বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দস্যুপনার তেতাল্লিশ বছর
লিখেছেন লিখেছেন মিনার রশীদ ০৩ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:০২:১০ সকাল
উত্তর কোরিয়ার নেতা তার দেশের সকল পুরুষকে তার মত করে চুল ছাটতে নির্দেশ দিয়েছেন । নিঃসন্দেহে এর পেছনে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির অনেক চমৎকার চমৎকার যুক্তি রয়েছে। এই লাইন ধরে বাংলাদেশেও একদিন বিশেষ কালো কোট পরা বাধ্যতামূলক হয়ে যেতে পারে। আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম উত্তর কোরিয়ার মতো রেজিমেন্টাল বা পেঙ্গুইন প্রজন্ম হিসাবে আবির্ভুত হতে পারে, যাদের কোন মগজ বা স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার কোন ক্ষমতা থাকবে না।
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে এক প্রফেসর ইতিমধ্যেই নতুন মন্ত্র হাজির করেছেন । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম দিয়ে ফ্যাসিবাদের এক নতুন তত্ত্ব জাতির ইমোশনে ব্ল্যান্ড করার চেষ্টা করছেন। যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হলেও চেতনার অন্যতম এই খলিফা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। অনেকদিন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে এসেছেন। সেখানকার মুক্ত হাওয়া বাইরে লাগলেও ভেতরটায় তার কোন ছোঁয়া লাগেনি।
এরা যা করছে তা স্রেফ বুদ্ধিবৃত্তিক দস্যুপনা বা লাঠিয়ালপনা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্বৃতিক চর্চার নামে গত তেতাল্লিশ বছর ধরে এই দস্যুপনা অব্যাহত রয়েছে। তন্মধ্যে গুরু হিসাবে আছেন লন্ডন প্রবাসী এক কলামিস্ট। এন্টি-জেহাদি এবং এন্টি-মৌলবাদী এই কলামিস্ট পহেলা এপ্রিলের কলামটি শুরু করেছেন কোরআনের একটি আয়াত উদ্ধৃত করে। জানিনা এটাও এক ধরনের 'এপ্রিল ফুল' কি না। সেই কলামের প্রথম প্যারাটি
পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে তুলে ধরা হলো।
" পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, 'মূর্খের সঙ্গে তর্ক করিও না।' ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ও জিয়াউর রহমানও নিহত হওয়ার পর যখন তাঁর হাতে গড়া দল বিএনপি ক্ষমতায় বসে শুধু স্বাধীনতাযুদ্ধের আদর্শ মুছে ফেলা নয়, স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা শুরু করে, তখন এক পরিচিত আলেমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মূর্খ যদি অত্যাচারী শাসক হয় ও ক্ষমতায় বসে অনবরত মিথ্যাচার করে, তাহলেও কি তার প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকতে হবে? আলেম সাহেব জবাব দিয়েছিলেন, এ সম্পর্কে পবিত্র হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশ 'অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলাই সর্বোত্তম জেহাদ'।
উদ্ধৃত এই আয়াতটির সুরা ও আয়াত নম্বর তিনি উল্লেখ করেন নি যা এই ধরনের উদ্ধৃতির জন্যে বাধ্যতামূলক । কোরআনে এই ধরনের শব্দ ও ভাব নিয়ে বাক্যটি আছে কি না তাও গবেষণার বিষয়।
মূর্খের সাথে তর্ক করবেন না বললেও প্রথমে তিনি নিজেই একটি মূর্খের (কোরআনের দৃষ্টিতে) মত কাজ করে বসেছেন । জ্ঞানের পিতা বলে পরিচিত আবুল হাকাম এই কোরআন নাজেলের পর হয়ে পড়েন আবু জেহেল বা মূর্খের পিতা। জানি না এই কথাটি তার নলেজে সম্যকভাবে আছে কি না।
নিজের অজান্তেই তিনি একটা প্রয়োজনীয় হাদিস প্রচার করেছেন।
এই হাদিসটি পড়ে দেশের মানুষ এই চরম স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা পাবে। এখন দেশের শতভাগ মানুষ বুঝতে পারবে যে এই হাদিসটি জামায়াত শিবিরের বানানো হাদিস নয়।
কাজেই গরম কালের(বিএনপি জমানার ) ওয়াজ তিনি শীতকালে (আওয়ামী জমানায় ) করে ফেলেছেন। দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রতিক বিতর্কে সরকারের প্রতি তিনি পরামর্শ রেখেছেন,
" বর্তমান সরকারের উচিত রাষ্ট্রের স্বার্থেই এর বিরুদ্ধে সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দেশের সচেতন মানুষেরও উচিত সাবেক অত্যাচারী শাসকদের এই মিথ্যার জোর ও সম্মিলিত প্রতিবাদ করা; যা অবশ্যই জেহাদের সমতুল্য। "
হাদিসটিতে অত্যাচারী শাসকের কথা বললেও এন্টি জেহাদি এই কলামিস্ট তা ব্যবহার করলেন 'সাবেক' অত্যাচারী শাসকদের প্রতি ! মানুষের বাক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সরকারকে তিনি সাংবিধানিক এবং আইনি ব্যবস্থা গ্রহনের জোর পরামর্শ দিয়েছেন এবং জনগণকে এর (প্রথম প্রেসিডেন্ট দাবির ) বিরুদ্ধে জেহাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
বরাবরের মতই অনেকগুলি প্যারা তিনি খরচ করেছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গালিগালাজ করে । এই সব
গালি গালাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের মত করে কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
"কত বড় মূর্খ হলে এক ব্যক্তি বলতে পারে, '৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিবস হলে ৮ মার্চ মুজিবনগর সরকার গঠিত হলো না কেন? ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো কেন? ৭ মার্চের পরও শেখ মুজিব পাকিস্তানিদের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করেন কী করে?' এটা অজ্ঞানতাপ্রসূত প্রশ্ন নয়; উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য বিকৃতি। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিয়েই ৮ মার্চ সরকার গঠিত হয় কী করে? আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরদিনই কি জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছিল? ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরদিন ২৪ মার্চ কি পাকিস্তান সরকার গঠিত হয়েছিল? তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল সাত বছর। "
অথচ স্কুলের বাচ্চারাও জানে যে পাকিস্তানের স্বাধীনতা এসেছিল আলাপ আলোচনার মাধ্যমে, আমাদের মত কোন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নয়। ১৯৪০ সালের তেইশে মার্চ স্বাধীনতার কোন ঘোষণা আসে নি । ২৩শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস বলা হয় নি। এটা ছিল প্রজাতন্ত্র দিবস। এই দুটি ঘটনার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য যারা বুঝতে পারে না গত অর্ধ শতাব্দী জাতি টিকে রয়েছে এদের জ্ঞান ধার করে !
আর আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। আমাদের মতো সিঙ্গেল ইউনিট ছিল না, তেরটি আমেরিকান কলোনিতে বিভক্ত সবগুলি ইউনিট স্বাধীনতার জন্যে একইভাবে আকাঙ্খা পোষণ করে নাই। সেখানকার মূল নেতা জর্জ ওয়াশিংটন তখনকার কলোনিয়াল সরকারের কাছে গ্রেফতার বরন করেন নি।
দুটিই তলা হলেও আগরতলা আর চৌকিরতলা এক নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক এই লাঠিয়ালগণ সকল তলাকেই এক বানিয়ে ফেলতে চায়।
গায়ের জোরে বিয়ে করা যায়,আবেগের জোরে প্রেম করা যায় কিন্তু এই দুটির জোরে কখনই ইতিহাস রচনা করা যায় না।
আরেকটি কথা প্রায়ই বলা হয়। শেখ মুজিবের নির্দেশে তদানীন্তন মেজর জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু কখন এবং কিভাবে শেখ মুজিব তদানীন্তন মেজর জিয়াকে এই নির্দেশটি দিয়েছিলেন ?
বুদ্ধিবৃত্তিক দস্যুপনার মাধ্যমে এই ধরনের প্রশ্ন করা থেকে মানুষকে আর বিরত রাখা যাবে না। মানুষের পিঠ আসলেই দেয়ালে ঠেকে গেছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক এই দস্যুপনাকে জব্দ করতেই মানুষ আগে যেসব প্রশ্ন করতো না, তা এখন করতে শুরু করেছে। এসব প্রশ্ন আর পাল্টা প্রশ্নের পরই প্রকৃত ইতিহাস বের হয়ে আসবে।
নতুন সৃষ্টির সেই প্রসব বেদনাই যেন শুরু হয়ে গেছে।
বিষয়: বিবিধ
১২৬২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই অল্প কয়েকটি কথাতেই বিখ্যাত অধ্যাপক আর কলামিষ্ট এর বিশাল লেখার ফাকিবাজি সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে অধ্যাপক সাহেব তো এক লেখায় গনতন্ত্রের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাকি গুরুত্বপুর্ন দাবি করেছেন। তাহলে কি মনে করব মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতে গনতন্ত্র ছিলনা।
শুরু হয়েছে আমি একমত। আযান দেয়া হল। এখন ইমাম প্রয়োজন। সেই ইমাম কি আপনি মনে করেন প্রস্তুত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন