সময় মতো পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার জন্যে হে ভুট্টো, তোমাকে প্রণাম !
লিখেছেন লিখেছেন মিনার রশীদ ২৬ মার্চ, ২০১৪, ০৬:৩৭:২২ সন্ধ্যা
প্রচন্ড শীতের সকালে এক ছোট্ট ছেলেকে পানি থেকে উদ্ধার করে এক মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। এজন্যে সকলেই তার সাহস ও মহানুভবতার প্রশংসা করে।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয় অন্য সবাই যখন তীরে দাঁড়িয়ে ছেলেটির জন্যে শুধু আহাজারি করছিল, তখন উনি সবার আগে এভাবে নেমে পড়েছিলেন কেন ? '
লোকটি জবাব দেয়,"
ইচ্ছে করে নামি নি। পেছন থেকে কেউ ধাক্কা মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। "
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে সামান্য একটু গবেষণা করলে এই গল্পটির সাথে কোথাও যেন একটু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইয়াহিয়াকে সামনে রেখে ভুট্টো তখন পেছন থেকে ধাক্কা না দিলে আমরা আদৌ স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতাম কী না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
গোজামিল দিয়ে আমরা ইতিহাসের অনেক হিসাব কষে রেখেছি বলেই আমাদের আজকের এই দুরাবস্থা। বাইরের আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে আমাদের এই বোকামি ও দুর্বলতার খবর পৌছে গেছে। তাই স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও আমাদেরকে নিয়ে ওরা এমন কায়দায় ফুটবল খেলছে।
কারন ৭ই মার্চে 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ' বলে ঘোষণা দেয়া হলেও ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সংগ্রামটি অব্যাহত রাখেন। ইয়াহিয়া ভুট্টোর সাথে গোলটেবিল বৈঠকটি চলতে থাকে । এই অবস্থায় আমাদের ইতিহাসের মহানায়কের অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে যখন তিনি ইয়াহিয়া খাঁনকে মনের কথাটি বলে ফেলেন , "আমি যদি আপনার কথা শুনি তবে ছাত্র নেতারা আমাকে মেরে ফেলবে। আবার যদি ছাত্র নেতাদের কথা শুনি তবে আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন।"
তাছাড়া ১৯৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আমরা কখনই স্বাধীনতা চাই নি। স্বায়ত্বশাসন চেয়েছিলাম। গণতন্ত্র চেয়েছিলাম। স্বাধীনতার ঘোষণার চেয়ে দাবি আদায়ের হুমকি হিসাবেই এই ভাষণটিকে প্রাথমিকভাবে সেট করা হয়েছিল । প্রাথমিক টার্গেট পূরণ না হওয়ায় পরবর্তিতে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যে এটিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এজন্যে কিছু যোজন-বিয়োজন করতে হয়েছে।
কাজেই ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা ছিল না। যতটুকু ছিল তাও অস্পষ্ট হয়ে পড়ে এই সব বৈঠকের ফলে।
এই ভাষণটি দেয়ার পর আবারো
দীর্ঘ সময় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির সাথে বৈঠকের ফলে জনগণ আরো বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।
তাজউদ্দীন আহমেদ সহ কয়েকজন তখনই বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন।
তারা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা রেকর্ড করে রাখতে চেয়েছিলেন । যা পরে দরকার মতো ব্যবহার করা যেতো। বঙ্গবন্ধু দেশদ্রোহী (পাকিস্তানদ্রোহী) হিসাবে গণ্য হতে চান নি। তাজউদ্দীনের অনেক চাপাচাপির পরেও সেই ঘোষণাটি রেকর্ড করে যান নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির আর নেই যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রােমর মূল সিপাহসালার স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণাটি দিতে এমন করে দ্বিধান্বিত ছিলেন।
খাওয়ার আগে যে অষুধের শিশিটি ঝাকানো হয় নি, খাওয়ার পর পুরো শরীরটি ঝাকাতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের এই গ্যাপটি পূরণের জন্যে জনৈক ইপিআরের অয়ারল্যাস অপারেটরকে হাজির করানো হয়েছে । যিনি একটি তারবার্তার মাধ্যমে ঘোষণাটি চিটাগাং এ পৌছে দিয়েছিলেন। প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের বাঁশ সরবরাহকারী বা পতাকা বানানোর দর্জিও নিজেদের ক্রেডিট নিতে এগিয়ে
