গল্পঃ পরম প্রতিদান: পর্ব-১
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান বিন আনোয়ার ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ০৩:২৭:৫৪ দুপুর
জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনে নিজেদের পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছেন দুই যাত্রী। সদ্যই নিজেদের হজ্বব্রত পালন শেষে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবেন তারা। ক্লান্তিকর অপেক্ষার জট কাটাতে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলেন দুজন। প্রথমজন নিজের পরিচয় দিলেন, আমি একজন কন্ট্রাক্টর। এ নিয়ে দশমবারের মত হজ্ব পালন করেছি। আপনার পরিচয়?
দ্বিতীয়জন - নিজেকে সাঈদ পরিচয় দিয়ে প্রথমজনকে অভিনন্দন জানালেন। বললেন, আল্লাহ আপনার হজ্ব কবুল করুক। আপনার সকল প্রচেষ্টার উত্তম বিনিময় লাভ হোক। আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিন।
প্রসন্ন হাসি হেসে সঙ্গীর দোয়াটুকু গ্রহণ করলেন প্রথম ব্যক্তি। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এর আগে হজ্ব করেছেন?
দ্বিধাজড়িত কন্ঠে সাঈদ বললেন, আসলে আমার এই হজ্ব পালনের পেছনে একটি দীর্ঘ গল্প আছে। অযথা আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না সেসব বলে।
দরাজ কন্ঠে প্রথম হাজী বললেন, কী যে বলেন ভাই! আমরা তো এমনিতেই এই মুহূর্তে কিছু করছি না। শুধু অপেক্ষাই করতে হচ্ছে। তারচেয়ে বরং আপনার গল্প শুনে আমাদের প্রতীক্ষা মধুর করে তুলি!
দু'ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটল সাঈদের। বললেন, এই "প্রতীক্ষা"র বিবরণ নিয়েই মূলত আমার গল্প। দীর্ঘকাল অপেক্ষা শেষে আমি এ বছর হজ্ব পালনে সক্ষম হয়েছি। গত তিরিশ বছর ধরে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে 'ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট' হিসেবে কাজ করছি আমি। আমার বেতন-ভাতা ও অন্যান্য পারিশ্রমিক থেকে জমিয়ে হজ্বের ব্যয় জোগাড়ে সক্ষম হয়েছিলাম এবার। যেদিন হাসপাতালের একাউন্ট থেকে আমার জমানো অর্থ উত্তোলন করেছি, সেদিনই এক রোগীর মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হল। তার চেহারায় ভয়ের ছাপ। শঙ্কায় চোয়াল ঝুলে পড়েছে। আমাকে বলল, স্যার, সম্ভবত আজকেই আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা! আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু করুক।
আমি তার কথায় আশ্চর্য হলাম। ভাবলাম, আমার চিকিৎসায় তিনি বুঝি সন্তুষ্ট নন। ছেলেকে অন্য কোন হাসপাতালে নিতে চাচ্ছেন।
আমার ভাবনা বুঝেই কিনা, তিনি নিজ থেকে আবার বললেন, ভুল বুঝবেন না ডক্টর! আল্লাহ জানেন আপনার চিকিৎসা আমার ছেলের জন্য কতটা কাজে দিয়েছে। আপনি তাকে নিজ সন্তানের মত সেবা দিয়েছেন। আমরা তো তার (ছেলে) ব্যাপারে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। অথচ এখন সে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করেছে।...
ডক্টর সাঈদের কথার মাঝখানে অপর হাজী বলে উঠলেন, অদ্ভুত ব্যাপার! তারা যদি এতই সন্তুষ্ট থেকে থাকে আপনার চিকিৎসায়, তাহলে ছেলেকে নিয়ে অন্যত্র যাত্রা করছে কেন?
প্রশ্নের জবাবে সাঈদ আবারো শুরু করলেন। বললেন, হ্যা, প্রথমে আমার মনেও একই প্রশ্ন উঁকি দিয়েছিল। তাই দেরি না করে সাথেসাথে আমি এডমিনিস্ট্রেশন অফিসে গেলাম। সেখান থেকে আমাকে জানানো হল, রোগীর বাবা বর্তমানে তার চাকরি হারিয়েছে এবং হাসপাতালের ব্যয় বহন করতে অক্ষম, সেহেতু তারা আর এখান থেকে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাখে না।
ওওও...মন খারাপ হল হাজী সাহেবের। সহজাতভাবেই তার কন্ঠে বেদনার সুর বেজে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলেন, তো পরবর্তীতে আপনি কী করলেন?
- আমি তখন ম্যানেজারের কামরায় গিয়ে তাকে অনুরোধ জানালাম, এই শিশুর চিকিৎসা যেন হাসপাতালের ফান্ড থেকে করা হয়। কিন্তু আমার অনুরোধ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করল ম্যানেজার। উল্টো বলল, এটি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। কোনো দাতব্য সংস্থা নয় যে ধরে ধরে লোকজনের চিকিৎসা করা হবে।
আমি ভগ্ন মনোরথে ম্যানেজারের কামরা থেকে বেরিয়ে এলাম। ওই শিশু ও তার মায়ের জন্য ভীষন খারাপ লাগছিল। হঠাত আমি আমার পকেটে হাত দিয়ে হজ্বের জন্য তুলে আনা টাকাগুলোর স্পর্শ পেলাম। স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। এক লহমা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, হে আকাশ ও জমিনের মালিক, তুমি আমার অন্তরের কথা জানো। তোমার ঘরের জিয়ারতের চেয়ে আমার নিকট অধিক প্রিয় কিছু নেই - তাও তোমার অজানা নয়। পবিত্র কাবা, রাসুলের (সাঃ) মসজিদের দর্শনলাভে আমি জীবনভর চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু আজ যখন আমার পকেটে নগদ অর্থ রয়েছে, শরীরে শক্তি আছে, এবং হজ্বে যাওয়ার সকল আনুষ্ঠানিকতা আমার সম্পন্ন, সে মুহূর্তে আমি এক ভিন্ন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি। এক অসহায় নারী ও তার সন্তানের চিকিৎসা-ভাবনা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আমি নিজের স্বপ্ন পূরণের চেয়ে এই সামর্থ্যহীন মানুষগুলোকে সহায়তা করাটাকে শ্রেয় মনে করছি। তুমি আমায় ক্ষমা কর প্রভু! দয়া করে তোমার রহমত থেকে আমায় বঞ্চিত করো না।
মনস্থির শেষে আমি হাসপাতালের ক্যাশিয়ারের কাছে গেলাম। তার হাতে নগদ অর্থগুলো তুলে দিয়ে সেই অসুস্থ শিশুর সম্ভাব্য ছয় মাসের ব্যয় অগ্রিম পরিশোধ করলাম। শেষে ক্যাশিয়ারকে বললাম, আমার এই অনুদানের কথা যেন শিশুর মাকে না জানানো হয়। বরং জিজ্ঞেস করলে যেন এটা বলা হয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে সেবাদানের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিশেষ বাজেট রয়েছে। সেখান থেকেই তার ছেলের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে।... (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
৮৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন