ডাকাত সরদারনীর মহানুভবতা বনাম আইনের শাসন
লিখেছেন লিখেছেন মিনার রশীদ ১৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০৩:০৫:৫৫ দুপুর
এক গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাত হানা দেয় । গোয়েন্দা সূত্রের খবর ছিল উক্ত গৃহস্থ সেই দিন সন্ধায় গরু বিক্রি করেছে । কিন্তু সেই গরু বিক্রি হয় নি জেনে ডাকাতরা যারপরনাই রেগে যায়। ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করে , এই হারামজাদা, গরু বিক্রি করস নি কেন? গৃহস্থ জবাব দেয়, 'বাজারে গরুর দাম কম ছিল, তাই ' ।
এতে ডাকাতদল আরো খেপে গিয়ে গৃহস্থকে নির্মমভাবে পিটানো শুরু করে এবং বলে, ' ব্যাটা আহাম্মক ! টাকা কম হলে আমাদের হতো। তাতে তোর তো কোন ক্ষতি হতো না। '
সারা দেশটি এমন অসহনীয় ডাকাতদের কবলে পড়ে গেছে। ষোল কোটি মানুষের মধ্যে কয়েকজন ডাকাত আর বাদবাকি সবাই অসহায় গৃহস্থ। এই ডাকাতরা প্রশাসন, রাজনীিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জগত সহ সর্বত্র ছেয়ে গেছে।
দেশে কোন আইনের শাসন নেই। শামীম ওসমানরা হুংকার ছুড়েন, এই সরকার কোনদিন ক্ষমতা থেকে সরবে না। কাজেই দস্যুরাজা এবং দস্যু রাণীদের শাসন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। ডাকাত সরদার বা সরদারনীর ইচ্ছে বা মর্জির ওপর নির্ভর করে কখন কার ফাসি হবে, আবার কার ফাসি মওকুফ করা হবে। যুক্তি-তর্ক,আইন-কানুন,নীতি-নৈতিকতা এখানে সব বৃথা ও অর্থহীন হয়ে পড়েছে । সবচেয়ে কষ্টের কথা হলো, নিজেদের এই ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠার জন্যে দাড় করানো হয়েছে আমাদের গৌরব ও গর্বের মুক্তিযুদ্ধকে।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী জনাব আবুবকর সিদ্দিক অপহরনের ৩৫ ঘন্টা পর উদ্ধার পেয়েছেন। কিন্তু অপহরনের দুই বছর পরেও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলীর কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই ডাকাত সর্দার বা সর্দারনীর মর্জির উপর নির্ভর করে কাকে গুম করা হবে, আবার তারই মহানুভবতার উপর নির্ভর করে অপহরনের পরে কাকে ছেড়ে দেয়া হবে। দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের এই অাস্থাটি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে পড়েছে।
দেখা গেছে সরকার প্রথম প্যাচে জড়ায় নিজেদের কোন দুর্বলতা বা অজ্ঞতার কারনে। কখনও কখনও এটা আসে ঐশ্বরিক শাস্তি হিসাবে। তারপরেই সেটাকে ঢাকতে গিয়ে অন্য আরেকটি অঘটন ঘটায়। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আইএসআইয়ের চরকে 'র' তুলে নিয়ে যায়। ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতি হুমকি বলে গণ্য হলে দেশের যে কোন মানুষকে মুখ ঢেকে এভাবে তুলে নিলে কারো কিছু করার থাকবে না। এটা নিয়ে সরকারের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়। আমরা এখনও স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে বহাল অাছি কি না তা নিয়েও প্রশ্ন সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া কয়েকদিনের মধ্যেই সাঈদীর আপিল মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। অনেকেরই ধারনা এই মুহুর্তে আরো দুয়েকটি ইস্যু দরকার। এই উদ্দেশ্যেই নতুন এই স্পর্শকাতর ইস্যুটি তৈরির চেষ্টা করা হয়ে থাকতে পারে । কিন্তু হজম করা কঠিন হয়ে পড়ায় বিকল্প পথে যাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে একজন নারীর সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করে তাকে ডাকাত সরদারদের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করা হয়েছে।
যে সরকারের দায়িত্ব দেশের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করা সেই সরকারই দেশের মানুষকে নিয়ে এই নিষ্ঠুর খেলা শুরু করেছে। কাজেই এদেরকে শাসক না বলে ডাকাত দলের সর্দার বা সর্দারনী বলাই শ্রেয়।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। কখনই কোন রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন নি। তিনি পরিবেশ রক্ষায় যে সংগ্রামে নেমেছিলেন তা ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে।
রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক হোক - মূল কথাটি হলো এদেশে কোন উচ্চ কন্ঠ বরদাশত করা হবে না। এদেশের সাংবাদিকতায় মাহমুদুর রহমান যেমন এক সিংহের বাচ্চা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছেন তেমনি পরিবেশ রক্ষায় সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কাছাকাছি একটি ভূমিকায় চলে এসেছিলেন । বিভিন্ন ক্যাটাগরির পলিউটার ও ভূমিদস্যুদের কাছে রীতিমত আতংক হয়ে আবির্ভুত হয়েছিলেন তিনি ।
এই কঠিন সময়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের প্রতি জনগণের সহানুভূতি কমানোর জন্যে বিশেষ চেতনার বলয় থেকে প্রচার করা হয়েছে যে তিনি রাজাকারের মেয়ে। কাজেই মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে সিংহের বাচ্চা ( ছেলে বা মেয়ে ) সম্ভবত রাজাকাররাই বেশি পয়দা দিতে পারে।
রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত বেলার নির্বাহী প্রধানের স্বামী অপহৃত হওয়ার পর টিআইবির সুলতানা কামাল,ইফতেখারুজ্জামান এবং গান্ধিবাদী কলামিষ্ট হিসাবে পরিচিত সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমুখ মানবতাবাদী ব্যক্তিগণ সোচ্চার হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষমতার মদে মত্ত এই সরকার বেহুশ হয়ে থাকলেও সরকারের এই সুহৃদদের হুশটি ঠিক সময়ে উদয় হওয়াতে এক বড় অঘটন থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।
এই স্বস্তির সাথে সাথে একটা অস্বস্তিও ভাবনার জগতটিতে হানা দিচ্ছে। কারন এদেশের সবার স্ত্রী বেলার প্রধান নির্বাহীর মত গুরুত্বপূর্ণ নন। সবার জন্যে এই জমানায় সুলতানা কামাল ও আবুল মকসুদরা এগিয়ে আসবেন না।
এই সুলতানা কামালরা যদি প্রতিটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এমন করে সোচ্চার হতেন বা এমন পেরেশান হতেন তাহলে এই দেশটি মগের রাজ্যে পরিণত হতে পারতো না । মনিবের কন্ঠ দেখেই কাজের মেয়ে বুঝতে পারে কোন মেহমানকে চা-নাস্তা দিতে হবে আর কাকে শুধু শুধু লিপ-সার্ভিস দিয়েই বিদায় করতে হবে। কাজেই ডাকাতদের সর্দার বা সর্দারনী এবং তাদের মানবতাবাদী এই সব কাজিনদের জন্যেই এদেশে মানবতা ও আইনের শাসনের আজ এই করুণ অবস্থা।
আবারো প্রমাণিত হয়েছে যে উপর মহলের ইচ্ছে থাকলে সবকিছু সম্ভব। ' ইনারা' ঠিকভাবে ইচ্ছে করলেই ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই সবকিছু বের করে ফেলতে পারেন । কাজেই সাগর-রুনির কেইসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন তা অহেতুক ছিল না । সেখানে ঘাটতি ছিল এবং এখনও অাছে শুধু 'প্রণিধানযোগ্য' এই ইচ্ছেটির।
ম্যাগাসেসে পুরস্কার প্রাপ্ত বেলার প্রধান নির্বাহীর স্বামীর বেলায় আমাদের মানবতাবোধ ও প্রশাসন যেভাবে তৎপর হয়েছে তা দেশের যে কোন নাগরিকের বেলায় হলে দেশের পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে পড়তো । আমরা ভুলে যাই যে সবার রক্তই একই রকম লাল। সবার জন্যেই প্রিয়জন এমন উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। প্রিয়জনের জন্যে অপেক্ষার সেই প্রহরগুলি সবার জন্যেই একইরূপ নির্মম, দু:সহ ও যাতনাময় ।
আশা করব, এতকিছুর পরেও রিজওয়ানা তার এই সংগ্রামটি অব্যাহত রাখবেন। মিডিয়া কর্মীদের প্রতি অনুরোধ , দলমত নির্বিশেষে আপনারা এই ধরনের
কিছু বলিষ্ঠ কন্ঠকে যে কোন কিছুর বিনিময়ে রক্ষা করুন । মাহমুদুর রহমানের পেছনে দাড়াতে পারলে এই সরকার আজ যাচ্ছে তাই করতে পারতো না। কাজেই অবশিষ্ট বলিষ্ঠ কন্ঠগুলোকে সাহস জোগানো দরকার। স্বামীকে উদ্ধারের পর সৈয়দা রিজওয়ানা বলেছেন, এই অপহরনের ঘটনাটিই হোক শেষ অপহরন। আসুন সবাই তাঁর এই প্রত্যয়দীপ্ত ঘোষণাকে বাস্তবে রূপদানের চেষ্টা করি। তা নাহলে এক ভয়ংকর অন্ধকার আমাদেরকে দ্রুত গ্রাস করবে। তা থেকে আমরা কেউ রক্ষা পাবো না। উত্তর কোরিয়ার নেতার আপন ফুপা এবং নিজের সেকেন্ড ইন কম্যান্ডকে জীবন্ত অবস্থায় কুকুর দিয়ে ভক্ষণ করানো হয়েছে। বিভিন্ন আলামত দেখে মনে হচ্ছে আমরা সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছি।
আমাদের সার্বিক নীরবতায় সেই ধরনের এক ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি হচ্ছে। বিরোধী
কিছু কন্ঠ স্তব্দ করে দিতে পারলে নিজেদের তৈরি ফ্রাংকেনস্টাইনের হাত থেকে এর স্রষ্টারাও একদিন নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন না। বিবেকের দংশনে যারাই মুখ খুলবেন তারাই আক্রমনের শিকার হবেন। এবিএম মুসা সম্ভবত তার সর্বশেষ প্রমাণ।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৬ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দেশ আসলেই প্রকৃত অর্থেই মারাত্মক একদল ডাকাতের কপ্পরে পড়েছে। এদের হাতে কিছুই নিরাপদ নেই।
থাম্বস আপ
মন্তব্য করতে লগইন করুন