এসেছেন । অথচ এরকম একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অাঞ্জাম দেওয়ার পরেও এখনও 'জনৈক' সেই ইপিআর সদস্য নিজে কিংবা তার কোন আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কেউ সম্মুখে এলেন না , তা অবাক হওয়ার মত ব্যাপার বৈিক।
তিনি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারনেই সংযুক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন । তাছাড়া আজ যেভাবে দেশটিকে অন্য একটি দেশের vassal state বানিয়ে ফেলা হয়েছে, আমার মনে হয় সেই বিষয়টি এই নেতা তাঁর অন্তদৃষ্টি দিয়ে তখনই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কারন তিনি নিজেও এই পাকিস্তানের জন্ম প্রক্রিয়ায় একজন তরুণ ছাত্র নেতা হিসাবে অংশগ্রহন করেছিলেন।
কাজেই বিশের কোঠায় টগবগে রক্তের সেই সব ছাত্র নেতাদের চাপাচাপির পরেও ইন্ডিয়ার সহায়তায় স্বাধীনতাটি পেতে তাঁর মনটি হয়তো সায় দিতে চাচ্ছিল না। তিনি জানতেন এই ঋণটি শোধ করা কত কঠিন হতে পারে।
পাঠক, এখানে আমি নতুন কোন ইতিহাস বর্ণনা করছি না । ষোল কোটি মানুষের নিরাপত্তার জন্যে এই এঙ্গেল থেকে বিষয়টি দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে ।
৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের ব্যাখ্যা এভাবে টানলে সবকিছুই খুবই সহজ হয়ে পড়তো।
এভাবে ভাবলে শেখ মুজিব তাঁর জায়গা থেকে নিচে নামাতেন না। এতে তিনি আরো উপরে ওঠে যেতেন । সব সময় নগদ প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী আওয়ামীলীগের পক্ষে এই ধরনের ভাবনা আসলেই কঠিন।
সিঙ্গেল ইউনিটের চমৎকার এই দেশকে দুভাগ করার যে সর্বনাশা আয়োজন আজ সম্পন্ন হয়েছে জাতির ভাবনাটি এ বিন্দুতে থাকলে তা হয়তোবা আর সম্ভব হতো না। বিশেষ চেতনাধারীরা আমাদেরকে এই সব বিষয়ে এমন ত্রস্ত ও সন্ত্রস্ত করে রেখেছে যে দুই মিনিট বসে মুক্তভাবে একটু ভাবার অবকাশটি কোনদিন আমরা পাই নি।
তখনকার সেই 'ছাত্র নেতা' দের কয়েক জনের প্রজ্ঞার বহর আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। দেশ ও দেশের গণতন্ত্রকে এখন যে কয়জন গলাচিপে ধরেছেন তার মধ্যে 'সেই গ্ল্যামারাস ছাত্র নেতারা' ও রয়েছেন । স্বৈরাচারী এরশাদের দোসর কাজী ফিরোজ রশীদ আর বঙ্গবন্ধুর সহচররা আজ একই স্বরে, একই ভঙ্গিতে, একই কায়দায় জনগণকে ভয় দেখান । কে যে নেতা, আর কে যে পলিটিকেল থাগ তা নির্ণয় করা সত্যিই দুরূহ হয়ে পড়েছে।
চিন্তা করুন, সত্তর বছর বয়সে এসে যারা গনতন্ত্র কী জিনিস তাই ঠিকমতো বুঝতে পারেন না , এই সব ব্যক্তিবর্গের উপর পঁচিশ ছাব্বিশ বছর বয়সে দায়িত্ব পড়েছিল একটা জাতির ভবিষ্যত গতিপথ ঠিক করার ! এর সিকোয়েন্সিয়াল কনসিকোয়েন্সে আমরা এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতার সম্মুখীন ।
ষোল কোটি মানুষের নিরাপত্তার জন্যে এই ভাবনাগুলি আমাদের ভাবতে হবে। একটু গভীর ভাবে তাকাতে হবে ইতিহাসের ঐ সব বাক গুলোর দিকে। মেজর জলীল অনেক আগেই এগুলি উচ্চারন করে গেছেন। তিনি বলেছেন, অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা। এসব উচ্চারনের জন্যে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার হয়েও তিনি রাজাকার হয়ে পড়েছিলেন। আজ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে মেজর জলীলের মতো কিছু রাজাকারের বড্ড প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ।
অাজ অর্বাচিনের মত প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটিকে উপহাস করা হচ্ছে। অথচ সেই সময়ের বাস্তবতাটুকু একবারও ভেবে দেখি না।
'যার হাতে যা কিছু আছে' তা দিয়ে কিছ ছোটখাটো রাজনৈতিক দাবি অাদায় করা সম্ভব । তা দিয়ে কখনই একটা সশস্ত্র যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। ফলে সার্বিক সামরিক প্রস্তুতি ও তদ্রুপ কোন পরিকল্পনা ছাড়াই একটা মারাত্মক যুদ্ধের দিকে জাতিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল । পানিতে ঝাপ দেয়ার পর মনে হয়েছে যে লাইফ জ্যাকেটটি ঠিকভাবে পরা হয় নি।
এমতাবস্থায় জনগণের মধ্য থেকেই স্বতঃস্ফুর্ত নতুন নেতৃত্বের সৃষ্টি হয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম থেকে একটি কন্ঠ ভেসে অাসে, 'অামি মেজর জিয়া বলছি। ' আমাদের পুরো স্বাধীনতা সংগ্রামটিকে যদি একটা রিলে রেইসের সাথে তুলনা করা হয় তবে কিছু সময়ের জন্যে হলেও সেই কাঠিটি এই তরুণ মেজরের হাতে ছিল। তা না হলে ঐ মুহুর্তে এই রিলে রেইসের কাঠিটি হারিয়ে যাওয়ার সমূহ আশংকা সৃষ্টি হয়েছিল।
পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী অত্যন্ত চতুরভাবে মূল নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছিল। আগে বর্ণিত স্টেইটম্যানসুলভ কোন ভাবনা থেকে হোক কিংবা অন্য কোন দুর্বলতা বা কৌশলের কারনেই হোক সত্য কথাটি হলো তিনি গ্রেফতারবরন করেছিলেন । অপরাপর সকল চাচারা নিজ নিজ প্রাণ বাঁচাতে তল্পি তল্পা সহ বর্ডারমুখী হয়ে পড়েছিলেন। এই সুযোগে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বা কনটেইন করতে পারলে জন মত ঘুরে যেতে সময় লাগতো না।
পাক সামরিক জান্তার সমস্ত পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা অংশের বিদ্রোহ করার কারনে। কারন এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে ফেলে এবং সাথে সাথে এদেশবাসীর মনোবল চাঙা করে ফেলে। পল্টনী হুমকির ভাবধারা থেকে সত্যিকারের যুদ্ধ করার মনোবলটি জাতি পেয়ে যায়।
কাজেই ঐ মুহুর্তে এই কঠিন ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন সেদিনের ঐ তরুণ মেজর। কাজেই এটা শুধুমাত্র একটা ঘোষণা ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে এই ঘোষণা দেয়ার জন্যে তাঁকে আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয় নি বা এরকম কোন বোঝাপড়াও ছিল না । বরং রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ব্যর্থতাকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে কভার দিয়েছিল স্বতঃসফুর্তভাবে দাঁড়িয়ে পড়া আমাদের এই সামরিক নেতৃত্ব। স্বাধীনতা সংগ্রামটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে সংঘটিত হলেও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া আলাদাভাবে স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন।
জিয়ার প্রতি এদের ক্ষোভের কারন হলো যেখানেই তাদের ব্যর্থতা সেখানেই জিয়ার সফলতা স্পষ্ট হয়ে পড়েছে।
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৪ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"যাকে না দেখতে পারি তার চলন বাঁকা"৷
অ কৃতজ্ঞের দল৷ তাদের কাছে চাওয়ার কিছু নেই৷ ধন্যবাদ৷
আওয়ামী লীগাররা এ প্রশ্নের কোন যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দিতে পারে না ।
যারা কিছু করেনি তারাই হয়ে বসেছে সবকিছুর স্রষ্টা! ওরা সবাই সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল নিজেকে রক্ষার জন্য। কিন্তু হঠাৎ করেই ওদের কোন বাস্তব ভূমিকা ছাড়াই এদেশ হয়ে গেল স্বাধীন। নিজের অযোগ্যতা লুকানোর জন্য ওরা নানা রকম রূপকথার গল্প চালু করে দিয়েছে। এমন অবস্থা তৈরি করেছে ওসব গল্পের বিরোধীতা করলেই হয়ে যায় রাজাকার!
বি. দ্র: চেয়ে ছিলাম প্রাসংগিক একটি মন্তব্য করবো। কিন্তু সময় সল্পতার কারণে সেদিকে যাওয়ার সুযোগ হলো না। তাই পাঠকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী ও দু:খিত।
আপনি তো লিখছেন। ইতিহাসের দ্বায় থেকে আপনি মুক্ত। কিন্তু গত ২১ টি বছর এই শহীদ জিয়ার নামে ব্যবাসা করা দলটি ক্ষমতায় ছিল। কই - শহীদ জিয়াকে সেভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে?
যে গ্যাপ তৈরী করেছে বাকশালীরা তা কিভাবে পূরণ হবে।
আশা করছি আপনি - মাহমুদুর রহমানরা এগিয়ে আসবেন। আল্লাহ তৌফিক দেন। দোয়া করি। আমরা আপনার সাথে আছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন