সময় ব্যবস্থাপনা,এবং শিশুর প্রতি তার কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উপদেশ ।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান বিন ফয়েজ ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:১৯:২৯ দুপুর
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব গুহ তাঁর “মাধুকরী” উপন্যাসে নায়ক চরিত্র (পৃথু) বাবা তার সন্তান (টুসু) কে ঘুড়িখেলা করতে গিয়ে ঘুড়িটা কেটে যাওয়ায় মন খারাপ করে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাবাত হাত ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে , এ অবস্থায় পিতা (পৃথু) ছেলেকে উপদেশ দেওয়ার ছলে মনে মনে মানব জীবনের নিগুড় রহস্য, প্রতিযোগিতা, জীবনের লক্ষ্য, জীবনের প্রস্তুতি ও জীবনের অর্জন সম্পর্কে এককথায় জীবিন সর্ম্পকে অসাধারন উপলব্ধিবোধ তুলে ধরেছেন তাঁর উপন্যাসে ,......
‘বেচারি টুসু এখনো জানে না , মানুষ হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে এই সংসারে, তখন সারা জীবনে কত অসংখ্য ঘুড়িই যে কেটে যাবে ওর চোখের সামনে । কত সুন্দর স্বপ্নের সব ঘুড়ি, সাধের ঘুড়ি, প্রেমের ঘুড়ি, হয়ত সততা এবং বিশ্বস্ততার ঘুড়িও। কোন ঘুড়ির সুতো থাকবে তার নিজের হাতে, কোনোটায় নিজে মাঞ্জা দেবে কিন্তু প্রায়ই সবসময়ই অপরপক্ষের ক্ষুরধার মাঞ্জার ভার এবং ধারে কচ করে কেটে যাবে তার সব ঘুড়ি । বেচারি তো শুধু লাইফ-সায়ান্সেই খারাপ নাম্বর পেয়েছে । তবুও প্রথম হবে স্কুলের পরীক্ষাতে । স্কুল- কলেজের পরীক্ষা তো ছেলেখেলা ! পৃথু মনে মনে বলল, ওরে আমার ছোট্ট, বোকা ছেলে, তোমাকে এসব ছেলেখেলাতে যে পাশ করতেই হবে । এসব তো চৌকাঠ । এখনো তো আসল পরিক্ষাই বাকি । জীবনের পরীক্ষা। প্রত্যেকটি দিন প্রত্যেকটি সম্পর্কই তো একটি পরিক্ষা। ‘দ্যা ব্যাটল অফ লাইফ’ । দ্যা ব্যাটল ইজ ইয়েট টু বিগিন । আজ তোর লাইফ সায়ান্সি ভালো লাগছে না শুধু ।জীবনে পৌঁছে দেখতে পাবি বাবা যে, তোর কিছুই ভালো লাগছে না। জীবিকার জন্যে শতকরা নিরানব্বই জন মানুষ যা করে, তা করতে ভালো লাগেনা তাদের কারোই । তবুও করতে হবে। সকাল থেকে রাত, দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর, যৌবন থেকে মৃত্যুদিন অবধি। কী করবি বাবা! নিঃশ্বাস ফেলবি, প্রশ্বাস নিবি; কিন্তু বাঁচা কাকে বলে তা জানতে পারার আগেই মরে যাবি।
কখনো বা হয়ত ভাববি, ভালো চাকরি করা আর ভালোভাবে বেচেঁ থাকা বুঝি সমার্থক। কখনো বা ভাববি, গাড়ি চড়া, কোম্পানির ডিরেক্টর হওয়া, সমাজে পরিচিত হওয়াই বুঝি বাঁচারই সমার্থক। আবার কখনো বা ভাববি নাম,যশ,খ্যাতি, কীর্তি, স্ট্যাচু, নিজের নামে রাস্তা এসবও প্রচন্ডভাবে বাঁচার সমার্থক।
না করে টুসু, আমার সোনা ছেলে; সে সবও নয়। বেঁচে থাকার মানে এক একজন মানুষের ব্যক্তিগত অভিধানে এক একরকম। তা-ই তো মানুষ আমরা। বিধাতার হাতে-গড়া শ্রেষ্ঠ জীব!
তোর মাকে একদিন আদর করেছিলাম। কোনো দেবদুর্লভ সুগন্ধিক্ষণে তোর আরম্ভ হওয়া শুরু হয়েছিল । তখন তুই ছিলি তোর মায়ের চোখের তারায়, তার সপ্নে, আমার কাজের অবকাশের ফাঁকাটুকু ভরে অথবা বনপথে, একলা-চলার ভাবনায়। তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা আরম্ভ করাটুকুই শুধু তোর বাবা-মায়ের হাতে ছিল রে। শুধু ঐটুকুই। এত বড় পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তুই কেমন মানুষ হবি না হবি, তা শুধুমাত্র তোরি ব্যাপার । একমাত্রই তোরই ব্যাপার। আজকের দুটি নরম হাত, যে দুটি হাতে তুই আমার ডান হাত আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছিস ভাবছিস; তোর বাঘ-মারা বাবা তোকে চিরদিন এই পৃথিবীর সব ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচাতে পারবে, আজকে তোর সেই দুটি নরম হাত দিয়েই, তোর মস্তিষ্ক দিয়ে, তোর বিবেক, তোর স্বাতন্ত্র্য দিয়ে তৈরি করতে হবে তিল তিল করে নিজেকে। সব শিক্ষারই দুটি দিক থাকবে টুসু-বাবা । কোনো স্কুল, কোন কলেজ, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তোকে ‘শিক্ষিত’ করতে পারবে না, যদি না তোর মধ্যে যে অদৃশ্য কিন্তু প্রচন্ডভাবে সক্রিয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আছে, তাকে তুই কাজে না-লাগাস। পৃথিবীতে, সত্যিকারের বড় যাঁরা হন, তোর বাবার মতো ইউজলেস নন-এনটিটি মানুষ নন, যাঁরা যথার্থই বড়; তাঁরা সবাই-ই এই ভিতরের শিক্ষার জোরেই এতখানি পথ পেরিয়ে এসেছেন অন্যদের পিছনে ফেলে পেরিয়ে আসেন। একা একা । যেকোনো দৌঁড়েই যে প্রথম হয় সে একাই আগে থাকে। তার সামনে বা পাশে কেউই নয়।
ঘুমিয়ে নে বাবা। আরামে ঘুমিয়ে নে। সারাটা জীবন জাগতে হবে তোকে। মানুষের মতো মানুষ হতে হলে, ঘুমের সঙ্গে, আরামের সঙ্গে, সাধারণ্যের সঙ্গে, তোকে আড়ি করতেই হবে। দলে-বলে কেউ কখনো বড় হয়নি রে। পৃথিবীর মানুষের ইতিহাস অন্তত তাই-ই বলে। অনেক রাত জাগা আর অনেক হাঁটার জন্যে তৈরি হ বাবা । তোর বাবা যা পারেনি, পারল না এ জীবনে, তুই যেন তা পারিস। এই –ই আশীর্বাদ করি তোকে , আমি; তোর অপদার্থ বাবা !
গ্রিক দার্শ্নিক Maslow’s সাফল্য লাভের জন্য মানসিকতা কেমন থাকা উচিত-সে ব্যপারে তিনি বলেছেন-
Fix your aim, start work, get busy with your works in such a way that your life and death depend on this. If you succeed, you will live. If you fail you will die. You will see god’s blessings showing on you.
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- ‘সাবধান, তোমরা অপচয় করো না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। রাসূলে কারিম (সঃ) বলেছেন, তোমরা অপব্যয় করো না, অপব্যয়কারী আল্লাহর অভিশপ্ত’। অপচয় ও অপব্যয় শুধু অর্থসংক্রান্ত বিষয় নয়। মানবজীবনের মূল্যবান সম্পদ ‘সময়’ সম্পর্কেও বানীটি প্রযোজ্য হবে । এটা সময় ব্যবহারের এক্ষেত্রেও সতর্ক বানী ।
ওমর ইবনে আব্দুল আজিজকে (রঃ) কিছু কাজ আগামী দিনের জন্য রেখে দেওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি তো ইতোমধ্যে একদিনের কাজ করেই ক্লান্ত, তাহলে আগামীকাল দ’দিনের কাজ করতে হলে কি অবস্থা হবে ?
ইবনে আতার (রঃ) একটি জ্ঞানগর্ভ উক্তি হচ্ছে অনেক কাজ আছে যেগুলো করার প্রচুর সময় থাকে, সেই সময়ের মধ্যে এগুলো করে ফেলা যায়। কিন্তু এমন কাজও থাকে যা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে না করলে আর করা হয় না’ ।
ইব্রাহিম (আ) এর উম্মতের সময় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবী আবুযর (রা) প্রশ্নোত্তরে রাসূল (সঃ) বলেছেন,
‘বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য হলো তার সময়কে ভাগ করে নেওয়া। কিছু সময় সে ব্যয় করবে তার প্রভুর কাছে প্রার্থনায়। কিছু সময় ব্যয় করবে আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল বিষয়ে চিন্তা করে । কিছু সময় রাখবে আত্মসমীক্ষার জন্য । আর কিছু সময় ব্যয় করবে জীবিকার প্রয়োজনে’।
বিষয়: বিবিধ
১৪৭৯ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো অনেক।
"বেচারি টুসু এখনো জানে না , মানুষ হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে এই সংসারে, তখন সারা জীবনে কত অসংখ্য ঘুড়িই যে কেটে যাবে ওর চোখের সামনে । কত সুন্দর স্বপ্নের সব ঘুড়ি, সাধের ঘুড়ি, প্রেমের ঘুড়ি, হয়ত সততা এবং বিশ্বস্ততার ঘুড়িও। কোন ঘুড়ির সুতো থাকবে তার নিজের হাতে, কোনোটায় নিজে মাঞ্জা দেবে কিন্তু প্রায়ই সবসময়ই অপরপক্ষের ক্ষুরধার মাঞ্জার ভার এবং ধারে কচ করে কেটে যাবে তার সব ঘুড়ি "- খুব ভালো লেগেছে এবং চিন্তার কিছু খোরাক দিয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর লিখাটির জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
‘বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্তব্য হলো তার সময়কে ভাগ করে নেওয়া। কিছু সময় সে ব্যয় করবে তার প্রভুর কাছে প্রার্থনায়। কিছু সময় ব্যয় করবে আল্লাহর সৃষ্টি কৌশল বিষয়ে চিন্তা করে । কিছু সময় রাখবে আত্মসমীক্ষার জন্য । আর কিছু সময় ব্যয় করবে জীবিকার প্রয়োজনে’।
এর উপরে আর কথা বলার কোন সুযোগ থাকেনা। সুন্দর পোষ্ট, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও উদৃতি আপনার পোষ্টকে অনেক আকর্ষনীয় করেছে। অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন