যে গল্প প্রেরণা জোগায়ঃ সম্রাট কায়সার ও অপরাজেয় মুসলিম যুবক ======================================
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান বিন আনোয়ার ২৪ আগস্ট, ২০১৯, ০৩:২৯:৩৫ দুপুর
প্রবল পরাশক্তি রোমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলেন হযরত উমর (রা)। সেই সৈন্যদলে ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা নামে এক টগবগে সাহাবী। যুদ্ধ ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছিল; মুসলমানদের দৃঢ়তা ও সাহস দেখে অবাক হচ্ছেন রোম সম্রাট কায়সার। তিনি ভাবলেন, মুসলমানদের এমন বলিষ্ঠ লড়াইয়ের রহস্য কী তা উদ্ঘাটন করতে হবে। ফলে এক মুসলিম বন্দীকে তাঁর সামনে হাজির করার নির্দেশ দিলেন তিনি। ধরে আনা হল হযরত আব্দুল্লাহ বিন হুজাফাকে। দু'হাত, দু'পা তাঁর শেকলে বাঁধা। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ। খানিক সময় তার সঙ্গে কথা বললেন কায়সার। বিস্মিত হলেন যুবকের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা দেখে।
কায়সার বললেন, তুমি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ কর; আমি এখনই তোমায় মুক্তি দিয়ে দিব।
আব্দুল্লাহ অস্বীকৃতি জানালেন।
কায়সার আবার বললেন, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তোমাকে আমার অর্ধেক রাজত্ব দান করব।
রাজি হলেন না আব্দুল্লাহ। কায়সার তখন আরো লোভনীয় প্রস্তাব পেশ করলেন। বললেন, যদি আমাদের ধর্ম গ্রহণ কর, তোমাকে অর্ধেক রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গে আমার ক্ষমতার অংশীদার বানাব।
সাহাবী এবার জবাব দিলেন, যদি আপনি আপনার পুরো রাজ্য, আপনার পূর্ব পুরুষদের সকল ক্ষমতাও আমাকে দান করেন, বিনিময়ে এক মুহূর্তের জন্য আমাকে আমার দ্বীন থেকে সরে যেতে বলেন, তাতেও আমি রাজি হব না।
বেজায় রাগ হলেন সম্রাট। বললেন, তবে তোমাকে আমি হত্যা করব।
খুশিমনে সায় জানালেন যুবক। বললেন, আপনি আমায় হত্যা করতে পারেন; কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য আমাকে আমার দ্বীন থেকে সরাতে পারবেন না।
ক্রোধে প্রমত্ত সম্রাটের নির্দেশে আব্দুল্লাহকে একটি কাঠের ফলকে বাঁধা হল। তারপর তীরন্দাজদের নির্দেশ দেওয়া হল ফলকের চারপাশে তীর বর্ষণ করতে। এ যেন এক ভয়ানক মৃত্যু-খেলা! চলল দীর্ঘ সময়। মাঝেমাঝে সুযোগ বুঝে ধর্মান্তরের প্রস্তাব দিতে থাকলেন রাজা। কিছুতেই কিছু হল না। বন্দী সাহাবী বারবার তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন; এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গনের অপেক্ষায় থাকলেন।
সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সম্রাট বন্দীকে পুনরায় জেল হাজতে প্রেরণ করলেন। ঘোষণা করলেন, আগামী নির্দেশ পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন এই কয়েদীকে আহার না দেয়। রাজার হুকুমে অসহায় বন্দীকে দিনের পর দিন অনাহারে রাখা হল। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, কষ্টে-যন্ত্রণায় আব্দুল্লাহ প্রায় মৃত্যুমুখে উপনীত হলেন।
এবার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হল। মরনোন্মোখ আব্দুল্লাহর সামনে পরিবেশন করা হল মদ ও শোকরের গোশত। উদ্দেশ্য, এতে যদি তাঁর মজবুত ঈমানকে টলানো যায়। কিন্তু বুকে যার দৃপ্ত ঈমান, হৃদয়ে যার খোদার ভালবাসা, তার পরাজয় কি এত সহজে ঘটে?
দুর্বল ও প্রায় অচেতন আব্দুল্লাহ কোনোরকমে খাবার দুটো দেখলেন; এবং সাথেসাথে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। উপস্থিত কারারক্ষীদের উদ্দেশ্যে বললেন, "আমি জানি, এ যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থায় আমার জন্য এসব খাবার বৈধ। তবুও আমি চাই না কাফেরের দল আমাকে নিয়ে উপহাস করুক। তাই এ খাবারগুলো আমি কোনোভাবেই স্পর্শ করব না।"
কয়েদীর এহেন প্রতিজ্ঞায় সবাই হতভম্ব। রাজাও যারপরনাই বিস্মিত হলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন যথাযথ ভাল খাবার পরিবেশনের। তবে বললেন, কোন সুন্দরী রমণী দিয়ে তাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে দেখ। কাজ হলে আমাকে জানিয়ো। যথা-আজ্ঞা কয়েদীর প্রকোষ্ঠে এক সুন্দরী রমণীকে হাজির করানো হল। এই নারী তার মায়াবী রূপ ও সৌন্দর্য-লাবণ্যে হযরত আব্দুল্লাহকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করবেন। কীসের কী! সব যেন বিফল প্রচেষ্টা! আব্দুল্লাহ তার দিকে ফিরেও তাকান নি। শেষে রেগেমেগে ওই কারাগার থেকে বেরিয়ে গেল ছলনাময়ী নারী। সবার কাছে নিজের ক্ষোভ ঝেড়ে বলতে লাগল, তোমরা আমাকে কার কাছে নিয়ে এলে? সে কি মানুষ না পাথর? আমার দিকে একটিবার তাকালও না! আমি পুরুষ নাকি নারী এটাই যেন সে জানে না!
সব ঘটনা শুনলেন কায়সার। তাকে হতাশা ও জেদ চেপে ধরেছে। সামান্য এক কয়েদীর কাছে বারবার তাকে পরাস্ত হতে হচ্ছে- এ যেন মেনে নিতে পারছেন না তিনি। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে এবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। আব্দুল্লাহ ও তার সহযোদ্ধা অপর এক কয়েদীকে তার সামনে হাজির করতে বললেন। এক গরম তেলের পাত্রে সেই মুসলিম বন্দীকে ফেলে দিতে বললেন রাজা। তা-ই করা হল। আব্দুল্লাহ কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলেন। দুঃখে তার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। চোখে জমছে অশ্রুবিন্দু। অথচ কিছুই করতে পারছেন না তিনি। সীমাহীন নিষ্ঠুরতা ও কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে সেই মুসলিম বন্দী শাহাদাত বরণ করলেন। তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। হাড়গুলো উপরে ভাসতে লাগল। সে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য।
নিষ্ঠুর রাজার চোখে তখন খুনের নেশা। এবার তিনি আব্দুল্লাহর দিকে তাকালেন। বললেন, এখনো সুযোগ আছে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে আমাদের ধর্ম কবুল করে নাও। নইলে পস্তাতে হবে!
কখনোই না! - দৃপ্ত শপথে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন বীর আব্দুল্লাহ।
ক্রোধে ফেটে পড়লেন কায়সার। রাগে বেসামাল হয়ে এবার আব্দুল্লাহকেও সেই তপ্ত কড়াইয়ে নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। রাজার আদেশ মুহূর্তেই পালন করা হল। জ্বলন্ত তেলের অসহ্য তাপে হযরত আব্দুল্লাহ কেঁদে ফেললেন। তার দু'চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়তে শুরু করল। এক পৈশাচিক হাসি ছড়িয়ে পড়ল কায়সারের মুখে। বললেন, নিজের ধর্ম ত্যাগ কর। যা চাও তা-ই দিব।
আব্দুল্লাহ অস্বীকার করলেন।
যেন বাকরুদ্ধ হলেন রাজা। ভেবে পেলেন না এমন সঞ্জীবনী শক্তি কোথায় পেল এ মুসলিম! - এতই যদি শক্তি, তবে এখন কাঁদছ কেন? জিজ্ঞেস করলেন সম্রাট।
আমি কাঁদছি কারণ জ্বলন্ত তেলে নিক্ষেপের জন্য আমার কেবল একটিমাত্র প্রাণ আছে। আল্লাহর কসম! আমার মাথার চুলের সমপরিমাণ যদি আমার প্রাণ থাকত, তবে সকল প্রাণকে আমি এভাবেই আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করতাম। নিজেকে দ্বীনের জন্য বিলিয়ে দিয়ে গর্ববোধ করতাম।
চূড়ান্ত হতাশা গ্রাস করল রাজাকে। বুঝতে পারলেন, এ ঐশ্বরিক শক্তিকে পরাজিত করা তার কম্মো নয়। তাঁর সকল চেষ্টার ভরাডুবি হয়েছে। শেষ প্রয়াস হিসবে তিনি বললেন, ঠিক আছে, অন্তত আমার মাথায় একটা চুমু খাও তবে। আমি তোমাকে ছেড়ে দিই।
এ প্রস্তাবে সায় জানালেন আব্দুল্লাহ। তবে দাবি করলেন, আমার সঙ্গে অন্যান্য সকল মুসলিম বন্দীকে ছেড়ে দিতে হবে।
রাজি হলেন কায়সার। এছাড়া তাঁর যেন কোন উপায়ও ছিল না !
কথানুযায়ী কায়সারের মাথায় চুমু খেলেন আব্দুল্লাহ বিন হুজাফা। পৃথিবীবিখ্যাত রোম-সম্রাটকে এই সামান্য দক্ষিণাতে সন্তুষ্ট থাকতে হল। অবশেষে অন্যান্য মুসলিম বন্দীদের সঙ্গে নিয়ে বীরদর্পে মুসলিম শিবিরে ফিরে এলেন আব্দুল্লাহ।
যুদ্ধ শেষে যখন এমন অভূতপূর্ব ঘটনা হযরত উমরের কাছে বর্ণনা করা হল, আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন আমিরুল মুমিনীন। বললেন, প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য আজ আব্দুল্লাহর কপালে চুমু খাওয়া। কারণ এর মাধ্যমেই তিনি অগণিত মুসলিম বন্দীকে কাফেরের বন্দীদশা থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। সবার সুবিধার্থে আমিই প্রথম শুরু করছি। এই বলে দাঁড়িয়ে আব্দুল্লাহর কপালে চুমু খেলেন হযরত উমর। মুসলিম উম্মাহ তার আরো এক সাহসী সৈনিককে গর্বের সাথে বরণ করে নিল।
বিষয়: বিবিধ
১০৭০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমরা ভুলে গেছি আমাদের ইতিহাস
মন্তব্য করতে লগইন করুন