আল হিজাবঃ পার্ট-১ (আরবী ছোটগল্পের অনুবাদ)

লিখেছেন লিখেছেন নাহিদ নোমান ১১ এপ্রিল, ২০১৫, ১২:০৬:৪২ রাত



আরবী ছোট গল্পের কালজয়ী লেখক ”মুস্তফা লুৎফী আল-মানফালূতী” এর গল্প-সমগ্র ‘আল-আ’বারত’ থেকে আল-হিজাব গল্পটি অনুদিত


এক

আমার এক বন্ধু যখন ইউরোপে গেল, তখন তার কিছু আমাদের অজানা ছিল না। সেখানে সে কয়েক বছর অবস্থান করল। সে যখন ফিরে এল, তখন সেখানে যাওয়ার পূর্বে তার মধ্যে যে গুণাবলী বিদ্যমান ছিল, তার কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। অতঃপর সে হয়ে গেল আমাদের কাছে কোন এব অচেনা মানুষ।

বাসর রাতে কুমারীর যেমন নিষ্কলুষ চেহারা নিয়ে সে (ইউরোপে) গিয়েছিল। আর বর্ষণমুখর রাত্রিতে নিরাবরণ ও অমসৃণ পাথরের চেহারা নিয়ে ফিরে এলো। ক্ষমা, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ ও কৃত অপরাধের জন্য বিনীত কারন প্রদর্শনে অভ্যস্ত একটি পরিচ্ছন্ন-পবিত্র মন নিয়ে সে গিয়েছিল সেখানে। আর এমন কৃটিল হৃদয় নিয়ে ফিরে এল, যাতে রয়েছে পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের প্রতি অন্তহীন ক্রোধ। এমনকি আকাশ ও এর স্রষ্টার প্রতি সমভাবে প্রতিশোধস্পৃহায় আচ্ছন্ন তার হৃদয়। প্রবাসে যাওয়ার সময় তার অন্তর এতই বিনয়ী ও নিরহংকার ছিল যে, সে সকলকে নিজের চেয়েও মহীয়ান মনে করত। অথচ যখন ফিরে এল, তখন এমন আগ্রাসী ও অহংকারী মন নিয়ে ফিরে এলো, যে মন দিয়ে সে সকলকে তার চেয়ে নীচ-হীন ভাবতে লাগল। সে তার দৃষ্টিকে কোন ক্রমে বিনয়াবনত করতে পারছিল না। সে বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষনতা নিয়ে গিয়েছিল, অথচ ফিরে এল নির্বোধ মূর্তির ন্যায় ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে, যে মস্তিষ্কের ভিতর দিয়ে অনায়াসে বাতাসের আনাগোনা ঘটে।

আমি দেখেছি এসব দুর্বল চিত্তের যুবকদেরকে, যারা এ ধরনের অভিনব রূপ নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে এবং যাদের দেহে (পাশ্চাত্যের জীবন হতে) কৃত্রিম রং ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাদের জীবনাকাশে যখন স্বদেশের সূর্য উদিত হয় এবং তাদের দেহে যখন অপতিত হয় সূর্য রশ্মি, তখন ঐ কৃত্রিম রং বাস্পীভূত হয়ে আকাশে মিলিয়ে যায় (অর্থাৎ তারা স্বদেশী সংস্কৃতি ও জীবন বোধের সঙ্গে পুনরায় একাত্ম হয়)। প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্য সভ্যতা তাদের হৃদয়ে ক্ষণিকের জন্য স্থান করে নেয় এমনভাবে, যার উদাহরণ দর্পণে মুখ দর্শনরত কোন এক ব্যক্তির ন্যায়, যে ব্যক্তি তার মুখ সরিয়ে নিলেই তার প্রতিবিম্ব অদৃশ্য হয়ে যায়। আমার বন্ধুটি ইউরোপ থেকে ফিরে আসা এরকম এক যুবক। বন্ধুত্বের পুরানো অঙ্গীকার রক্ষার জন তাকে আমি বর্জন করতে পারছিলাম না। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় তার উচ্ছৃংখল ভাবনা, নির্বুদ্ধিতা, কুমন্ত্রনা ও বিস্ময়কর পরিবর্তনশীলতা আমার অসহ্য হলেও তা মেনে নিয়েই চলছি।

কিছুকাল পর কোন এক রাত্রিতে একটা ভয়কর বিপদ ও কঠিন মুহূর্ত আসল। আর ঐ মুহূর্তটির পরিপ্রেক্ষিতে সূচিত হল তার সাতে আমার বন্ধুত্বের সমাপ্তিলগ্ন।

সে রাতে আমি তার কাছে গেলাম। তাকে দেখলাম- মনে বিষণ্ণতাপূর্ণ ভগ্ন হৃদয়ে চিন্তামগ্ন। আমি তাকে অভিবাদন জ্ঞাপন করলে সে ইশারায় প্রত্যুত্তর করল। কি হয়েছে জানতে চাইলে বলল, রাত অবধি আমি মহিলাটির ব্যাপারে কষ্টে আছি এবং এ কষ্ট থেকে পরিত্রানের উপায় জানি না। এতে আমার পরিণতি কি? তাও জানি না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম- কোন্ মহিলার কথা বলছ? প্রতিত্তোরে বলল- ঐ যে, যাকে মানুষ আমার স্ত্রী অভিহিত করে থাকে। আর আমি তাকে আমার চাওয়া-পাওয়া ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পথে কঠিন শিলার মত অন্তরায় মনে করি।

বললাম- তোমার অনেক প্রত্যাশা। কোন প্রত্যাশার কথা বলতে চাচ্ছে?

বলল- আমার জীবনে একটাই প্রত্যাশা। তা হল, চোখ বন্ধ করে, খুলেই যদি (এক পলকের মধ্যে) দেখতে পেতাম- এদেশের কোন মহিলার মুখ বোরকাবৃত নেই।

বললাম- ঐ বিষয়টি তোমার আওতায় নেই। এতে তোমার কোন অধিকারও নেই।

বলল- বোরকার ব্যাপারে অনেক লোকই আমার মত অভিমত পোষণ করে। আমি যা প্রত্যাশা করে, তারাও তা করে। (এ সব সংস্কারবাদী পুরুষ) মূলত তাদের মেয়েদের মুখ থেকে বোরকা খুলতে অক্ষম। মেয়েরা যেমন পরস্পরের সাথে অবাধে মিশে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে পুরুষদের সঙ্গে অবাধে মিশার সুযোগ করে দিতেও তারা অক্ষম। এটি এক ধরনের অক্ষমতা ও দুর্বলতা ও ভীতি- যে, ভীতি প্রাচ্যের মানুষের মনকে শংকায় আচ্ছন্ন করে, যখনই সে এ ধরনের (দুঃসাহসী) কোন বিষয়ে অগ্রসর হয়। তাই আমি প্রাচীন আদ জাতির ন্যায় এই প্রথা ও কুসংস্কারের সৌধটির প্রথম ধ্বংস সাধনকারী হতে চাই। এ সৌধটি বহুকাল ধরে জাতির উন্নতি ও সুখের অন্তরায় হয়ে আছে। আমি চাই, (নারীর) স্বাধিকারন আন্দোলনের আহ্বানকারী ও পক্ষাবলম্বনকারীদের হাতে যে কাজটি এখনো হয়নি, তা আমার হাতেই সম্পন্ন হোক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সর্বপ্রথম আমি আমার স্ত্রীর কাছে (বোরকা খোলার) বিষয়টি উত্থাপন করলাম, কিন্তু সে বিষয়টিকে খুব গুরুতর (অপরাধ) হিসেবে বিবেচনা করল। আমার কাছে মনে হল, আমি যেন বড় ধরনের বিপদ ও কঠিন অপরাধ তার উপর আপতিত করেছি। সে (আমার স্ত্রী) বলল- সে যদি পুরুষের নিকট নিজেকে প্রকাশ করে, তাহলে সে সতীর্থ মহিলাদের সামনে বের হতে পারবে না, অথচ এতে কোন লজ্জা নেই। আর কিছু নয়, বরং এটা এদেশের মেয়েদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত লাঞ্ছনা, নিশ্চলতা ও স্বয়ং মৃত্যু সদৃশ। কেননা আল্লাহ তাদের ভাগ্যে যেন লিখে রেখেছেন, তারা অন্ধকার কবরের ন্যায় গৃহকোণ ও পর্দার অন্তরালে মৃত্যু অবধি (সমাধি সদৃশ) দুনিয়ার এ কবর থেকে মৃত্যুর কবর পর্যন্ত বাস করবে। সুতরাং অবশ্যই আমাকে আমার প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌছতে হবে, এবং (আমার স্ত্রী) এই কঠিন শিলার মত মাথায় এমন ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে, যার পরিণতিতে রোগমুক্ত হবে; নতুবা তা (বিবাহ বন্ধন) ভেঙ্গে যাবে।

চলবে..

বিষয়: সাহিত্য

১২৩৪ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

314205
১১ এপ্রিল ২০১৫ সকাল ০৬:২৪
যুথী লিখেছেন : ওটা ই'বরাত নয়, 'আবরাত, عَبْراتٌ
১১ এপ্রিল ২০১৫ দুপুর ০৩:৪০
255244
নাহিদ নোমান লিখেছেন : জাঝাকিল্লাহ...সংশোধন করে দিচ্ছি
314211
১১ এপ্রিল ২০১৫ সকাল ০৭:৫৬
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন :
বরং এটা এদেশের মেয়েদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত লাঞ্ছনা, নিশ্চলতা ও স্বয়ং মৃত্যু সদৃশ। কেননা আল্লাহ তাদের ভাগ্যে যেন লিখে রেখেছেন, তারা অন্ধকার কবরের ন্যায় গৃহকোণ ও পর্দার অন্তরালে মৃত্যু অবধি (সমাধি সদৃশ) দুনিয়ার এ কবর থেকে মৃত্যুর কবর পর্যন্ত বাস করবে।


নারীরা যদি নিজেকে আবৃত করে রেখে এর মাঝেই তাদের প্রকৃত সুখ সাচ্ছন্দ খুঁজে পায়, তাহলে তাকে বোরখা খুলতে বাধ্য করা চরম বাড়াবাড়ি নয় কি? এখনতো সব কিছুতেই নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপক বেড়েছে, বোরখাও খসে খসে পড়ছে কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক সুখ শান্তি ফিরে আসছে কি? অর্থনোইতিক গতিশীলতা আসছে, কিন্তু পরকীয়ার ভয়াল থাবা থামানো যাচ্ছে কি?

আপনার পোস্টের সাথে ছবিটা যাচ্ছে না, হিজাবের একটা সুন্দর ছবি দেবেন আশা করি।
১১ এপ্রিল ২০১৫ দুপুর ০৩:৪০
255243
নাহিদ নোমান লিখেছেন : মন্তব্যের জন্য জাঝাকাল্লাহ...সাথে থাকুন, সব উত্তর পাবেন গল্পেই পাবেন আশা করি
328418
০৩ জুলাই ২০১৫ সকাল ০৭:০৩
স্বপ্নচারী মাঝি লিখেছেন : জাঝাকাল্লাহ, পিলাচ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File