জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো! ৯০ বছরে ‘দাদুর খাবার’, কতো অজানারে.....।
লিখেছেন লিখেছেন নানা ভাই ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০৩:২৫:১৮ রাত
‘এখনকার দিনোত মাগনা খাওয়া যায়, এইট্যা জানা আছলো না।’ ‘দাদুর খাবার’ খেতে আসা রঞ্জন কুমার দাস বললেন এমন কথা।
কিন্তু রঞ্জন কুমার দাস হয়তো জানেন না, এর পেছনে রয়েছে ৯০ বছরের ইতিহাস। এ ইতিহাসের শুরু হয় জমিদার মদনমোহন পালের হাত ধরে।
ক্ষুধার্ত মানুষের বিষণ্ণ চেহারা সহ্য করতে পারতেন না জমিদার মদনমোহন পাল। প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট বুঝতেন। এজন্য প্রতিদিন ২০ জন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাইয়ে তারপর নিজে খেতে বসতেন। তার এই পরার্থপরায়ণতার প্রমাণ রেখে চলেছেন তার উত্তরাধিকারীরা।
৯০ বছর আগের কথা। ভারতে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ঢাকার অবস্থাও ভালো ছিল না। মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছিল। পরে সেই খাদ্যসংকট দুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। খাদ্যসংকটের শুরুতেই ক্ষুধার্ত মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে পাশে দাঁড়ান কয়েকজন ব্যক্তি। তারা জমিদার মদন মোহন পালের উত্তরাধিকারী। তাদের উদ্যোগেই অনাহারীদের জন্য প্রতিদিন একবার খাবারের ব্যবস্থা করা হয় মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্টে।
জমিদারের উত্তরাধিকারীরা বিশ্বাস করতেন, ‘জীবেই শিব’। মানুষের সেবা করলে, মানুষকে ভালোবাসলেই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। এই বিশ্বাসকে ধারণ করে ১৯২৪ সাল থেকে মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্টের যাত্রা শুরু। এখন তা ৯০ বছরের ইতিহাস।
এই ট্রাস্ট্র আজ অবধি অসহায়, দরিদ্র ও অনাহারী মানুষের মুখে বিনা মূল্যে এক বেলা করে খাবার তুলে দিচ্ছে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে অনাহারী মানুষের কাছে এই ট্রাস্টের খাবার ‘দাদুর খাবার’ নামে পরিচিত। কারণ, খেতে আসা মানুষ খাবার বিতরণকারীদের ‘দাদু’ বলে ডাকে। প্রতিদিন গড়ে ১০১ জনকে এখানে খাওয়ানো হয়। পুরান ঢাকার নবাবপুর সড়কের ১০৯ নম্বরে বাড়িতে মদনমোহন পাল অন্নছত্র ট্রাস্ট অবস্থিত। বাড়িটি ছিল মদনমোহন পালের, যা তখন জমিদারবাড়ি বলে পরিচিত ছিল।
প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকেই খাওয়ানো শুরু হয়। খেতে আসা মানুষদের জমিদারবাড়ির পুরোনো ভবনের মেঝেতে ইউ আকৃতি করে বসানো হয়। দুপুর ১টার আগে খাওয়ানো শেষ হয় ।
খাবার মেন্যুতে থাকে সাদা ভাত, পাঁচ ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি নিরামিষ ও ডাল। এখানে প্রতি মাসে একাদশীতে (চাঁদের একাদশ দিন) এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উপলক্ষে খাবার বন্ধ রাখা হয়।
অনেকের সঙ্গে অন্নছত্রে খেয়েছেন রুবেল মিয়া ও রঞ্জন কুমার দাস। রুবেলের বাড়ি বরিশাল। থাকেন রাজধানীর ফুটপাতে। তিনি শ্রমিক। প্রায়ই মদনমোহন অন্নছত্রে এসে খেয়ে যান। কাজ না পেলে সকালে অনেক দিনই খাওয়া হয় না তার। সে দিনগুলোতে ১০টা বাজলেই ছুটে যান অন্নছত্রে।
তবে পঞ্চাশোর্ধ রঞ্জন কুমার দাস এসেছেন প্রথম। ক্ষুধার জ্বালায় পেট চোঁ-চোঁ করছিল। পল্টন এলাকায় এক ব্যবসায়ীর কাছে খাবার খুঁজছিলেন তিনি। ওই ব্যবসায়ীই তাকে এখানে পাঠিয়ে দেন।
খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত রঞ্জন কুমার দাস বলেন, এখনকার দিনোত মাগনা খাওয়া যায়, এইট্যা জানা আছলো না।’ রঞ্জন কুমার দাস জানান, ‘কোতাও এমুন ফিরি খাওন নাই।’
এদিকে জানা গেছে, সনাতন ধর্মমতের কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে খেতে গেলেও নির্ধারিত টাকা দিয়ে টোকেন কিনতে হয়। এদিক থেকেই মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট অনন্য। এই সময়ে এ ধরনের ইতিহাস বিরল।
এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা সেবার মানসিকতা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। অনেক সময় খাবার শেষ হয়ে গেলেও অন্নছত্রের সেবকরা অনাহারী আগন্তুককে হতাশ করেন না।
মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্টের ব্যবস্থাপক হিসেবে ৩০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য। তিনি জানান, বেশ কিছুদিন আগে ময়লা শার্ট, ছেঁড়া লুঙ্গি পরিহিত এক অনাহারী ব্যক্তি এখানে আসেন। ক্ষুধার কারণে মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি ভালোভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। পেটে হাত দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেন তিনি ক্ষুধায় কাতর। কিন্তু প্রায় দুই ঘণ্টা আগে অন্নছত্রের খাওয়ানো শেষ হয়েছে। সেবকদের খাওয়াও শেষ। বাকি ছিলেন ব্যবস্থাপক পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য। হাঁড়িতে রাখা তার নিজের খাবার তিনি তখন ওই অনাহারীকে দিয়ে দেন। খাওয়া শেষে তৃপ্তি প্রকাশ করে ওই ব্যক্তি জানান, অনেক দিন পর তিনি পেট পুরে খেয়েছেন।
পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য জানান, অন্নছত্রে প্রতি মাসে খাবার ও ব্যবস্থাপনা বাবদ সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা খরচ হয়। মদনমোহন অন্নছত্রে কর্মরত মৌলভীবাজার জেলার শিবুল চক্রবর্তী জানান, সামান্য বেতনে এখানে কাজ করেন তিনি। তিনি এটাকে চাকরি নয়, সেবা মনে করেন। অসহায়, দরিদ্র মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্যই পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন তিনি। অন্নছত্রে কর্মরত আছেন এ রকম আরো আটজন।
১৯২৪ সালে জমিদার মদনমোহন পালের দুই পুত্র রজনীকান্ত পাল, মোড়লি মোহন পাল ও ভাইপো প্রিয়নাথ পাল গঠন করেন ‘মদন মোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট এস্টেট’। তারা তাদের বিপুল সম্পত্তির একটি অংশ ওই ট্রাস্টের নামে দিয়ে যান। আদালতের মাধ্যমে উইল করে দেন। এতে উল্লেখ করেন, অন্নছত্র ট্রাস্টের কার্যক্রম ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এর প্রধান থাকবেন মদনমোহন পালের বংশের যেকোনো একজন।
বর্তমানে ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জমিদারের উত্তরাধিকারী দীপক কুমার পাল, সহকারী প্রধান নির্বাহী তপন কুমার পাল ও নির্বাহী সদস্য হিসেবে রয়েছেন মিন্টু রঞ্জন পাল। তাদের উদ্দেশ্য, অন্নছত্রের সেবার মান বৃদ্ধি ও অধিকসংখ্যক লোকের অন্নের ব্যবস্থা করা।
এই ট্রাস্টের উদ্যোগে আশ্রয়হীনদের জন্যই ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে ২ নম্বর ওয়াইজঘাটের তিনটি বাড়িতে নির্মাণ করা হয় ‘অন্নছত্র কাটরা’।
ঢাকা সিটি করপোরেশন এসব মহান কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নবাবপুরে মদমমোহনের বাড়ির পাশের রাস্তার নামকরণ করেছে মদনমোহন লেন।
এ ছাড়া নিজ বাড়িতে মদনমোহন পাল শ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জিউ ঠাকুর বিগ্রহ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। জমিদার মদনমোহন পালের আরাধ্য দেবতা ছিলেন কৃষ্ণ। সে হিসেবে ১৩০০ বঙ্গাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এ দেবালয়ের নামে অনেক সম্পত্তি দান করেন মদনমোহন পাল।
বর্তমানে এই ট্রাস্টের আয়ের উৎস হচ্ছে নবাবপুর, পাটুয়াটুলী, সিদ্দিকবাজার এলাকার নয়টি মার্কেটের ভাড়া। এসব মার্কেটের দোকানের ভাড়াটিয়ারা সেই পুরোনো নিয়মে ভাড়া পরিশোধ করছেন। অনেক সময় ন্যায্য পাওনা আদায় ও মার্কেট বা দোকান দখলমুক্ত করতে গিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষকে। ফলে অনেকটা ধুঁকে ধুঁকে চলছে সেবামূলক এই ট্রাস্ট।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১১৪৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন