নামায না পড়লেও চলবে, রোযা না রাখলেও কোন সমস্যা নেই, কারণ এগুলো নিছক কিছু আনুষ্ঠানিকতা ......
লিখেছেন লিখেছেন জাগ্রত চৌরঙ্গী ০২ মার্চ, ২০১৪, ০৮:২০:৫২ সকাল
আপনি একজন ভালো মানুষ - আত্মীয়স্বজনের উপকার করেন, গরিবকে দান-খয়রাত করেন, দেশের নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। সামাজিকতা এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করেন না। সুতরাং আপনার নামায না পড়লেও চলবে, রোযা না রাখলেও কোন সমস্যা নেই, কারণ এগুলো নিছক কিছু আনুষ্ঠানিকতা। একজন আদর্শ নাগরিক হয়ে মানুষের ভালো করাটাই আসল কথা। মানব ধর্মই আসল ধর্ম; জীবে দয়া করিছে যে জন, সেজন সেবিছে ঈশ্বর। এই যদি আপনার ধারণা হয়, তাহলে আপনার অবস্থা নিচের তিনটির যে কোন একটি হতে পারেঃ
আপনি মনে করেন যে আপনি আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং উন্নত বিচার-বুদ্ধির কারণে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এটা নিজেই যথেষ্ট বুঝতে পারেন এবং আল্লাহ্কে এবং তাঁর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে আপনি যথেষ্ট গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন, যেটা অন্যেরা পারে না। নামায, রোজা শুধু ওই সব অর্ধ-শিক্ষিত, অল্প-জ্ঞানী মানুষদের জন্য দরকার যারা এখনও আপনার মত চিন্তার গভীরতা এবং উপলব্ধির উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।
আপনি মনে করেন যে আপনার নীতিগত মূল্যবোধ থেকে যা কিছু ভালো মনে হয়, সেটাই ইসলামের চোখে ভালো। মানুষ তার নীতিবোধ থেকে যা কিছু ভালো এবং যা কিছু খারাপ মনে করে, তার বাইরে ইসলামের মূল্যবোধের কোন দরকার নেই। মানুষ নিজে থেকেই কি ভালো, কি মন্দ তা যথেষ্ট বোঝে; আল্লাহর মানুষকে এর বেশি কিছু শেখানোর নেই।
আপনি মনে করেন নামায, রোযা না করে আপনার কোন ক্ষতি হচ্ছে না, আপনি এমনিতেই যথেষ্ট ভালো আছেন। যেহেতু আপনার মতে আপনার কোন ক্ষতি হচ্ছে না, সুতরাং আপনার আল্লাহর বাণী শোনার কোন প্রয়োজন নেই। নামায, রোজা না করাটা যদি এতো খারাপ কাজ হতোই, তাহলে এতদিনে আপনার অনেক ক্ষতি হতে থাকতো। কিন্তু সেরকম কিছু তো হতে দেখা যাচ্ছে না।
আপনার যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন! আপনি শয়তানের মানুষকে ডোবানোর তিনটি মুল পদ্ধতির উৎকৃষ্ট নিদর্শন। শয়তান গত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একদম প্রথম মানুষ আদম (আ) থেকে শুরু করে আপনি-আমি পর্যন্ত বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষকে ডোবানোর জন্য যতগুলো পদ্ধতি সফল ভাবে প্রয়োগ করে এসেছে, তার মধ্যে তিনটি মুল পদ্ধতি হলঃ
শয়তান মানুষকে বিশ্বাস করায় যে – সে আসলে একজন ভালো মানুষ, তার থেকে কত খারাপ মানুষ পৃথিবীতে আছে! একজন ট্রাফিক পুলিশ রিকশাওয়ালার কাছ থেকে দশ-বিশ টাকা ঘুস নেবার সময় মনে করে যে, সে একজন যথেষ্ট ভালো মানুষ, কারণ সে তো সার্জেন্টের মত ট্রাক ড্রাইভারদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা ঘুষ খাচ্ছেনা। একজন সার্জেন্ট মনে করে যে, সে যথেষ্ট ভালো মানুষ কারণ সে তো ডিসির মত লক্ষ লক্ষ টাকার পুলিশের বাজেয়াপ্ত জিনিসপত্র বিক্রি করে গুলশান বনানীতে বাড়ি-গাড়ি করে ফেলছে না। একজন ডিসি মনে করে যে, সে মন্ত্রীদের থেকে অনেক ভালো মানুষ, কারণ সে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের হক মেরে দেশের কোটি টাকার ক্ষতি করছে না। এদের প্রত্যেকে শয়তান অত্যন্ত সফলভাবে বুঝাতে পেরেছে যে, সে যা করছে তা এতো খারাপ কিছু না, তার থেকে কত খারাপ মানুষ পৃথিবীতে আছে। আর সে অন্যায় না করলে কি হবে, তার পরে যে আসবে, সে তো ঠিকই একই কাজ করবে।
শয়তান মানুষকে বিশ্বাস করায় যে – ধর্ম শেখার কিছু না, এটি তার নিজের এবং আল্লাহর ব্যাপার। ধর্মের মত একটা সাধারণ ব্যাপারে আবার পড়াশুনা করতে হবে নাকি? নিজের কাছে যেটা ভালো মনে হয়, সেটাই আল্লাহর কাছে ভালো, আর নিজের কাছে যেটা খারাপ মনে হয়, সেটাই আল্লাহর কাছে খারাপ। তাছাড়া ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য যেই বই পুস্তকগুলো পড়ব, সেগুলো যে নির্ভেজাল তার প্রমাণ কি? ওই বইগুলো তো যত সব কাঠমোল্লাদের লেখা। এর চেয়ে নিজে যা ভাল-মন্দ মনে করি সেটা মেনে চললেই হল। একারনেই অনেককে দেখবেন ধুম-ধারাক্কা করে খ্রিস্টানদের মত ছেলে মেয়েদের জন্মদিন, আকিকা করে; হিন্দুদের প্রথা অনুসারে গায়ে-হলুদ, বউ-ভাত করে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেয়। কিন্তু যখন নিজের বাবা-মা মারা যায়, তখন তাদের জন্য কু’রআন খতমের ব্যবস্থা করে, চল্লিশা করে, প্রতিবছর মৃত্যু বার্ষিকীতে মিলাদের আয়োজন করে। শয়তান এদেরকে সফলভাবে বুঝাতে পেরেছে যে – এগুলো সবই ভালো কাজ, ইসলাম সম্মত কাজ, চালিয়ে যাও, আল্লাহ তোমার উপর অনেক খুশি।
শয়তান মানুষকে বিশ্বাস করায় যে – তোমার মত খারাপ মানুষ নামায পড়বে? রোযা রাখবে? তুমি নামাযে আল্লাহর কাছে মুখ দেখাবে কি করে? তোমার নামায পড়ার কথা ভাবতে লজ্জা লাগে না? এধরনের মানুষকে দেখবেন তারা কোন মতে চক্ষু লজ্জায় পরে হয়তো সপ্তাহে একদিন জুম্মার নামাযটা পড়তে মসজিদে যায় এবং রাস্তায় ফকির দেখলে মানিব্যাগ খুলে সবচেয়ে ছোট নোটটা বের করে দেয়। কিন্তু তাদের দৌড় এই পর্যন্তই। শয়তান এদেরকে সফল ভাবে বোঝাতে পেরেছে যে – তাদের আর কোন আশা নেই, আল্লাহর পক্ষেও তাদেরকে মাফ করা সম্ভব না। সুতরাং নামায পড়ে, রোযা রেখে কোন লাভ নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট, অযথা না খেয়ে থাকার কষ্ট। এরচেয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে সেখান থেকে লাখ খানেক টাকা গরিব আত্মীয়স্বজনকে দাও, কোটি টাকার লোণ নিয়ে বাড়ি কিনে হাজার খানেক টাকা গ্রামের বাড়িতে স্কুল কলেজে দান করো। বছরের পর বছর লাখ লাখ টাকার যাকাত না দিয়ে কালে ভদ্রে গরিব মানুষদেরকে কম্বল, জামা কাপড় কিনে দাও। এতেই আল্লাহ তোমাকে অল্প কয়েকদিন জাহান্নামে শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিবে।
আপনার অবস্থা যদি এই তিনটির যে কোন একটি হয়, তবে দুঃখ পাবেন না। শয়তান লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষের সাইকোলজি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছে। মানুষের সাইকোলজিতে তার মত অভিজ্ঞ কোন সত্তা পৃথিবীতে আর কেউ আছে বলে জানা নেই। লক্ষ লক্ষ বছর আগে প্রথম মানুষ আদমকে বানানোর পর শয়তানের সাথে আল্লাহর যে কথোপকথনগুলো কু’রআনে রেকর্ড করা আছে, তা থেকে শয়তানের বিশাল জ্ঞানের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। তখনি সে জানত মানুষকে কিভাবে বোকা বানানো যায়, একদিন কিয়ামতে যে মানুষের বিচার হবে, সে যে মানব জাতির একটা বিরাট অংশকে বোকা বানাতে পারবে ইত্যাদি। আর লক্ষ লক্ষ বছর পরে তার জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা কোথায় পৌঁছেছে সেটা চিন্তাও করা যায় না। মানুষকে সঠিক সময়ে সবচেয়ে মোক্ষম কুবুদ্ধি দিতে সে এতটাই অভিজ্ঞ হয়ে গেছে যে বিংশ শতাব্দীতে সে মানুষকে দিয়েই যে পরিমাণের মানুষ মারতে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে, তার ধারে কাছে মানুষ পুরো মানবজাতির ইতিহাসে মারা যায়নি। প্রতি মিনিটে শয়তানের কুমন্ত্রণা শুনে মানুষ সারা পৃথিবীতে গড়ে ৭৮টা ধর্ষণ করে, প্রতিদিন শত শত মানুষকে খুন করে, হাজার হাজার মানুষকে নিঃস্ব করে পথে বসায়, কোটি কোটি মানুষ জঘন্য, অশ্লীল কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। অথচ আল্লাহ শয়তানকে শুধুমাত্র মানুষের অবচেতন মনে কুমন্ত্রণা দেবার ক্ষমতা দিয়েছেন। আর তিনি মানুষকে ক্ষমতা দিয়েছেন শয়তানের কুমন্ত্রণা না শুনে নিজের বিবেকবুদ্ধি ব্যাবহার করে খারাপ পথে না যাবার। এছাড়াও তিনি মানুষকে আরও সাহায্য করার জন্য ৬৩৪৬টি বাণী সহ কু’রআন দিয়েছেন। এরপরেও মানুষ শয়তানের চাকর হয়ে অল্প কিছু আরাম, সন্মান, নিরাপত্তা পাবার লোভে দিনের বেশির ভাগ সময় আল্লাহর সাথে বেঈমানি করা থেকে নিজেদেরকে আটকায় না।
এখন আপনি দাবি করতে পারেন – না, না আমাকে শয়তান কিছু বলছে না। আমি নিজেই নামায, রোযা করার কোন কারণ দেখিনা। তাহলে, আপনার জন্য আমার প্রথম প্রশ্নঃ
আপনি কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন যে কু‘রআন কোন মানুষের বানানো কিছু নয়? এমনকি সেটা কোন উচ্চতর বুদ্ধিমত্তার মহাজাগতিক প্রাণীর কাছ থেকেও আসেনি? বরং এর প্রতিটি আয়াত অপরিবর্তিত ভাবে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর একমাত্র স্রষ্টার কাছ থেকে এসেছে?
আপনি যদি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন যে কু’রআনের প্রত্যেকটি আয়াত স্বয়ং আল্লাহর বাণী এবং সেটা গত ১৪০০ বছরে কোন পরিবর্তন না হয়ে আমাদের কাছে এসেছে, তাহলে আপনি কি মনে প্রাণে মানেন যে, নিচের আয়াতগুলো স্বয়ং আল্লাহর বাণী - যিনি আপনার একমাত্র প্রভু এবং আপনাকে উদ্দেশ্য করেই তিনি কু’রআনে বলেছেনঃ
আমিই আল্লাহ। আমি ছাড়া উপাসনার যোগ্য আর কোন প্রভু নেই। সেজন্য আমার দাসত্ব কর এবং নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে নামায পড়, যাতে করে আমাকে সবসময় মনে রাখতে পারো। [ত’হা ২০:১৪]
নামাযগুলোর ব্যপারে বিশেষ সতর্ক থাকো, আর মধ্যমপন্থায় নামায পড়।আর আল্লাহর সামনে অত্যন্ত ভক্তি নিয়ে দাঁড়াও।[বাকারাহ ২:২৩৮]
এই কিতাবে যা প্রকাশ করা হয়েছে সেটা পড়। নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে নামায পড়। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখে।[আল-আনকাবুত ২৯:৪৫]
নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে নামায পড়, যাকাত দাও এবং রাসুলকে অনুসরণ কর, যাতে করে তোমরা আমার অনুগ্রহ পেতে পারো।[আন-নুর ২৪:৫৬]
নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দান কর এবং তাদের সাথে নত হও (রুকু কর) যারা নত হয়।[বাকারাহ ২:৪৩]
এখন আপনার অবস্থা নিচের চারটির যেকোন একটি হতে পারেঃ
১) আপনি বিশ্বাসই করেন না যে কু’রআনের এই আয়াতগুলো আপনার মহান প্রভু স্বয়ং আল্লাহর বাণী। সুতরাং আপনার কাছে কু’রআনের কোন কিছু মানার কোন কারণ নেই।
২) আপনি বিশ্বাস করেন যে এগুলো ঠিকই স্বয়ং আল্লাহর বাণী, যিনি আপনার, আমার, সবার একমাত্র প্রভু এবং তিনি নিজে আপনাকে সরাসরি এই আদেশগুলো দিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে আপনি তাঁর আদেশ মানবেন না।
৩) আপনি খুব ভালো করে জানেন যে এগুলো আপনার মহান প্রভুর বাণী, কিন্তু আপনি নিজেকে বুঝিয়েছেন যে আসলে আপনি একজন অলস মানুষ এবং শুধু অলসতার জন্যই আপনি নামায পড়েন না, এর বেশি কিছু না। প্রত্যেকটা দিন নামায পড়তে হবে? দিনে পাঁচ বার! তাও আবার সপ্তাহে সাত দিন!! অসম্ভব। এতো কঠিন কাজ আপনাকে দিয়ে হবে না। আপনি আসলে একটু ফাঁকিবাজ টাইপের মানুষ।
৪) আপনি মনে করেন যে আপনার কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আপনি মানুষের অনেক বড় উপকার করছেন। আপনার কাজ ঠিকমত না হলে আপনার, আপনার পরিবারের, মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে। আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনার গুরু দায়িত্বর কথা বুঝবেন। তাই কাজের ব্যস্ততার জন্য যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে না পারেন, তাহলে আল্লাহ আপনাকে মাফ করে দিবেন।
এখন আপনার অবস্থা যদি (১) হয় যে, আপনি বিশ্বাসই করেন না কু’রআন স্বয়ং আল্লাহর বাণী এবং কু’রআনে একবার নয়, দুইবার নয়, মোট ৮২ বার আল্লাহ নামায পড়তে বলেছেন এবং আপনি মনে করেন সেগুলোর সবগুলোই বাজে কথা, মানুষের বানানো, তাহলে আমার বেশি কিছু বলার নেই। আপনি প্রথমে মুসলিম হন, তারপরে আপনাকে নামাযের কথা বলব। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি মুসলিম না হচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার নাম আব্দুল্লাহ, মুহাম্মাদ, ফাতিমা, আয়েশা যাই হোক না কেন, আপনি এখনও ইসলাম ধর্মের ভেতরেই আসেন নি। আপনার নামের মধ্যে শুধুই কিছু আরবি শব্দ আছে, এই পর্যন্তই।
কিন্তু আপনার অবস্থা যদি (২) হয় – যেখানে আপনি খুব ভালো করে জানেন কু’রআন আল্লাহর বাণী এবং কু’রআনে আল্লাহ আপনাকে নিয়মিত নামায পড়ার আদেশ করেছেন, কিন্তু তারপরেও আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনি তাঁর কথা শুনবেন না এবং নিয়মিত নামায পড়বেন না, তাহলে আপনার সাথে একজন কাফিরের কোন পার্থক্য নেই। কাফির শব্দটির আভিধানিক অর্থ – অস্বীকারকারি, অকৃতজ্ঞ, যে ঢেকে রাখে। কু’রআনের ভাষায় যারা কু’রআন আল্লাহর বাণী সেটা খুব ভালো করে জানার পরেও জেনে শুনে আল্লাহর আদেশ না মানার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে – তারা কাফির।
আমরা অনেকে মনে করি আমাদের পাশের বাসার রামকৃষ্ণ বাবু একজন কাফির। পাশের গলির চার্চের পাদ্রী সাহেব একজন কাফির। বুশ কাফির, ওবামা কাফির। আমাদের ধারণা – অমুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে কোন আরবি শব্দ ছাড়া নাম হলেই সন্তানরা স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাফির হয়ে যায়। একইভাবে আমরা অনেকে মনে করি আমার বাবা-মা যেহেতু একজন মুসলিম, সুতরাং আমিও একজন মুসলিম কারণ আমার নামের মধ্যে কিছু আরবি শব্দ আছে। আমি ইসলামের মুল ভিত্তিগুলো মানি আর না মানি, তাতে কিছু যায় আসে না। না, আপনি ভুল জানেন। একজন মানুষ কাফির তখনি হয় যখন সে খুব ভালো করে জানে যে কু’রআন আল্লাহর বাণী, তার কাছে কু’রআন নির্ভরযোগ্য ভাবে পৌঁছেছে, কিন্তু তারপরেও সে জেনে শুনে কু’রআনে দেওয়া আল্লাহর আদেশ না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনার প্রতিবেশি রামকৃষ্ণ বাবুকে যদি কেউ কু’রআন পৌঁছে না দেয়, তাকে ভালভাবে ইসলাম কি সেটা বোঝানো না হয়, তাহলে সে যদি ইসলাম মেনে না চলে তখন সে কাফির নয়। সে মুশরিক হতে পারে, কিন্তু কাফির নয়। বরং আপনারই বাবা-মা কাফির হতে পারেন, যদি তারা জেনে শুনে নামায না পড়েন। আপনার নিজের আপন ভাই-বোন কাফির হতে পারেন, যদি তারা জেনে শুনে নামায না পড়েন। আপনি নিজেও একজন কাফির হতে পারেন, যদি আপনি জেনে শুনে নামায না পড়েন। নামায না পড়লে যে একজন মুসলমান কাফির হয়ে যায়, এই ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। আপনার কাছে ‘কাফির’ উপাধিটা শুনতে যতই খারাপ লাগুক, মানতে যতই কষ্ট হোক না কেন, যারা নামায পড়ে না তারা কাফির, সে আপনার যত কাছের মানুষই হোক না কেন।
আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন – আপনার কাছে কু’রআন কি নির্ভরযোগ্য ভাবে পৌঁছেছে? আপনি কি নিশ্চিত ভাবে জানেন কু’রআন আল্লাহর বাণী? আপনি নিজের চোখে পড়েছেন অথবা নিজের কানে শুনেছেন যে কু’রআনে আল্লাহ আপনাকে বহুবার নামায পড়তে বলেছেন? যদি এগুলোর উত্তর হ্যা হয় এবং তারপরেও আপনি নামায না পড়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আপনি কাফিরদের দলে পড়েন। কাফিরদের সাথে আল্লাহ যা করবেন, আপনার সাথেও আল্লাহ তাই করবেন। সেটা যে কত ভয়ংকর হবে তা কু’রআন পড়ে নিজেকে আরেকবার মনে করিয়ে দিন -
সেদিন জান্নাতের অধিবাসীরা একে অন্যকে অপরাধীদের ব্যাপারে জিগ্যেস করবে। তারা জিগ্যেস করবে (জাহান্নামিদেরকে), “কে তোমাদেরকে গনগনে আগুনে নিয়ে গেল?” ওরা বলবে, “আমরা নামায পড়তাম না”। [আল-মুদ্দাসির ৭৪:৪৩]
যে জাতি নামায পড়া ছেড়ে দিবে, সেই পুরো জাতিকে আল্লাহ চরম শাস্তি দিবেনঃ
কিন্তু তারপর তাদের পরে কিছু জাতি এসেছিল যারা নামাযকে হারিয়ে ফেলেছিল এবং নিজেদের কামনা-বাসনায় ডুবে ছিল। এরা শীঘ্রই তাদের পাপের পরিণতির মুখোমুখি হবে। [মরিয়ম ১৯:৫৯]
সুতরাং চেষ্টা করুন নিজেকে, আপনার বাবা-মাকে, ভাই-বোনকে বোঝাতে যেন তারা জেনে শুনে আল্লাহর আদেশ না মেনে নিজের এতো বড় সর্বনাশ ডেকে না আনে। তারা যেন কিয়ামতের দিন জাহান্নামের গনগনে আগুনের মধ্যে জ্বলে পুড়ে আকুল ভাবে না বলেঃ
“আমরা নামায পড়তাম না”। [আল-মুদ্দাসির ৭৪:৪৩]
আর আপনার অবস্থা যদি (৩) হয়, তাহলে আপনি নিজেকে self-delusion এর মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন এই ভেবে যে আপনি আসলে একটু অলস টাইপের দেখেই নামায পড়েন না, এর বেশি কিছু না। আপনি রাত জেগে মুভি দেখতে পারেন, কিন্তু নামায পড়তে পারেন না। আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মার্কেটে বেহুদা ঘুরতে পারেন, কিন্তু দশ মিনিট দাঁড়িয়ে নামায পড়তে পারেন না। আপনি প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের সাথে ফোনে কথা বলতে পারেন, কিন্তু আধা ঘণ্টা আল্লাহর সাথে কথা বলার সময় করতে পারেন না। আপনি দিনে কয়েক ঘণ্টা আপনার ছেলে মেয়ের খাওয়া, গোসল, ঘুম, স্কুল, হোম ওয়ার্ক এসবের পিছনে ব্যয় করতে পারেন, কিন্তু আধা ঘণ্টা আপনার মালিক, আপনার একমাত্র প্রভুর জন্য ব্যয় করতে পারেন না। নিজের সাথে প্রতারণা করার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না।
“The human brain is a complex organ with the wonderful power of enabling man to find reasons for continuing to believe whatever it is that he wants to believe.” – Voltaire
সাইকোলজির ভাষায় আপনার এই অবস্থাকে বলা হয় self-dellusion – নিজেকেই নিজে ভুল বুঝিয়ে ধোঁকা দেওয়া। মানুষকে কোন অনুশোচনার সুযোগ না দিয়ে, দিনের পর দিন একই অন্যায় বারবার করানোর জন্য শয়তানের এক চমৎকার পদ্ধতি হচ্ছে সেলফ ডিলিউসন। আপনি মাঝে মাঝেই দেখবেন আপনার নামায পড়ার কথা মনে হয়, হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় যে নামায ফাঁকি দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তখনি দেখবেন আপনার ভেতরে একটা কণ্ঠস্বর আপনাকে বলছে, কিন্তু আমি তো এর আগের ওয়াক্তের নামাযটা পড়িনি, এখন এই ওয়াক্ত পড়ে কি হবে? এখনও তো অনেক সময় আছে ওয়াক্ত শেষ হবার, কাজটা শেষ করেই তো নামায পড়া যাবে? আমি এখন রান্না না করলে তো কেউ খেতে পারবে না, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার অবস্থা বুঝবে? আমার মেহমানকে বসিয়ে রেখে কিভাবে নামায পড়তে উঠে যাই? তারচেয়ে রাতে একবারে সবগুলো নামায একসাথে পড়ে নিব। এগুলো হচ্ছে শয়তানের কণ্ঠস্বর। যত তাড়াতাড়ি পারুন বোঝার চেষ্টা করুন আপনার ভেতরে যে চিন্তার এক কণ্ঠস্বর আছে সেটা কখন আপনি, আর কখন সেটা শয়তান।
যারা মানুষের সরাসরি উপকার করে – ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সমাজসেবকরা হচ্ছেন (৪) নম্বর অবস্থার সুন্দর উদাহরণ। যেমন, ডাক্তাররা মনে করে – আমি একজন ডাক্তার! আমি মানুষের জীবন বাঁচাই! মানুষের এতো বড় একটা সেবার জন্য আল্লাহ আমাকে নামায, রোযার হিসাব থেকে মাফ করে দিবেন না? আল্লাহ কি এতই অবিবেচক? প্রথমত, যদি ডাক্তাররা এতই মহান হতেন, তাহলে তারা কখনও তাদের কাজের জন্য বেতন নিতেন না। বিনা খরচে মানুষের চিকিৎসা করতেন। তারা কখনও মামা-চাচা-খালু ধরে অন্যায়ভাবে ঢাকায় পোস্টিং নিয়ে পার্টটাইম প্রাইভেট ক্লিনিকে কাজ করতেন না, বরং দূরের কোন গ্রামের অভাবী, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসায় নিজেই পোস্টিং নিয়ে ছুটে যেতেন। ডাক্তাররা যখন তাদের কাজের জন্য বেতন নিচ্ছেন, তখন তারা একজন বেতন ভুক্ত কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নন। তারাও মানুষের উপকার করছেন, আবার একজন সুইপারও মানুষের উপকার করছেন। সুইপাররা না থাকলে লক্ষ লক্ষ মানুষ অসুস্থ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতো। আপনি যত বড় ডাক্তার হন, যত বড় দানশীল ব্যবসায়ী হন, যত বড় শিক্ষক হন, আপনি কোন মানুষের জীবন বাঁচান না; আল্লাহ মানুষের জীবন বাঁচান। আপনি কোন মানুষকে ইসলামের পথে আনেন না; আল্লাহ যাকে চান তাকে তিনি তাঁর ধর্ম মেনে চলার সন্মান দেন। পৃথিবীতে কেউ নেই যার কাজ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সে নামায না পড়লে বা রোযা না রাখলে আল্লাহ তাকে তার কাজের গুরুত্বর জন্য নামাযের হিসাব ছেড়ে দিবেন। যদি তাই হতো, তাহলে কোনো নবীর(আ) নামায পড়ার দরকার হতো না, রোযা রাখার প্রয়োজন হতো না এবং কাফিরদের সাথে যুদ্ধের সময় নামায পড়ার দরকার হতো না।
তাদের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিশ্চয়ই আপনি করছেন না?
(আল্লাহর কাছে) সাহায্য চাও ধৈর্য এবং নামাযের মাধ্যমে, তবে এটা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ, কিন্তু বিনয়ীদের জন্য তা কঠিন নয়, যারা জানে যে তারা একদিন তাদের প্রভুর সাথে দেখা করবে এবং তাঁর কাছেই তাদেরকে ফেরত যেতে হবে। [বাকারাহ ২:৪৫-৪৬]
বিষয়: বিবিধ
১৫০৭ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুব সুন্দর ও সহজভাবে অত্যন্ত বাস্তব অবস্থাই তুলে ধরেছেন। আপনার পুরো ব্লগটি খুব মনোযোগ সহকারে পড়েছি। প্রিয়তে রাখলাম। সময় সুযোগে আবার পড়বো। অনেক সুন্দর লিখেছেন। প্রথম লেখাতেই আপনার যোত্যতা ও জ্ঞানে মাহারত বুঝতে পারছি। আল্লাহ আপনার কলমের এই ক্ষুরধার লেখনি শক্তিতে আরো বরকত দান করুক।
মুসা ভাই, এটা কিন্তু আমার প্রথম লেখা নয়। আমি সোনার বাংলাদেশ ব্লগের একজন প্রাচীন ব্লগার।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন