সাথেই চলে গেছে কারেন্ট , কিন্তু দক্ষিনে যে জানালা টা আছে সেদিক দিয়ে এত মিষ্টি বাতাস বইছে যে পর্দা উড়ে যাচ্ছে । মনের ভেতর রোজা আসি আসি করা বাতাসের অনুভূতি অনেকটা এরকম ।
একটা নিয়মতান্ত্রিক পরিশুদ্ধ জীবনের প্রত্যাশা ছাড়াও সমস্ত রোজায় কিছু ইউনিক দৃশ্য দেখতে পাবার আনন্দ মনের ভেতর উঁকিঝুকি দিত । জমজমাট অলি গলি । পাড়ার বেকার এবং টেডি ছেলেপেলে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ছোট্ট ঈদ কার্ড কিংবা ইফতারের দোকান সাজিয়ে বসেছে , সেহেরীর সময় স্বেচ্ছাসেবক ঘুম ভাঙ্গানির দল তাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে অ্যানাউন্সমেন্টে ঝাঁপিয়ে পড়েছে , মাদ্রাসার ছেলেরা নিজস্ব সুরে বহুল পরিচিত ইসলামী গান গুলো গাচ্ছে , ইফতারের আগ মুহূর্তে গ্যাসোদ্দির [অরিজিনাল নাম খুব সম্ভবত গিয়াস উদ্দিন] মায়ের আগমন এবং ´´আইজ আফার বাসাত ইস্তারি খাইয়াম´´ উক্তি , আম্মু অফিস থেকে ফেরার সাথে সাথে আম্মুর হাতের দিকে তাকানো এবং´´ কিছু আনছো ´´জাতিয় প্রশ্ন , এই মুহূর্তগুলো কি যে ভাল লাগার বোঝাতে হয়ত পারবোনা । বিশেষ করে আব্বুর সাথে ছোলা ভাজা খাওয়া নিয়ে প্রতিনিয়তই মান অভিমানের ঘটনা ঘটত সে সময় । কেমন করে মেনে নিই যে আমি আমার সেই প্রানবন্ত সময় কে পেছনে ফেলে এসেছি । এই দুঃখবোধ একদিকে যেমন কাজ করছিল অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন দায়িত্ববোধের জীবনে রোজা আমাকে কতটুকু পরিশুদ্ধি এনে দিতে পারবে এটা নিয়েও কিছুটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করছিল ।
যতটা নিরিবিলি জার্মানিতে রোজা আসে ভেবেছিলাম আসলে অতটা না । আমি অনেক বেশি অবাক হয়েছি এত চমৎকার ভাবে এখানকার মুসলিমরা রোজার উদ্দেশ্য কে ধারণ করার চেষ্টা করে ।
তবে ঐ যে বললাম মিক্সড অভিজ্ঞতা , মুসলমানদের হৃদয় দিয়ে রোজা রাখার দৃশ্যের পাশাপাশি অদ্ভুত কিছু কথা বার্তা - চিন্তা ভাবনার সাথে নতুন করে পরিচয় হল।
আমার আহমাদ তখন পেটে ছিল । ইনটেনসিভ একটা ভাষা শেখার কোর্স করতে হত বাসা থেকে বেশ দূরে গিয়েই ।
তাই রোজা আমার জন্য ফরজ ছিলনা আবার নাজায়েজও ছিলনা , চেষ্টা করতাম কিছুটা রিল্যাক্স মুডে রোজা রাখার । এই যেমন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাগে একটু খাবার রাখা যাতে করে আহমাদের কষ্ট হচ্ছে আমার কারণে এরকম কোন সিগন্যাল পাওয়া মাত্র রোজা ভাঙতে পারি । আল্লাহর রহমতে বেশির ভাগ দিনেই কোন সমস্যা হয়নি । আমার কোর্সমেট দের ভেতর কয়েকজন ইরানি ছিল । ইরানিদের সম্বন্ধে আমাদের সাধারণদের পোষণকৃত ধারনা যে অনেকাংশে ভুল সেটা ওদের সাথে না মিশলে বুঝতাম না । ওরা আমাকে প্রায় ক্লাসেই নামাজ রোজা বিষয়ক বেশ থিওরি শোনাত । মোহাম্মদ নামের একটা ছেলে ছিল । সারাক্ষণ হারিবো চিবাতো সে । হারিবো হচ্ছে শুকরের চর্বি থেকে বানানো জেলোটিন মিস্রিত এক রকমের ক্যান্ডি । একদিন এক টিচার বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন , ´তুমি তো মুসলিম , তুমি তোমাদের উপোস দিবসেও হারিবো খাচ্ছ ?´ সে উত্তর দিল , আমি মোডারেট মুসলিম ,অত প্রিজুডিস নাই আমার । সব কিছু আমার জন্য এগাল´( মানে ব্যপার না) । আরেকদিন শেহজাদি মেয়েটা বলে বসলো , রোজা তার জন্য ইরানে ফরজ কিন্তু জার্মানিতে না । এত লম্বা সময় রোজা রাখা ইরানিদের পক্ষে কষ্টকর তাই একজন ইরানি হিসেবে সে রোজা রাখেনা । ফারশিদ দাবিরি ছিল আরেক কাঠি সরেস । আমি উপায়হীন হয়ে একাডেমী বিল্ডিং এর সিঁড়ির চিপায় নামাজের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম আর এত ঘণ্টা ক্লাস করেও রোজা রাখছিলাম সে কারণ আমাকে সে চরমপন্থি আখ্যা দিয়েছিল । চুক চুক করে মাথা নাড়ত আর আমার অনাগত সন্তানের খারাপ ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার চেহারা করত । বলত ´´ডু ,ইজলাম , খোমেনি, আহমাদেনিজাদ আলে জিনড শাইসে এক্সট্রিমিষ্ট ´´অর্থাৎ তোমরা সবাই শিট কিসিমের চরমপন্থি । এরা ছাড়াও প্রচুর পরিমানে আধুনিক হিজাব পরা তুর্কি , আফগানিদের রোজার দিনে দুপুরে লাইট বিয়ার কিংবা সিগার টানতে দেখেছি । এদের অবাস্তব মোডারেটপনা আমার চোখ খুলে দিয়েছে সত্যি ।
´´প্রাগৈতিহাসিক´´ ইসলামের আধুনিকায়ন করাটা সুবিধাবাদীদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় এটা আমার কাছে স্পষ্ট হল । অনেকটা শেখ সাদি স্টাইলে বেয়াদবের বেয়াদবি দেখে নিজের আদবের অবস্থা মুল্যায়ন করার মত আমি যেন এদের দেখে দেখে প্রতিনিয়তই শিখেছি ।
তবে বর্তমান জার্মানির সাথে দশ বছর আগের জার্মানির অনেক ফারাক । দশ বছর আগে একেবারে সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশেই যেখানে লাইসেন্সড ব্রোথেল ছিল আজকে সেখানে মসজিদ । দিনমান প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের আনাগোনা আর সন্ধ্যা থেকে তারাবির পর পর্যন্ত মসজিদ ও মসজিদের আশপাশ মুসল্লিদের দখলে থাকে। কদর রাতের সন্ধানে মানুষ সারা রাত মসজিদে কাটিয়ে দিচ্ছে । ছোট ছোট বাচ্চারাও পিছিয়ে নেই । আব্বু আম্মুর সাথে পাল্লা দিয়ে তারাও রমজান মাস উদযাপন করছে ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি একরকম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছিল । তখন তুরস্ক থেকে প্রচুর মানুষ এসে এখানকার রাস্তা ঘাট সহ অবকাঠামোগত বিভিন্ন সেক্টরে অনেক অবদান রেখেছে । সে কারনে , এখানে তুর্কিদের আধিক্য যেমন আছে , দাপটও বেশ আছে। জার্মানিতে ইসলাম গ্রহনের হারও আশা ব্যাঞ্জক । আমি কনভার্টেড মুসলিমাহদের একটা গ্রুপের সাথে জয়েন করেছি জার্মানিতে আসার পর পরই । তাদের ইমান আমলের ধারে কাছেও আমি নাই এটা ভেবে একদিকে মন খারাপ লাগে অন্যদিকে জেনে বুঝে ইসলাম মানার প্রচণ্ড উৎসাহ পাই ।
এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটিরও মসজিদমুখী এবং ইবাদতমুখী হবার কিছুটা চেষ্টা করে , তবে জাতি হিসেবে আমরা বোধহয় একটু বেশিই উৎসবপ্রিয় । তাই হয়ত নামাজে আনুপাতিক হারে উপস্থিতির চাইতে ইফতারের আইটেমের দিক থেকে অন্যদের চেয়ে, এমন কি পার্শ্ববর্তী ইনডিয়ানদের চেয়ে আমরা বেশ এগিয়ে থাকি । এটা আমার ব্যক্তিগত পর্যালোচনা তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে ।
ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছিল , বুকের ভেতর কেমন যেন করছিল । সারাবছর যদি রমজান মাসের মত উপলব্ধি হত! আমল বাড়ানোর জন্য একটু হলেও চেষ্টা থাকত ! দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই আছি না কেন সবশেষে আসলে মিলিয়ে দেখলাম , রোজার আবেদনে আসলে কোন তারতম্য নাই । ভাললাগার মুহূর্ত গুলো পৃথিবীর সব প্রান্তেই এক রকম সুন্দর । প্রিয় মানুষ গুলো কে কাছে পেলে অথবা স্বদেশের ঘ্রাণ পেলে সময়টা পূর্ণতা পায় , পার্থক্য এতটুকুই ।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৮ বার পঠিত, ৭০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাল লাগল ।
চম..........লিখেছেন আপু ।
ধন্যবাদ ।শুভেচ্ছা নিবেন - - - - -
বাকিটা আপু ঐ ডট চিহ্নে হারিয়ে গেছে !
বিদেশের মাটিতে রমজান ও ঈদের অভিজ্ঞতা গুলি ভাল লাগল। গত বছর শুনেছিলাম লন্ডন এর মসজিদে শেষ দশদিন ইতেকাফ কারিদের সুযোগ দেয়ার জন্য লটারি করতে হয়েছিল। আর আমাদের দেশে ইতেকাফের মানুষ পাওয়া যায়না। অনেকে খতম তারাবি পরার পর আর পরেননা। যেন তারাবি আর পড়তে হয়না!!
এই দেশে কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একজন ফতোয়া দিয়েছেন যে মেয়েদের মসজিদে যাওয়া নাকি কুফরি!
হযরত উমর (রাঃ) নাকি এটা নিষিদ্ধ করেছিলেন।
দয়া করে যদি আ১টু রেগুলার হতেন, তাহলে আর্ড়ো ওন্নেক ভাল্লাগতোহ্...
Converted muslims are more dedicated than born muslim.
খুব ভাল লাগলো। নিয়মিত লিখবেন
জার্মানির রোজা সম্পর্কে জানতাম না।
আপনার লেখা পড়ে প্রচুর জানলাম
ইস্ট লন্ডন মসজিদ এলাকায় রমজানের মাসে আসলেই একটা আলাদা উৎসব ভাব লক্ষ্য করা যায়। সবার মাঝেই একটা উৎফুল্লতা দেখি।
একদিন এক পাকিস্তানী সহকর্মী বলল তোমরা তো ভাগ্যবান যে তোমরা ইস্ট লন্ডন মসজিদে নামাজ পড়তে পার!আসলেই ওইখানে নামাজ পড়ে কেন যেন তৃপ্তি পাই। ভালো লাগলো আপনার অনুভূতিগুলো জেনে। অনেক ধন্যবাদ
তবে দারুল হারব থেকে দারুল ইসলামে যাওয়া জরুরী জদিও তাতে আহলে বিদআতি থাকে।
জাজাকাল্লাহু খায়রান।
আবারো ধন্যবাদ কষ্টসাধ্য-সুন্দর লেখনীর জন্য।
ভালো লাগলো
ধন্যবাদ
আমি আপনার লেখা পড়েছি ফেসবুকে, নিরব পাঠক বলতে পারেন। আপনার লেখায় আল্লাহ অসাধারণ শক্তি দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। চাচার সন্তান হিসেবেই হয়ত অসাধারণ গুণ পেয়েছেন অনেকটা। আপনি দয়া করে নিয়মিত লিখবেন। ব্লগে লিখুন। আপনার পছন্দের আর চিন্তার বিষয়গুলোই লিখুন। সুন্দর আর সৃষ্টিশীল সাহিত্যনির্মানে ইনশা আল্লাহ আপনার লেখনীকে আল্লাহ কবুল করে নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। এখন আলোকিত সাহিত্য লেখার মানুষেরা এদিক ওদিক অল্প কয়েকজন হলেও একদিন ইনশা আল্লাহ এই মাটিতে, এই ভাষায় অনেক অনেক লেখক জন্ম নিবে যাদের কলমে ফুটে উঠবে স্রষ্টার ভালোবাসায় সিক্ত শব্দ, দৃশ্যপট, অনুভূতিমালা। আল্লাহ চাচাকে জান্নাত দান করুন, আল্লাহ সকল আলোকিত মানুষদের এবং আলো ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টায় রত বিশাল হৃদয় মানুষদের জান্নাতি হিসেবে কবুল করুন, তাদের কাজে বারাকাহ দিন।
আসলেই বাংলাদেশে আমরা যে কতভাবে আশীর্বাদপুষ্ট তা আমরা উপলদ্ধি করতে পারছিনা। বাপ-দাদার ধর্ম একটা পাইছি, ধর্ম-কর্ম না করলেও শুদু কলমা পড়ায় বেহেস্তে যাওয়ার আশা করি। আল্লাহ এ আমাদের বুঝার ও মেনে চলার তাউফিক দান করুক। আমিন
মন্তব্য করতে লগইন করুন