আজ ও কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারি না ।
লিখেছেন লিখেছেন অনুরাগ ২৫ মার্চ, ২০১৪, ১০:৫১:৩৯ রাত
আমি আমার বাবার নবমতম কন্যা আর বারতম সন্তান ।আমার মায়ের আটটি কন্যা সন্তানের পর জন্ম হয় আমার তিন ভাইয়ের তার পর জন্ম হয় আমার ।
মনে মনে ভাবছেন আহারে বেচারী কত অবহেলায় না জানি মানুষ হয়েছে । আসলে কিন্তু তা নয় । সবার ছোট হওয়াতে আমি পেয়েছি আমার ১১ ভাই বোনের আদর সাথে মা বাবার আাদর তো আছেই । পাজি ,জেদী একটু বেশীই ছিলাম বাবার আদরে ।পাজি আর জিদের কারনে কেউ কিছু বল্লে আমার বাবা বলত শেষ যার দেশ তার ওকে কেউ কিছু বল না ।
বাবার আদর আমার ভাগ্যে খুব বেশী দিন সয়নি মাত্র ১২ বছর বয়সে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি । আমার বাবা ছিলেন একজন অল্প শিক্ষীত মানে বাংলা পড়তেও লিখতে পারতেন মানে ক্লাস থ্রী পাশ একজন কৃষক ও ব্যাবসায়ী ।তার
ছিল অনেক পয়সা ও প্রচুর জায়গাজমি । আশেপাশের লোক জনেরা আমার বাবার নাম ধরে বলত তার শুধু বছর বছর মেয়ে হয় আর তার সংসারে উন্নতি ও আল্লাহ ঢেলে দিচ্ছেন ।আমরা এত গুলো বোন আমাদের আত্বীয় স্বজনেরা অনেক কটু কথা আমার মাকে বলত কিন্তু আমার বাবা এনিয়ে কখনো আমার মাকে কোন কোনদিন কোন খারাপ কথা বা খারাপ আচরন করেন নি ।
এতগুলো মেয়ে নিয়ে আমার বাবার মনে কোন কষ্ট তো ছিলই না আমার বাবা গর্ব করেই বলতেন আমার এগুলো মেয়েতো নয় একেক টা রত্ন । মেয়েদের আমার বাবা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষীত করতে না পারলে ইসলামী নিয়ম কানুন অনুসারে জীবন যাপনের শিক্ষায় কোন ঘাটতি রাখেন নাই ।
আমার বাবা অশিক্ষীত হলেও শিক্ষার মর্যাদা বুঝতেন ও শিক্ষীত জনকে মূল্যায়ন করতেন এবং আমার বাবা ছিলেন বুদ্ধীমান । আমার বাবা গরীবের ছেলে ও মাধাবী ছাত্র দেখে আমার বোনদের বিয়ে দিয়েছেন । তাদের লেখা পড়ার খরচ আমার বাবা দিতেন আর আমার বোনেরা আমাদের বাড়িতেই থাকত । যে প্রর্যন্ত তাদের লেখা পড়া শেষ হয়ে চাকরি না হত ।এভাবেই আমার বাবা তার ৮টা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ।আমার বোনের জামাইরা সবাই উচ্চ শিক্ষীত যদিও আমার বোনেরা তেমন শিক্ষীত নয় ।আমার ৮জন বোনের জামাই বর্তমানে ২জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ।ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।দুইজান ডাক্তার । দুই জন সরকারি কলেজের প্রফেসর ।একজন আর্মী অফিসার ,একজন মৎস্য কর্মকর্তা ।
আমার বাবা আমার ভাইদের মানুষ করে যেতে পারেনি ।আমার বড় দুই ভাই অল্প বয়সে বাবাকে হাড়িয়ে তাদেরকেই বাবার ব্যাবসা জায়গা জমি দেখা শুনা ও সংসারের হাল ধরতে হয় তাই বাধ্য হয়ে তাদের পড়াশুনা ছেড়ে দিতে হয় ।
আমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল তার ছেলেরাও মেয়ে জামাইদের মত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষীত হবে ।আমার বাবা আমাকে নিয়েও স্বপ্ন দেখতেন আর মেয়েগুলোকে তো পারলাম না ছোটমেয়েটাকে আমি লেখাপড়া করাব ।
আমি আর আমার ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টাস পাস করেছি ।আমার বাবার স্বপ্ন পূরন করেছি কিন্তু আমার বাবা দেখে যেতে পারেন নি ।এই কষ্টটা বুকের ভিতর সবসময় বাজে ।
আমার যখন ১২ বছর বয়স আমি মাত্র ক্লাস সেভেন শুরু করেছি তখন আমার বাবার পাকস্থলিতে আলসার ধরা পরে ব্লাডক্যানসার ছয়মাস পর মারা যায়। আমি আমার বাবার ১২ তম সন্তান হলেও আমার বাবার কিন্তু তেমন বয়স হয়েছিল না ,মাত্র ৫৬ বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান ।
১২ বছর বয়সে বাবাকে হাড়িয়ে বুঝেছি বাবা কি জিনিস ।যদিও আমার ১১ ভাই বোন ,আমার মা আমাকে কোন অভাব বুঝতে দেন নি তবু সমবয়সী কোন মেয়েকে যখন দেখতাম বাবার কাছে কোন আবদার বা কোথাও বেড়াতে যেতে বা কে্উ তার বাবার কোন গল্প করত ভীষন কষ্ট পেতাম মনে নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ত পানি ।
যখন ইউনির্ভারসিটির হলে থাকতাম রুমমেটদের বাবারা তাদের দেখতে আসত কিযে ব্যাথা লাগত আমার বাবা কেন আসে না ।বাবা তোমার মেয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীটে পড়াশুনা করছে তুমি কেন আসছ না ।
আমার বাবা মৃত্যু শয্যায় আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল মারে আমি আমার ৮মেয়েকে ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছি আল্লাহর রহমতে তারা সবাই ভাল আছে তোর জন্য কিছু করতে পারলাম না আমি শুধু তুকে দুয়া করে যাচ্ছি তুই সুখী হবি ।
বাবার দোয়ার আল্লাহর রহমতে আমি অনেক সুখে আছি কিন্তু এর জন্য আমার ভাই বোনদের অনেক শ্রম দিতে হয়েছে ।আমার বোনের জামাইদের সাথে মিলে এমন ছেলে পাওয়া কঠিন হয়ে যায় কারন আমার বাবা নেই আমি আভিবাবক হীন এতগুলো ভাই বোনের ছোট জামাই আদর পাবে না ।এভাবেই অনেক বিয়ে আসলেও ফিরে যেত ।আমার বাবা বেঁচে থাকলে যে সব ঘর থেকে আমাদের সাথে সম্পর্ক করার কথা কল্পনায় ও চিন্তা করত না তারা নিয়ে আসত বিয়ের প্রস্তাব ।তখন বুঝেছি বাবা অশিক্ষীত হলে মাথার উপর অনেক বড় একটা বটবৃক্ষ।
যদিও আমার ভাই বোনেরা হাল ছেড়ে না দিয়ে খুজে বের করেন এক হৃদয়বান যুবককে যে অবিভাবহীন আমাকে বিয়ে করে নিজেই হয়েছেন আমার অবিভাবক তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর শিক্ষক । বর্তমানে উনি পি এইচ ডি করার জন্য জাপানে আছেন আমিও আছি উনার সাথে ।
আল্লাহর মেহের বানীতে অনেক সুখে থাকলেও বাবা না থাকার কষ্ট বাবার অভাব সারাক্ষন অনুভব করি ।বাবা মারা যাবার পর বাবা শব্দটা আমার মুখ দিয়ে বের হয় না ।আজও কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারি না ।বিয়ের পর শুশুরকে আব্বা ডাকতে না পেরে ডাকি মামা ।এখন আমার একটা ছেলে হয়েছে তাকে আদর করে মুখ দিয়ে কখনো বের হয়না ,বাবা, আব্বা ,আব্বু বাবা শব্দটা গলার কাছে আটকে যায় মনে হয় আল্লাহ তো আমার বাবাকে নিয়ে গিয়েছেন আমি কেন অন্য কাউকে বাবা ডাকব ।
বাবা তোমার জন্য কিছু করতে পারিনি কিন্তু সব সময় তোমার জন্য আল্লাহর কাছে বলি "রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি ছগিরা" ।
বিষয়: Contest_father
১৭৬৯ বার পঠিত, ৪৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সত্যিই বাবা নামটা শুধুই বাবার জন্য। আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাত নসীব করুন।
আল্লাহ পাক আপনার বাবাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
লেখাটা চমৎকার হয়েছে।
আপনার লিখাটা পড়ার সময় আমার আমার মাঝে একটা দারুণ অনুভূতি কাজ করেছে। ডেকে নিজের স্ত্রীকেও লিখাটা পড়িয়েছি। ১২ সন্তানের গর্বিত পিতার ১২ তম সন্তানকে স্বাগতম। আল্লাহর রাসুল তিন কন্যাকে বড় করে বিয়ে দিলে জান্নাতের দেয়ার প্রতিশুুতি দিয়েছেন। আপনার বাবা কত নাম্বার জান্নাত পাবে জানিনা। তবে সর্বোচ্চ পাবে এতে সংশয় নেই।
এতগুলো মেয়ে হওয়ার পরও একজন খেটে খাওয়া পিতার মানসিকতাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। বিস্মিত হই, মহান আল্লাহর উপর তার আস্থার জায়গাটি দেখে।
আমার মেয়ে হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি মেয়ে কি জিনিষ। দু্ত্তরি! মন্তব্য লিখতে গিয়ে যদি পোষ্ট থেকে বড় হয়, সবই আমারে 'হাগল' ক্ইব। ধন্যবাদ আপনাকে।
শেষ পর্যন্ত 'বাবার' উপর লিখা প্রতিযোগীতায় পুরস্কারটি নিয়ে গেলেন জেনে নিজে এ বিষয়ে লিখার আগ্রহ হারিয়ে প্রতি হিংসা নিয়ে বিদায় নিলাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন