পিতা শেখ মুজিবকে পুত্র কাদের সিদ্দিকীর লেখা চিঠি(২০১২)
লিখেছেন লিখেছেন জাগ্রত চৌরঙ্গী ১৭ মার্চ, ২০১৪, ০২:১৪:৫৪ দুপুর
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আজ ১৭ মার্চ তোমার শুভ জন্মদিন। তুমি এখন থাকলে তোমার বয়স হতো ৯২ বছর। কেমন দেখাত তোমাকে? সেই আগের মতোই কি? নাকি এখনকার আমার মতো? এসব জানতে বড় ইচ্ছে করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার সকালে তোমাকে খুন করেছিল কারা, তা কি তুমি জানো? তাদের ক’জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কিন’ মনে হয় যারা হত্যার পরিকল্পনা করেছে, পরিচালনা করেছে, তারা হয়তো এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। কেউ তাদের স্পর্শও করেনি। তুমি পরপারে চলে গেছো অনেক বছর। এপারের অনেক খবরই হয়তো ভালোভাবে জানো না। কে তোমাকে কিভাবে খবর দেয়, নাকি একেবারেই পাও না, নাকি ’৭১-এর ২৫ মার্চ হানাদার পাকিস্তানিরা তোমাকে বন্দী করে রাখার সময় যেমন বাংলাদেশে কী হচ্ছে তার কোনো খবর পেতে না, তেমনি এখনো কোনো খবর পাও না- এসবের কিছুই জানি না। আজ তোমার জন্মদিন। তোমার জন্মদিন মানে বাংলাদেশের জন্মদিন। বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের সবার জন্মদিন হওয়ার কথা। কয়েক বছর আগে তোমার জন্মদিনকে ‘শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলাম; কিন’ সে অনুরোধ কেউ রাখেনি। তুমি নেই। তাই তোমার প্রিয় সন-ানদের কথা এখন অনেকেই শুনতে চায় না। বরং ক্ষমতাবানেরা আমাদের বোঝা বলে মনে করেন। ’৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সামাজিক পরিবর্তনের চিন্তায় তুমি কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলে। এখন কিন’ তোমার সেই কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ আর জীবিত নেই। তোমাকে হত্যার পরপরই তোমার রাজনৈতিক সংগঠন কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগকে ছলে-বলে-কৌশলে হত্যা করে তোমার কবর দেয়া আওয়ামী লীগকে আবার কবর থেকে তুলে এনে রাজনীতি করছে। তোমার রাজনীতি এখন নেই। এখন তোমার কবর দেয়া রাজনীতি আছে। তুমি যখন মারা যাও, মানে তোমাকে যখন মেরে ফেলা হয় তোমার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও রেহানা জার্মানিতে ছিল। তারা এখন অনেক বড় হয়েছে। অনেক কষ্ট করে এখন তোমার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৩২ বছর যাবৎ সভাপতি। তুমি কিন’ এর চার ভাগের এক ভাগ সময়ও সভাপতি থাকতে পারোনি।
’৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাগমারী মহাসম্মেলনে সিদ্ধান- হয়েছিল আওয়ামী লীগের কোনো নেতা একসাথে দলীয় ও সরকারি পদে থাকতে পারবে না। তুমি তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী। তুমি সেখানেই দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলে, ‘দুই পদের একটা ছাড়তে হলে আমি মন্ত্রিত্ব ছাড়ব’ এবং তা করে তুমি একটা ইতিহাস রচনা করেছিলে। কিন’ তোমার এ নীতি তোমারই কন্যা অমান্য করে সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি পদে আছেন একই সাথে। এখন আর তেমন কোনো ন্যায়নীতি নেই। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রবাদের মতো অবস্থা। তুমি তো এটাও হয়তো জানো না, তোমাকে মেরে কারা ক্ষমতায় এসেছিল। তোমার মা যে দিন মারা যান, সে দিন তোমার পাশে যে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিল, সেই তোমাকে মেরে ক্ষমতায় বসেছিল। বেশি দিন থাকতে পারেনি। মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় তাকে ঘাড় ধরে জিয়াউর রহমান বীরোত্তম রাষ্ট্রপতি পদ থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন; ঘটনাটা যদিও একটু অন্যভাবে ঘটেছিল। বলতে গেলে বিশদভাবে বলতে হয়। কিন’ চিনতে পেরেছ কি না তাই বলো। একটুও পারোনি? তোমার মায়ের লাশের সামনে তোমার মন্ত্রিসভার কে তোমার চেয়ে বেশি কেঁদেছিল? সবার চোখে পড়েছে, তোমার চোখে পড়েনি? এটা বুঝি, মা মারা যাওয়ায় তুমি খুবই বিমর্ষ ছিলে, বেদনায় ছিলে মুহ্যমান, তাই হয়তো খেয়াল করোনি। তার পরও কিন’ এমন মনে হয় না যে, ঘটনাটি তোমার নজরে আসেনি। ওই যে ’৬৯-এ জামালপুর থেকে ফেরার পথে মিষ্টি আনতে তুমি আমায় এক শ’ টাকা দিয়েছিলে। মিষ্টি এনে ৬৮ টাকা ফিরিয়ে দিতে গেলে তুমি বলেছিলে, ‘এভাবে নেতার টাকা ফিরিয়ে দিলে তুই রাজনীতি করবি কী করে?’ সে থেকেই তুমি ধীরে ধীরে নেতা থেকে পিতা হয়েছিলে। শুধু আমার নয়, তোমার সময়ের সব বাঙালির পিতা হয়েছিলে। তা না হলে আমার বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকীর মতো মানুষও টুঙ্গিপাড়ায় তোমার কবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জারজার হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে পারেন, ‘শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিব আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট। সে আমার পিতা, আমার সন্তানের পিতা, সন্তানেরও পিতা। তাই তো সে বঙ্গপিতা।’ তোমার জন্মদিনে মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন’ না, তোমাকে যে দিন হারিয়েছিলাম, সেই ১৫ আগস্ট ’৭৫-এর মতো ভারাক্রান- হয়ে আছে। তোমাকে ছাড়া আমাদের চার দিক অন্ধকার। চার দিকে ভালো কিছু দেখতে পাই না। সব দিকেই কেমন যেন একটা দারুণ কষ্ট।চিন্তাকোরো না পিতা, শুরু যখন করেছি ধীরে ধীরে সব জানাব তোমাকে। তুমি এত দিন তোমার প্রিয় মাতৃভূমির সন্তানেরসন-তিদের কোনো খবর পেয়েছ কি না, না পেয়ে থাকলে তোমার এই উৎকণ্ঠা দূর করতে না পারা সে এক অমার্জনীয় অপরাধ, দয়া করে আমাদের ক্ষমা কোরো। আবার জিজ্ঞেস করি, বুঝতে পেরেছ কি তোমার মন্ত্রিসভার কে সে? বুঝেছ? সত্যিই বুঝেছ? হ্যাঁ, তার কথাই বলছি। একসময় শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টিসভ্যতায় পূর্ববঙ্গের শ্রেষ্ঠ জেলা কুমিল্লাকে যে কলঙ্কিত করেছে সেই খুনি মোশতাক আহমদের কথাই বলছি। তোমাকে হত্যা করে সেই প্রথম রাষ্ট্রপতির গদিতে বসেছিল। তোমার হত্যার প্রতিবাদে এই অধম ছাড়া তেমন কেউ সে দিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খোন্দকার, নৌবাহিনী প্রধান, সেনাবাহিনী প্রধান কে এম সফিউল্লাহ- কেউ নয়। ১৪ আগস্ট রাত ১টা ৪০ মিনিটে শেষ কথা হয়েছিল। তারপর তোমার সাথে আর কোনো কথা হয়নি। তাই সত্য-মিথ্যা বলতে পারব না। কিন’ জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছে, বিপথগামী সেনাসদস্যরা ধানমন্ডির বাড়িতে গুলি চালালে তুমি তাকে ব্যাবস্থা নিতে বলেছিলে। সে ইদানীং টেলিভিশন চ্যানেলে বলছে, তোমাকে নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বলেছিল। তুমিই দেখো, কেমন নির্বোধ সেনাপ্রধান বানিয়েছিলে? পাকিস-ানিদের ভয়ে তুমি কোনো দিন পালাওনি, বাড়ি ছাড়োনি, তোমার দেশে তোমার গড়া সেনাবাহিনীর বিপথগামী কয়েকটা সৈন্যের জন্য তোমাকে বাড়ি ছাড়তে বলেছে তোমারই নিযুক্ত সেনাপ্রধান। কী আর বলব, এখনো তার বিচার হয়নি। সে এখন তোমার কন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। না, তোমার সময় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলী ও প্রেসিডিয়াম কোনো কিছুই ছিল না। আর এ কে খোন্দকার পরিকল্পনামন্ত্রী। তোমাকে হত্যার পরের কোনো ঘটনাই তো মনে হয় তোমার জানা নেই। তাই সবই বলা দরকার। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে তুমি তখন সারা দেশে জেলা গভর্নর পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলে। আমাকেও টাঙ্গাইল জেলার দায়িত্ব দিয়েছিলে। মাসব্যাপী এর প্রশিক্ষণ চলছিল বঙ্গভবনে। প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছিল ১৪ আগস্ট ১৯৭৫।
১৫ আগস্ট শুক্রবার ছিল মন্ত্রীদের দফতর পরিদর্শন। তা আর কোনো দিন হয়নি। গভর্নরদের প্রশিক্ষণের সূচনা করেছিলে তুমি নিজে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, মোশতাক আহমদ- এরা সবাই তাতে অংশ নিয়েছিলেন। শুধু অংশ নেননি বা নিতে পারেননি একজন। তিনি ছিলেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। কারণ তার আগেই তাকে তুমি মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলে। তুমি সরিয়ে দিলেও তিনি তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়াননি। ঘরেই বসে ছিলেন। কিন’ তোমার হত্যাকারীরা তাকে ছাড়েনি। তোমাকে হত্যা করে খোন্দকার মোশতাক যে মন্ত্রিসভা গঠন করে তাতে তোমারই মন্ত্রীরা অংশ নেন। সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান- এ চারজন ছাড়া বাকি সবাই তাতে স’ান পান। ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায় হোক শপথ গ্রহণ করেন। সে শপথ গ্রহণে এ আর মল্লিক, মনোরঞ্জন ধর, ফণীভূষণ মজুমদার, আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়দুর রহমান সবাই ছিলেন, কেউ বাদ পড়েননি। তোমার মৃত্যু সংবাদ সকাল সাড়ে ৫টায় পেয়েছিলাম। তখন থেকেই আমি ছিলাম বিধ্বস-। রাজনীতি করেছি বহু দিন কিন’ কোনো সময় পালিয়ে থাকিনি। তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। ১৫০০ টাকা নিয়ে এক কাপড়ে তোমার দেয়া ২০/৩০ বাবর রোড মোহাম্মদপুরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ১৬ বছর আর ফেরা হয়নি। প্রথমেই গিয়েছিলাম গজনবী রোডের প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের দাদুর বাড়ি। স্বাধীনতার পর তার সাথে বড় বেশি ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। অমন দুঃসময়ে একমাত্র তিনিই সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার ছেলে জাহিদ ফারুক বিমানবাহিনীতে চাকরি করত। ভিআইপি হেলিকপ্টার চালাত। কী হয়েছে, বারবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। দুপুরে নামাজের জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হয়েছিল। সে সময় গজনবী রোড থেকে খিলজী রোডে মুসলিম লীগ ঘরানার আব্দুস সবুর দারোগার বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে যেতে আমার আপত্তি ছিল। প্রথম অবস’ায় তাকে বিশ্বাস করতে পারিনি, যদি ধরিয়ে দেয়! কিন’ আমার এক সহযোদ্ধা আরিফ আহমেদ দুলাল বলছিল, সবুর দারোগার বাড়িতে কোনো ভয়ের কারণ নেই। কারণ তার ছেলে যেমন কাদেরিয়া বাহিনীতে ছিল, ঠিক তেমনই তার মেয়ের জামাইও ছিল। ছেলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও মেয়ের জামাইর সাথে করবে না। তাই ও-বাড়িতে রক্ষাকবচ দুই দিক থেকে।
বাস-বে সেটাই দেখেছি। আদতেই সিলিমপুরের সবুর দারোগা ও তার স্ত্রী অত্যন- ভালো মানুষ ছিলেন। তারা দু’জনই জড়জগৎ ত্যাগ করেছেন। আমি তাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে একা হতে দেননি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ না কেউ একজন সব সময় পাশে থেকেছেন। সারা দিন মুখে দানাপানি পড়েনি। খেতে ইচ্ছেও হয়নি। সন্ধ্যার সময় জোর করে তারা আমায় খাওয়ার টেবিলে বসিয়েছিলেন। প্রথম লোকমা মুখে দিতে গলা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। অত দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে মনে হয় গলা শুকিয়ে যায়। তেমনটাই হয়েছিল। এক বা দুই লোকমা খাওয়ার পর গোশত মুখে দিতে কেমন যেন লাগছিল। কয়েকটা কামড়ও দিয়েছিলাম। আপনা থেকেই ঝরঝর করে ভাতের থালায় চোখের পানি পড়ছিল। আর মনে হচ্ছিল, আমি যেন তোমার মাংস চিবাচ্ছি। আর খেতে পারিনি। মুখ থেকে খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। এরপর প্রায় ২৮ বছর গোশত মুখে দেয়া হয়নি। এখন যদিও মাঝে মধ্যে গোশত খাই, তবে গোশত আর ভালো লাগে না। গোশত খাওয়ার সেটাও এক বিরাট ঘটনা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তোমার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড আক্রমণ হয়েছিল। তাতে শত শত কর্মী আহত হন। তোমার স্নেহের আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আজমীর শরিফে খাজা বাবার মাজার শরিফ জিয়ারত করে সেদিন আমি দিল্লিতে ছিলাম। খাজা বাবার মাজারের এক প্রবীণ মুয়াল্লেম। আমি তোমার হত্যার প্রতিকার না করে গোশত খাবো না শপথ করেছি শুনে বুজুর্গ মুয়াল্লেম বলেছিলেন, ‘বাবা, আল্লাহ তায়ালা কত জিনিস হারাম করেছেন। তার পরও কখনো সখনো আমরা তাও খাই। আর পশুর গোশত মানুষের জন্য আল্লাহ হালাল করেছেন। আপনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য পণ করে আল্লাহর হালাল করা খাবার খান না- এটা কেমন কথা? ঠিক আছে না খেতে চান, না খান। কিন’ অন-তঃপক্ষে কোরবানির গোশত এক-দু’বার খাবেন।’ সেই থেকে মাঝে মধ্যে গোশত খাই। কিন’ অতগুলো বছর পর আর গোশত খেতে ভালো লাগে না। তুমি তো জানোই আমি বাপের বেটা নই, মায়ের বেটা। আমি মাপাগল ছেলে ছিলাম। মা-ই ছিল আমার জীবন। তুমি মারা যাওয়ার পর নির্বাসিত জীবনেও মাকে ছাড়া খুব বেশি সময় থাকিনি। ‘মা, মা’ চিৎকার করে সব সময় ঘরে ফিরতাম। এখনো ফিরি। সে কথা তোমাকে পরে বলব। তুমি তো জানো না, বাবা মারা গেছেন ২০০০ সালের ১৩ মে।
তোমার কন্যা জননেত্রী হাসিনার সভায় গ্রেনেড আক্রমণের খবর পেয়ে দিল্লি থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে তোমার দেয়া মোহাম্মদপুরের ২০/৩০ বাবর রোডের বাড়িতে না ফিরেই সুধা সদনে নেত্রীকে দেখতে গিয়েছিলাম। ও, তুমি তো আবার সুধা সদন চেনো না। তুমি যখন ছিলে, তখন সুধা সদন ছিল না। তোমার প্রিয় মেয়ের জামাই আমার দুলাভাই ড. ওয়াজেদ মিয়া ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে একটি বাড়ি বানিয়েছেন। সেটাই হলো সুধা সদন। তখন আমার এক মেয়ে এক ছেলে ছিল। এখন আল্লাহর দান, আরেকটি মেয়ে কুশিমণি এসেছে। বড় সুন্দর চটপটে, কেজি ওয়ানে পড়ে। মা মারা গেছে তাও প্রায় আট বছর। আমার শূন্য বুক সেই ভরে দিয়েছে। তোমার সাথে আমার ছবি দেখলেই বলে, ‘এটা আমার দাদু ছিল। বঙ্গবন্ধু আমার দাদু।’ বলতে যখন শুরু করেছি তোমার চলে যাওয়ার পরের সব ঘটনাই আসে-ধীরে বলব। আজ হয়তো গুছিয়ে বলা হলো না; কিন’ পরে ধীরে ধীরে তোমাকে সব গুছিয়েই বলব, যাতে বুঝতে কোনো অসুবিধা না হয়। দীপ, কুঁড়ি এবং তোমার বৌমা নাসরীন কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে বোনকে দেখতে সুধা সদনে গিয়েছিলাম। অভাবনীয় যত্ন করেছিল। তারপর যেভাবে চলার সেভাবেই চলেছে। তোমাকে বলছিলাম তোমার হত্যার দিনের কথা। সপরিবারে তুমি যখন চলে গেলে তারপর কী হলো, সেই কথা। আমি সারা দিন পর খেতে বসে গোশত মুখে দিয়ে অঝোরে কাঁদছিলাম। ছেলেবেলায় গুরুজনদের কাছে শুনেছিলাম, খাবারের থালায় চোখের পানি পড়লে অমঙ্গল হয়, দুঃখ বাড়ে। ওই একবারই খাবারের থালায় চোখের পানি পড়ায় কতই যে অমঙ্গল হলো, যে কারণে সে দুঃখের আর শেষ নেই। বেঁচে থাকতে কোনো দিন হবে কি না তাও তো জানি না। সে দিন তোমার জন্য কেঁদেছিলাম। কেন যে বুকের গহিন থেকে কান্না এলো তাও তো জানি না। কেন তোমাকে অত ভালোবাসতাম, তুমি থাকতে এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে পারিনি। আসলে তুমিও কি আমায় আমার মতো করেই ভালোবাসতে? নাকি সবই একতরফা? তাই তোমার মৃত্যু আমাকে এলোমেলো করে ফেলেছিল। তুমি তো জানোই, আমি খুব একটা দুর্বল স্মৃতির ছেলে নই। জীবনে একবার যাকে দেখেছি, দুই-তিন যুগ পরেও তাকে ভুলিনি। তার পরও সে দিনের সারা দিনের অনেক স্মৃতিই আমার স্মরণে নেই। তোমার মৃত্যু সংবাদ টেলিফোনে পেয়েছিলাম। বোন রহিমা জানিয়েছিল ছোট বোন শুশুকে। সে এসে উদভ্রানে-র মতো খবর দিয়েছিল, ‘সেনাবাহিনী ক্যু করেছে।’ আমি তো তেমন লেখাপড়া জানতাম না, তাই তখনো ক্যুর অর্থ বুঝিনি। ক্যু শব্দই ওর আগে শুনিনি। রেডিওতে শুনলাম মেজর ডালিমের কণ্ঠ। তুমি মেজর ডালিমকে খুবই আদর করতে। তোমার পরিবারের সবাই আদর করত। আপন ভাইয়ের মতো রেহানাকে ডালিমের গলা জড়িয়ে ঝুলতে দেখেছি। কী ভালোই না বাসতে তোমরা ওকে। বাংলাদেশ বেতারে সেই ডালিমের কণ্ঠে শুনলাম, ‘দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। তুমি যে স্বৈরাচারী, জীবনে এক দিনের জন্যও তা মনে করিনি। তুমি তো পিতা। পিতা আবার স্বৈরাচারী হয় কখনো কোনো দিন? কোনো বাঙালি তোমার বুকে গুলি চালাতে পারে, এটা তো আমার কল্পনাতেও ছিল না। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধ শেষে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ তুমি যে দিন আমার কাছে অস্ত্র নিতে গিয়েছিলে, সে দিন ভয়ে বড়সড় কেউ টাঙ্গাইল যাননি। কোনো মন্ত্রী, সেনা, বিমান, নৌবাহিনী প্রধান, পুলিশের আইজি? কেউ না। হ্যাঁ, তোমার দুই ছেলে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল গিয়েছিল। গিয়েছিল শেখ শহীদ আর ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। সবার ভয় ছিল টাঙ্গাইলে তোমাকে আটকে আমি ক্ষমতা নিয়ে নেবো। কিন’ তুমি কোনো ভয় করোনি। পুত্রের কাছে পিতার আবার কিসের ভয়? যদিও রাজ্যের জন্য অনেক পুত্র পিতাকে খুন করেছে। পিতাও পুত্রকে অন্ধ ও হত্যা করেছে। কিন’ তুমি তো তেমন পিতা নও। তুমি তো পিতার পিতা বঙ্গপিতা শেখ মুজিব। তাই তোমার ভয় কিসের? তুমি নির্ভয়ে টাঙ্গাইল গিয়েছিলে। আর অধম সন-ান হিসেবে আমাদের সব অস্ত্র তোমার হাতে নয়, পদতলে অর্পণ করেছিলাম। এক মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি, তোমাকে দেয়া ওই অস্ত্র কোথায় রাখবে? কার কাছে রাখবে? যাদের কাছে রাখবে, তারা যদি কোনো দিন তোমার কথা না শোনে, তাহলে তার প্রতিকার কী হবে? তোমার প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ ছিলাম, আবেগে ছিলাম বিভোর। তাই ওসব চিন-া মাথায় আসেনি। আমি তোমার হাতে অস্ত্র দিতে সাহস করিনি, পায়ের সামনে দিয়েছিলাম। অথচ সেই তোমার বুকে কোন সে নমরুদ, ফেরাউন, ‘এজিদ’, সীমারের দল কিভাবে গুলি চালাল? জানি মহানবী সা:-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের মস-ক কেটে বল্লমের ডগায় লটকে পুরস্কারের আশায় দামেস্কে এজিদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সীমার- এজিদেরা যে সব কিছুই করতে পারে, তা সেই ২৭-২৮ বছর বয়সে মাথায় আসেনি।
তোমাকে হত্যা করেই তোমার মন্ত্রিসভার সদস্য তোমার মায়ের জন্য কেঁদে বুক ভাসানো খুনি মোশতাক মন্ত্রিসভা গঠন করেছিল, যা আগেই বলেছি। যা বলি নাই তা হলো, সে দিন সাড়ে দশ-এগারোটা থেকে তোমাকে খুন করে যারা ক্ষমতায় এসেছিল তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। শুনলে অবাক হবে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যে রক্ষীবাহিনী গড়েছিলে, যে বাহিনীতে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রায় ৯ হাজার যোদ্ধা ছিল, সেই বাহিনীর ডিজি তখন দেশের বাইরে। তিনজন পরিচালকের একজন আনোয়ারুল আলম শহীদ যাকে তুমি আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলে, সে রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম আনুগত্য জানিয়েছিল। এরপর সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ, বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খোন্দকার, বিডিআর প্রধান খলিলুর রহমান যাকে তুমি খুব স্নেহ করতে, দু-একবার তোমার খাবার তাকে খাওয়াতে দেখেছি, পুলিশের আইজি নুরুল ইসলাম- কেউ বাদ পড়েনি। অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। কেউ তো তোমাকে ফেরাউন বলেছে, এজিদের সাথেও তুলনা করার চেষ্টা করেছে। তোমার জন্য যে কেউ কাঁদেনি, তেমন নয়। রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন আত্মহত্যা করেছিল। সেনাবাহিনীর কয়েকজন জীবন দিয়েছিল। সেনাবাহিনীর শতকরা ৯৯ জন বা তারও বেশি তোমাকে হত্যা করা মেনে নেয়নি। কিন’ তোমারই প্রিয়, উচ্চপদের কিছু কর্মকর্তা সবাইকে বিভ্রান- করেছে। তুমি তো জানোই, আমি তোমার লম্বা ছেলে। পরিবারেও আমাকে ছেলেবেলায় লম্বা গাধা বলে সম্বোধন করা হতো। তোমার হত্যার দিনই প্রতিরোধে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম। ওই দিনই প্রচার করেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র কামাল, জামাল, রাসেল নিহত হলেও আমি কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সন্তান। পিতৃহত্যার বদলা আমরা নেবোই নেবো।’
লেখক:॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৯ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
লিখেছেন : পিতার
জন্য এত
ভালবাসা মেয়ের
আছে কিনা সন্দেহ।
না হয় পিতার নাম
নিয়ে এত বড়
আসনে এসেও যখন
মানুষ অপকর্মের জন্য
মেয়ের
নামে পিতাকে গালী দেয় তখন
মেয়ের
বিবেকে বাধেনা বলেইতো ক্ষমতাসীন
মেয়ে আর ক্ষমতাহীন মেয়ে এক নয়।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন