"সম্ভবত ৯৯ শতাংশ লোকই জানেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু একই সঙ্গে যে গণভোটের বিধানও বাতিল করা হয়েছে সে সম্পর্কে ওই ৯৯ শতাংশ মানুষ সম্ভবত সচেতন নন।"
লিখেছেন লিখেছেন রঙ্গিন স্বপ্ন ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৬:৫৮:০৪ সন্ধ্যা
সুপ্রিমকোর্টের রায় এবং একটি প্রার্থনা শিরোনামে ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক এর একটি লেখা প্রকাশিত হয়।
এখানে দেশের বিরাজমান সমস্যা গুলো তিনি নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন। আর যেহেতু সমস্যা কী কী তা জানা গেল, সুতরাং সমাধান কী- তা বোধ হয় সবাই বুঝতে পারি।
তিনি লিখেছেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে বিরাজমান সমস্যার গোড়ায় যাওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সমস্যার গোড়া বলতে অনেকগুলো সম্ভাব্য পয়েন্ট আছে। যথা :
এক. বিগত বিএনপি সরকারের আমলের শেষাংশে প্রধান বিচারপতির অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানো।
দুই. ২৭-২৮ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে রাজপথে লগি-বৈঠার আক্রমণ।
তিন. অনেক পদক্ষেপ বাদ দিয়ে জনাব প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বের অতিরিক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করা।
চার. মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক আপসের মাধ্যমে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা।
পাঁচ. একটি ত্র“টিপূর্ণ প্রক্রিয়া অনুসরণের পর ২০১১ সালের ১০ মে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক দেয়া সংক্ষিপ্ত রায়ের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা।
ছয়. পঞ্চদশ সংশোধনীতে গণভোটের বিধান অবহেলা করা।
সাত. পঞ্চদশ সংশোধনীর সুবিধা নিয়ে আওয়ামী মেজরিটির সংসদ কর্তৃক গণভোটের বিধানকে অবহেলা ও অকার্যকর করা।
আট. পঞ্চদশ সংশোধনীর সুবিধা নিয়ে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে অতি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠন করা।
নয়. একটি বছর (২০১৪ সাল) সময় পাওয়া সত্ত্বেও সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ কর্তৃক কোনো আগ্রহী পদক্ষেপ গ্রহণ না করা। সমস্যার গোড়া বলতে আমরা নয়টি উদাহরণ উপস্থাপন করেছি।
এর দুটি নিয়ে এখন বলব।
পাঠক, মেহেরবানি করে কয়েকটি তারিখ খেয়াল করুন।
এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল অথবা বাতিল নয় প্রসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক সংক্ষিপ্ত রায় প্রদানের তারিখ ১০ মে ২০১১।
দুই. রায় প্রদানকারী মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক চাকরি থেকে অবসরে চলে যাওয়ার তারিখ ১৮ মে ২০১১।
তিন. সংক্ষিপ্ত রায়ের ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করার তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২।
চার. লিখিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষর করার সময় তারিখ দিয়েছিলেন ১৬ মাস আগের। অর্থাৎ ব্যাক ডেইটে স্বাক্ষর করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের তারিখ ৩ জুলাই ২০১১ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ১৪ মাস আগে।
এখন মেহেরবানি করে খেয়াল করুন, সংক্ষিপ্ত রায় প্রদানের অল্পদিন পরই তৎকালীন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল আনয়ন ও পাস করা হয়। পাস করার তারিখ ৩ জুলাই। ওই সময় মুখে মুখে, পত্র-পত্রিকায় এবং সংসদে হাজারবার বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের রায়ের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হচ্ছে। অথচ সরকারদলীয়রা ছাড়া দেশের বাকি সবাই বলছেন, সুপ্রিমকোর্টের সংক্ষিপ্ত রায়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে ছিল না। সংক্ষিপ্ত আদেশে মোট তিনটি বড়-ছোট অনুচ্ছেদ ছিল। সংক্ষিপ্ত রায়মতে, একটি মাত্র বাধ্যতামূলক সংশোধনী সাপেক্ষে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে, নিজেদের বিবেচনায় যথাযথভাবে সংশোধন করে, আগামী দুটি পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যাবে। সংশোধন করবে সংসদ। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ পুরো পদ্ধতিটি বাতিল করে দেয়।
আমার মতে মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মূলনীতির পক্ষে ছিলেন। নিচের উদ্ধৃতি পড়লেই বোঝা যাবে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার লিখিত রায়ের ১১৮৫ নম্বর অনুচ্ছেদে যা বলেন, তা হুবহু উদ্ধৃত করছি। ‘বিজ্ঞ এমিকাস কিউরিগণ সকলেই এই আদালতের সিনিয়র এডভোকেট। তাহাদের সুগভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা এবং দেশের প্রতি তাহাদের দায়িত্ব প্রশ্নাতীত। সংখ্যাগরিষ্ঠ এমিকাস কিউরিগণ কোনো না কোনো আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখিবার পক্ষে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের আশংকা নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাঁহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাঁহাদের আশংকা আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না।
১৯৯১ সালের গণভোট আইন দ্বারা বিধান করা হয়েছিল, সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৯, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২(ক) বা ১৪২ অনুচ্ছেদের সংশোধনের কোনো বিল বা আইন সংসদ পাস করার পরেও, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাক্ষরের আগে, প্রশ্নটি বা বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য গণভোটে দেয়া হবে। গণভোটের রায় ‘হ্যাঁ’সূচক হলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করবেন। গণভোটের রায় ‘না’সূচক হলে, রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বাক্ষর করবেন না।
অনুগ্রহপূর্বক খেয়াল করুন, সংবিধানের ৫৮নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করেই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রসঙ্গে এবং পদ্ধতিটি প্রবর্তন প্রসঙ্গে যে আইন পাস হয়েছিল, সেটি হয়েছিল সরকারি দল বিএনপি এবং বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ সমগ্র দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সম্মতিতে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক মতৈক্যের একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ ছিল এ আইনটি। গণভোট আইন-১৯৯১ মোতাবেক এই বিধান অর্থাৎ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮ পুরোপুরি বা অংশবিশেষ বাতিল করতে হলে অবশ্যই গণভোট প্রয়োজন ছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিবাদী অংশের, সম্ভবত ৯৯ শতাংশ লোকই জানেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু একই সঙ্গে যে গণভোটের বিধানও বাতিল করা হয়েছে সে সম্পর্কে ওই ৯৯ শতাংশ মানুষ সম্ভবত সচেতন নন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ২০১১ সালের মে-জুন-জুলাই মাসে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অথবা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি গণভোটে দেয়া হতো, তাহলে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যেত। জনগণের নামে কেউই এখন ২০১৩-১৪-১৫ সালে হ্যাঁ বা না, অর্থাৎ পক্ষে বা বিপক্ষে এই আন্দোলন করত না। এমনকি ২০১৫ সালেও বিষয়টি গণভোটে দেয়া যেত। গণভোটে দেয়া হলে যাদের জন্য আন্দোলন, যাদের নামে আন্দোলন বা যাদের নিরাপত্তার জন্য বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন বা যে জনগণের মঙ্গল কামনায় জনগণের ওপরই অত্যাচার চলছে, সেই জনগণই ফয়সালা করে দিতে পারত।
বর্তমান মহামান্য সুপ্রিমকোর্ট অথবা দেশের বর্তমান সম্মানিত আইনজীবী মহলের কোনো করণীয় আছে কি-না, এটি বিবেচনার জন্য বা এ প্রসঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসার জন্য আমি বিনীত প্রস্তাব রাখছি।
বিষয়: বিবিধ
১০১৪ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আত্মজিজ্ঞাসার বালাই আছে নাকি বিচারবিভাগের ???
মন্তব্য করতে লগইন করুন