ফ্রিডম অভ এক্সপ্রেইশন, ব্লাসফেমি, শার্লি হেব্দো এবং ইসলামের অবস্থান (১ম পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন ইমরান বিন আনোয়ার ১৭ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৯:৫২:৩৯ সকাল

(কথাগুলো একটি ইংরেজি বক্তব্যের অনুবাদ। একজন সত্যানুসন্ধানী, ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে এগুলো যে কারো জানা থাকা প্রয়োজন)

“প্রিয় ভাই, প্যারিসের ঘটনার একটি নেপথ্য-কারণ আছে। শার্লি হেব্দো ম্যাগাজিন যে অথরিটির মাধ্যমে প্রকাশিত হত- তার নামও ছিল শার্লি হেব্দো। সে মূলত নবীজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কার্টুন এঁকেছিল। সে তার পত্রিকায় নবীজিকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করেছে। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নিউজ পেপার’ (৮ই জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ২০১৫)-এর তথ্য অনুযায়ী, ওই পত্রিকায় মুসলমানদের নবীকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এ ধরণের দুস্কর্ম থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। বর্তমানে হঠাৎ করে যে ঘটনাটি একটি বৈশ্বিক আলোচনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে, এর পেছনে একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। মুসলিম ইউনিটি হিসেবে আমরা বলতে পারি, এটা ঘটেছে মূলত নবীজির প্রতি ব্লাসফেমি’র রিএকশন হিসেবে।

Blasphemy: (ব্লাসফেমি)

সকল মিডিয়া এবং প্রেস-এর কাছে এই 'ব্লাসফেমি' শব্দটি একটি কমন ওয়ার্ড। ব্লাসফেমি শব্দটির এটিমোলোজি (শব্দতত্ত্ব) হল, এটি দু'টো গ্রীক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। যেটি প্রকৃতপক্ষে 'ইনজুরিং দ্যা সিক্রেটনেস' বা মানুষের গোপনীয়তায় আঘাত বুঝায়। একদল মানুষের একান্ত গোপন বা ব্যক্তিগত ব্যপারে আপনি যখন আঘাত করবেন, তখন এটাকে ‘ব্লাসফেমি’ বলা হবে। ডিকশনারির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ব্লাসফেমি হল; “An act of passing a sarcasm or committing a contend against someone who’s referred as God by the people”- এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে চরম বিদ্রুপাত্মক উস্কানি বা তাকে নিয়ে তর্ক করা, যিনি মানুষের কাছে খোদা বলে স্বীকৃত। বিশ্বের বহু দেশে এই ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। এমনিভাবে সে দেশগুলোর আইনে আরো একটি বিষয় আছে, যাকে বলা হয়- 'ফ্রিডম অভ এক্সপ্রেইশন এন্ড ফ্রিডম অভ স্পীচ'। ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর দ্যা কভিনেন্ট অভ পলিটিক্যাল এফেয়ার্স’এর আর্টিকেল ১৯-এ বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মুক্ত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। আইন অনুযায়ী, মানুষ যাই বলুক-না কেন, সবাই আন্তর্জাতিকভাবেই স্বাধীনতাপ্রাপ্ত। ঠিক একই আর্টিকেল আবার এটাও বলেছে, "(সবকিছুই বলা যাবে) কিছু সীমাবদ্ধতার সাথে"। তারপর সেই সীমাবদ্ধতাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তুমি যাই বলো না কেন, সেটা পাবলিক ইন্টারেস্টের বিপক্ষে যেতে পারবেনা। এমন কিছু হতে পারবেনা যা মানুষের ক্ষতির কারণ হয়। এছাড়া আরো বেশ কিছু পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

যখনই মুসলমান এবং অমুসলমানের মাঝে এধরণের কিছু (ধর্মীয় ব্যপারে উস্কানি) ঘটে, অধিকাংশ সময় আমরা তাদের উদ্দেশ্যকে বুঝতে চাইনা এবং প্রায় সময় তারাও বুঝেনা যে, আসলে ইসলাম বা ইসলামের সাথে সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে মুসলমানদের অবস্থানটা কী। যেমন আল্লাহ, নবী মোহাম্মদ সাঃ, পবিত্র কোরআন বা ইসলামের যেকোনো বিষয় (মুসলমানদের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ!)।

সেই গল্পটিঃ

ইন্টারন্যাশনাল আইনটির পেছনের গল্প শুনলে আমরা জানতে পারব যে, এটা (ফ্রিডম অভ এক্সপ্রেইশন এন্ড ফ্রিডম অভ স্পীচ-এর আইন) আসলে কীজন্য তৈরি করা হয়েছিল। যখন বৃটেন পুরো বিশ্বজুড়ে শাসন করে যাচ্ছিল, তখন তাদের চার্চগুলো রাজনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী ছিল। এবং দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই চার্চ মানুষের স্বাধীনতায় নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করত। হোক সেটা মানুষের কোনো প্রাইভেট বিষয় বা সেটা হোক পাবলিক কোনো ব্যপার! তারা খুব বাজেভাবে মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছিল। এমনকি মানুষের কোনো কথা বলার বা নিজেদের সাধারণ ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশেরও অধিকার ছিল না। হোক না সেটা বাইবেলের বিরুদ্ধে খাঁটি বলে প্রমাণিত! উদাহরণস্বরূপ, মনে করুন, বাইবেলে বলা আছে; (Genesis: Ch : 01: 01-03) জেনেসিস নামক বইয়ে যখন আপনি ১নাম্বার আয়াত থেকে ৩০ নাম্বার আয়াত পর্যন্ত পড়বেন; সেখানে উল্লেখ পাবেন- গাছপালা উদ্ভিদ বেড়ে উঠেছে তৃতীয়দিনে, তারপর প্রভূ সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন চতুর্থ দিনে। মনে করুন কেউ একজন প্রশ্ন করে বসল, এটা কিভাবে সম্ভব? কারণ ভেজিটেইশন তো ফটোসিনথেসিস (photosynthesis) ছাড়া বৃদ্ধি পায়না। আর ফটোসিনথেসিসের জন্য আপনার সূর্যকে লাগবেই! (এখন সূর্য যদি ভেজিটেইশনের পরে সৃষ্টি হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ব্যপারটা কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল না?)

আপনাকে যখন বলা হবে যে আপনি ব্লাসফেমি আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন, মানেটা হল; আপনি ধর্মের সেন্টিমেন্সকে উস্কে দেওয়ার মত অপরাধ করেছেন এবং যে কাজে শাস্তি দেওয়া হয় তা করেছেন। এডওয়ার্ড হোয়াইটম্যান (Edward Wightman), ১৬১২ সালে তাকে ব্লাসফেমির জন্য পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এটা বর্তমান ব্লাসফেমি নয়, তখনকার ব্লাসফেমির কথা বলছি। তার অপরাধটা ছিল, সে চার্চের বাইবেলের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। আর তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। পরে তারা এই আইন শুধরে নিয়েছিল এবং থমাস এইকেনেড নামে (Thomas Aikenhead) এক ব্যক্তিকে ১৬৯৭ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল।

ইংল্যান্ডে সর্বশেষ ব্লাসফেমি আইনে শাস্তি দেওয়া হয়েছে ১৯২২সালে। এর আগ পর্যন্ত সেখানে ব্লাসফেমি আইন ছিল। এমনকি ইসরাইলের মত দেশের সংবিধানের আর্টিকেল ১৭০ থেকে ১৭৩- বলা হয়েছে (Israel’s Constitution; Article: 170, 173), যে কেউ ‘ওল্ড টেস্টিমোনি’ বা তাওরাহ'র বিপক্ষে কিছু বলবে, অথবা যে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কটুক্তি করবে, তাকে জেলে দেওয়া হবে এবং সে কঠিনভাবে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। তারমানে তাদেরও ব্লাসফেমি আইন আছে। ইন্ডিয়ার সংবিধানে ((Indian Constitution: Article- 259, 259 (a)) আর্টিকেল নাম্বার ২৫৯ এবং ২৫৯-এর 'ক' তে বলা হয়েছে, কোনো মানুষই কারো ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করতে পারবেনা। এই ব্লাসফেমি ইন্ডিয়াতেও অপরাধ। পাকিস্তানের সংবিধানের ২৯৫ এবং ২৯৯-এর 'ক' , পুরো অংশেই ব্লাসফেমি অপরাধের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এমনকি আপনি যদি অস্ট্রিয়া, জার্মানি, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভিয়া রিপাবলিক, ফ্রান্স, ইটালিতে যান, (সেখানেও ব্লাসফেমি আইনের দেখা পাবেন) ইটালিতে সংবিধানের ২৭৪নম্বর ধারাটি ব্লাসফেমি আইনের কথা বলেছে। এই সবগুলো দেশেই এমন কিছু আইন আছে যা ব্লাসফেমি আইনকে সমর্থন করে। ((চলবে))

বিষয়: বিবিধ

১২৬৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

300529
১৭ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:৪৭
কাহাফ লিখেছেন :

ব্লাসফেমী আইন সম্পর্কে কিছুটা জানা হল উপস্হাপনা পড়ে!
পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম!
সাবলীল বর্ণনা ভাল লাগল!
জাযাকাল্লাহু খাইরান!!
১৭ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৪
243190
ইমরান বিন আনোয়ার লিখেছেন : আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। লেখাটি অনুবাদ করার ক্ষেত্রে আমার একটা ব্যপারই অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে, অন্তত কিছু মানুষের এই বিষয়গুলো জানা থাকা প্রয়োজন। জীবনের কোনো একটা সময়ে এই কথাগুলো অবশ্যই কাজে লাগবে বলে আশা করি! আপনি কষ্ট করে পড়েছেন বলে আবারো ধন্যবাদ জানাই। ভালো থাকুন।
300530
১৭ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:৫০
মোতাহারুল ইসলাম লিখেছেন : ফ্রীডমের একোটা সীমা আছে। আমি মুক্ত, কিন্তু আমি যথেষ্ট মুক্ত না হোয়াইট হাউসে প্রবেশের জন্য।
300554
১৭ জানুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৫:৩৬
ইমরান বিন আনোয়ার লিখেছেন : দারুণ বলেছেন! আমাদের সব অধিকারেরই কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। যখন আমরা সেই সীমা লঙ্ঘন করি, তখনই শুরু হয় সমস্যা।
300590
১৭ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১০:১৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন দেখা যায় ইসলাম এর ক্ষে্ত্রে কিন্তু ইসরাইল বা ইহুদিদের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে তখন হয়ে যায় এন্টি সেমিটিজম!
300597
১৭ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১১:০১
ইমরান বিন আনোয়ার লিখেছেন : যথার্থ বলেছেন! ইসলামকে গালাগালি করার বেলায় তাদের যত ফ্রিডমের কান্নাকাটি শুরু হয়! আর ওদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই সেটা হয়ে যাবে 'নির্বুদ্ধিতা'! যতসব পাগলের দল!!!
300636
১৮ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:০৭
হতভাগা লিখেছেন : শুধু ব্লাসফেমী আইনই না অযথা, ফালতু ও ঝামেলা সৃষ্টিকারী কথা বার্তা বলার ব্যাপারে ট্যাক্স বসানো উচিত ।
300653
১৮ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:৪১
ইমরান বিন আনোয়ার লিখেছেন : হ্যা, তাই করা উচিৎ। অন্যথায় মানুষগুলো একে অপরের বিপক্ষে উস্কানী আর কটুক্তি করেই যাবে! আইনের চেয়ে ট্যাক্স বসিয়ে দিলেই মনে হয় বেশি ভালো হবে Happy। আইনের চেয়ে টাকার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বেশি! ডেম ইট!!!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File