বন্দুক যুদ্ধের নাটকঃ রক্তাক্ত বাংলাদেশ
লিখেছেন লিখেছেন নাহিদ নোমান ১৩ মার্চ, ২০১৪, ০৩:৩৬:৪৩ দুপুর
বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড তথা ক্রসফায়ার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বিরাট বাধা বলে মনে করেন বিশিষ্ট কলামিস্ট অধ্যাপক আজিজুর রহমান আযম। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড মৌলিক ভাবে নিষিদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনগনের মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে যান। যা আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক যে ইস্যুটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা হলো যৌথবাহিনীর ক্রসফায়ার। তবে ইদানিং এই ক্রসফায়ারে ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের পরিবর্তে একের পর এক নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছে। কিন্তু কাহিনী পূর্বের মতোই, সাজানো আছে নাটকের দৃশ্যপটের মতো
রাষ্ট্রীয় বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বা ক্রসফায়ার সম্ভবত: সিরাজ শিকদার হত্যাকান্ড দিয়েই শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী এই আওয়ামী বাকশালী সরকারের জাতীয় রক্ষীবাহিনী ছিল সরকারী দলের ক্যাডারদের দ্বারা গঠিত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার একটি বিশেষ বাহিনী। এরপরে বিগত সরকারের অপারেশন ক্লিনহার্ট পরে এলিট ফোর্সের তৎপরতা। যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এটার বিস্তৃতি করে চলেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এতোদিন দেশের ভয়ংকর সন্ত্রাসীরা এই ক্রসফায়ারের শিকার হলেও এখন বিরোধীদলের নেতা-কর্মী ও দেশের সাধারণ মানুষও এটার শিকার হচ্ছে। এইতো হলো আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমিতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ইতিহাস। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আজ অবধি কত মানুষ বিনা বিচারে বা ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া কঠিন। তবে ২০০৪ সালে ২৬শে মার্চ র্যাব গঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজারের অধিক মানুষ গুপ্তহত্যা, অপহরণ, গুমের শিকার হয়েছে বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়। মানবাধিকার সংগঠনের হিসাবে কেবলমাত্র ক্রসফায়ারে আওয়ামী শাসনের ৫ বছরে হত্যা করা হয়েছে ৭৬২ জনকে। বিদায়ী ২০১৩ সালে ১২৮ জনকে বিচার বহির্ভূত ভাবে হত্যা করেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। দেশের বৃহৎ একটি ইসলামপন্থী দল দাবি করেছে গত এক দেড় মাসে তাদের ৫৯জন নেতা-কর্মী শুধু আইনশৃংখলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। বিনা বিচারে আটক, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের ভয়ে সহিংসতায় আহতরা বিনা চিকিংসায় মৃত্যুর ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলছে বলে দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলো রিপোর্টে প্রকাশ করেছে।
বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড তথা ক্রসফায়ার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে বিরাট বাধা বলে মনে করেন বিশিষ্ট কলামিস্ট অধ্যাপক আজিজুর রহমান আযম। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দন্ড মৌলিক ভাবে নিষিদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর বিশেষ করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনগনের মৌলিক অধিকারের কথা ভুলে যান। যা আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায়।
১৯৭২ সালে গঠিত জাতীয় রক্ষীবাহিনী আদলে বর্তমান সরকার র্যাব, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে যৌথবাহিনী গঠন করে বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের নিয়মিত বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করেই চলছে। দিনের আলোতে জনসম্মুখে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে অস্বীকার করে রাতের আঁধারে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করার পর লাশ ফেলে গেলেও পুলিশ তা স্বীকার না করে পূর্বের মত বন্দুক যুদ্ধের নাটকের কথা বলে পরিকল্পিত হত্যাকান্ডকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বন্দুক যুদ্ধের কোন আলামত সংশ্লিষ্ট এলাকায় নেই , বরং স্থানীয় জনগন যুদ্ধতো দূরের কথা প্রতিপক্ষ কোন বাহিনীও দেখতে পাচ্ছে না। বড় জোর রাতের অন্ধকারে একটা বা দুটা গুলির শব্দ শুনছে আর সে গুলিতে অবশ্যই একজন নিরাপরাধ-নিরস্ত্র মানুষের জীবন যাচ্ছে। তাহলে কি ক্রসফায়ার বা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটকের নামে দেশ গড়ার আগামী দিনের আদর্শিক নেতৃত্বকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে বর্তমান সরকার? আজ বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে জাতীয় গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যম থেকে একটি সংবাদই আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি , তা হলো “রাষ্ট্রীয় আইন শৃংখলাবাহিনীর ক্রসফায়ার বা তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধে বিরোধী নেতা-কর্মী নিহত”।
লক্ষীপুরে নিজ বাড়িতে খাবার গ্রহনরত অবস্থায় যৌথবাহিনীর গুলিতে যুবদল নেতা নিহত। লক্ষীপুর জেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর ডাঃ ফয়েজকে নিজ বাসার ছাদ থেকে গুলি করে নিচে ফেলে দেয় র্যাব। সাতক্ষীরায় ইউপি চেয়ারম্যান ও জামায়াতের রুকন মোঃ আনোয়ারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে নিজের চিংড়ীর ঘেরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে যৌথবাহিনী, মিডিয়াতে বন্দুক যুদ্ধের সংবাদ প্রচার করে। এর দুইদিন পরে দেবহাটায় শিবির কর্মী, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আবু হানিফ ছোটনকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে গভীর রাতে গ্রামের মাঠে গুলি করে হত্যা করে। মেহেরপুরের আমঝুপিতে ইউপি মেম্বার ও জামায়াত নেতাকে গুলি করে হত্যা করে বন্দুক যুদ্ধের নাটক জাতির সামনে প্রচার করে। নীলফামারীতে সংস্কৃতিমন্ত্রীর গাড়ীবহরে হামলার প্রধান আসামী বিএনপি নেতা গোলাম রব্বানী ও ছাত্রদল নেতা আতিকুর রহমান আতিকসহ চার জনের লাশ পাওয়া যায় কয়েক দিনের ব্যবধানে। সীতাকুন্ডু শিবিরের পৌরসভার সভাপতি মোশাররফ হোসেনকে বোনের বাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করে হ্যান্ডকার্ফ পরাবস্থায় গুলি করে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে যায় যৌথবাহিনী। একই দিনে মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারী আলহাজ্জ্ব তারিক মুহাম্মদ সাইফুলকে শহরের ইসলামী ব্যাংকের নিচ থেকে গ্রেপ্তার করে গভীর রাতে শহরের অদূরে গুলি করে হত্যা করে আইনশৃংখলা বাহিনী, এখানেও বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজায় প্রশাসন। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর থানা জামায়াতের অর্থ সম্পাদক, স্কুলশিক্ষক এনামুল হককে উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা শেষে নির্বাচন অফিস থেকে তুলে নিয়ে গভীর রাতে হত্যা করে ডিবি পুলিশ। সাতক্ষীরার দেবহাটা শিবিরের থানা সেক্রেটারী আবুল কালাম আযাদ ও দুই ছাত্রদল কর্মীকে গ্রেপ্তার করে গভীর রাতে গুলি করে হত্যা করে যৌথবাহিনী। এমনিভাবে আজ শিক্ষক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, শ্রমিক সহ সর্বস্তরের নাগরিকের রক্তে সারা দেশ রক্তাক্ত।
সব নাটকে উপস্থাপনা একই শুধু স্থান আর শিকারী ভিন্ন ভিন্ন। এভাবে প্রতিদিন পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ারের নামে নিরাপরাধ নাগরিকদের হত্যার ফলে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়েছে, পাশাপাশি নানান প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে যার মধ্যে অন্যতমঃ
১. নাটকের মাধ্যমে যাদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে তাদের আসল পরিচয় ও অপরাধ কি? কেন প্রকাশ্যে বলছে না সরকারী কর্তাব্যক্তিরা? তারা যদি অপরাধী হয়ে থাকে তবে কেন তাদের জানাযার নামাজে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে?
২. প্রকাশ্যে দিনের আলোতে বাসা-বাড়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি কিভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে? গ্রেপ্তারের তিন/চার দিন পরে কেন লাশ পাওয়া যায়?
৩. সরকারকে এই ভাবে দেশের উচ্চশিক্ষিত এবং ভবিষ্যৎ আধুনিক ও উন্নত দেশ গঠনের কারিগরদেরকে হত্যার অনুমতি কে দিয়েছে? দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন আদালত কি এই হত্যাকান্ডের বৈধতা দিয়েছে?
৪. জাতিকে মেধাবী ও আদর্শিক নেতৃত্বশূণ্য করার এ ধরনের জাতি বিধ্বংসী হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে দেশের তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী, অধিকাংশ মিডিয়া এবং উচ্চ আদালত নীরব কেন? তথাকথিত বন্দুক যুদ্ধের কোন খবর সাংবাদিকরা জানেন না কেন?
ধারাবাহিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাছাইকৃত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কে ঠান্ডা মাথায় হত্যার পর একইভাবে বন্দুক যুদ্ধের কথা বলে যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে, তা সচেতন দেশবাসীর বুঝতে বাকি নেই। যদি বন্দুকযুদ্ধই হবে, তাহলে শুধু পুলিশের হেফাজতে থাকা নেতাকর্মীরাই কেন নিহত হন? বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডে সরকার বিরল নজির স্থাপন করে চলেছে। পরিকল্পিত এসব হত্যাকান্ডের মাধ্যমে বিরোধী নিধনে সরকারের অপচেষ্টা আজ স্পষ্ট। সরকারের এই অবস্থান প্রমাণ করে তারা আইনের শাসনে বিশ্বাসী নয়। দেশের নাগরিক হিসাবে কোন নাগরিক যদি অপরাধ করেই থাকে, তাহলে আইনের প্রক্রিয়া মেনে তার বিচার সরকার করতে পারে। কিন্তু তা না করে রাতের আঁধারে নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে সরকার প্রমাণ করেছে তারা মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু। তারা বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের যে খেলায় মেতে উঠেছে তার পরিণতি শুভ হবে না। সরকারকে এ সব হত্যাকান্ডের সম্পূর্ণ দায় বহন করতে হবে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে অবশ্যই জনসম্মুখে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি।
লেখক: ব্লগার এন্ড অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট
প্রবন্ধটি "জনতার আদালত" (একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী ম্যাগাজিন) এ প্রকাশিত
বিষয়: রাজনীতি
১৩৪৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন