চলো ভাল মানুষদের গল্প শুনি

লিখেছেন লিখেছেন ইমরান বিন আনোয়ার ১৯ মার্চ, ২০১৪, ১০:৪৮:২০ সকাল

ঘড়ির কাঁটা তখন নয়'টার আশেপাশে ঘুরছে। ভার্সিটিতে আমাদের আরো একটি ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডক্টর সা'দুদ্দীন বরাবরের মতই তাঁর অসাধারণ উপস্থাপনায় বক্তব্য রেখে চলেছেন। পাঠক, মূল আলোচনা শুরু করার আগে আমাদের এই সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়কে আপনাদের সাথে একটু পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি একজন মরক্কো'বাসী। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ইমাম মালেক (রহঃ) এর মাজহাবের অনুসারী। আমরা যদি তাঁকে জ্ঞানের জগতে এক 'বিস্ময়কর প্রতিভা' বলে সম্বোধন করি, তবু তাঁর গুন বর্ণনার পুরোটা আদায় হবেনা বলে আমাদের বিশ্বাস। ইসলামী-জ্ঞান বিষয়ে আপনি তাঁকে যে কোনো প্রশ্নই করুন না কেন, তিনি এমন সাবলীলভাবে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকবেন যে, অবশেষে খুশি মনে আপনি পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হবেন! জ্ঞানের আকাশে অজস্র নক্ষত্র হয়তো আমাদের হৃদয়কে উদ্ভাসিত করেছে, তবে তাঁর মত এতটা দীপ্তিমান-উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের চোখে আর একজনও পড়েছে বলে মনে হয়না! যাইহোক, এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমাদের ক্লাসে আজ অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা চলছিল। কথা-প্রসংগে সেখানে একজন মহা-মনীষীর নাম এল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক। ডক্টর আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, "এই তোমরা কি জান হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক কে?" আমাদের উত্তর পাওয়ার আগেই তাঁর জ্ঞানের ভান্ডার ক্রম-উদ্ভাসিত হতে লাগল। ডক্টর আরম্ভ করলেন............"আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক (রহঃ)। জ্ঞান ও চরিত্রের অতুলনীয় সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন যে প্রখ্যাত তাবেয়ী'। তাঁর আনুগত্য ও খোদাভীতি ছিল পবিত্র কোরআনের সেই উপমা, যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ "আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মাঝে শুধুমাত্র আলেমগণই ভয় করেন।" মনীষী হযরত কাসেম বিন মুহাম্মদ (রহঃ) ইবনে মুবারাক-এর একটি ঘটনা এভাবে তুলে ধরেন যে, "তাঁর সাথে একদিন আমরা সফরে বের হই। সেসময় আমার মনে যে কথাটি খুব বেশি করে বাজছিল তা'হল, কী এমন অসাধারণ গুণ অর্জন করেছেন এ মানুষটি যার কল্যাণে তিনি আমাদের চেয়ে এত বেশি মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন! মানুষের কাছে এক পরম-বন্ধুতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি যেমন নামাজ পড়েন, আমরাও তো পড়ি। তিনি রোজা রাখেন, আমরাও তাঁর মত রোজা রাখি। তিনি আল্লাহ'র পথে জ্বিহাদ করেন, আমরাও কি জ্বিহাদে যাইনা? তাঁর মত আমরাও হজ্জ পালন করি। অথচ! সেদিন শাম'-এর পথে চলাবস্থায় রাতের বেলা একটি বাড়িতে আমরা যাত্রা বিরতি করলাম। হঠাৎ সেখানে আলো নিভে গেল। আমাদেরই এক বন্ধু তখন বাতি ধরানোর চেষ্টায় এদিক সেদিক কিছু খুঁজছিল। কিছু সময় পরে সে যখন বাতিটি ধরিয়ে আনল তখন আমি দেখলাম -ইবনে মোবারক কাঁদছে। আর চোখের পানিতে তাঁর দাড়িগুলো ভিজে গেছে। সেসময় আমার ভাবনায় এল, ঠিক এই কারণেই তিনি আমাদের সবার চেয়ে শ্রেয়। আমি নিশ্চিত, আলো না থাকাবস্থায় অন্ধকারে তিনি কিয়ামতের কথা ভাবছিলেন! আর সে কথা ভেবে তাঁর গন্ড বেয়ে কষ্টের স্রোতধারা গড়িয়ে পড়ছিল।" বন্ধুরা, এই হলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক। যার সম্পর্কে বলা হয়, একজন সাহাবী ও তাঁর মাঝে মর্যাদার মান্দন্ডে শুধুমাত্র এতটুকু পার্থক্য যে, সাহাবী নবীজীকে (সাঃ) দেখেছেন। কিন্তু ইবনে মুবারাকের সে সৌভাগ্য হয়নি। ব্যস, এতটুকুই তফাৎ! একবারের ঘটনা। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক যখন কু'ফা নগরীতে প্রবেশ করেন তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, একজন অসহায় নারী শহরের ময়লা-আবর্জনার পাশে বসে একটি মৃতজন্তু খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি সাথে সাথে সে মহিলার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন যে, "হে স্রষ্টার অনুচারীনী! আপনি কি জানেন না আল্লাহ তায়া'লা মৃতপ্রানী খেতে নিষেধ করেছেন?" তখন উত্তরে সে মহিলা বললেন, "এখান থেকে চলে যাও তুমি। ক্ষুধার জ্বালা কতটা তীব্র হয় সে কষ্ট তুমি বুঝবেনা।" ইবনে মুবারাক তার কথায় আহত হলেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে এসে লোকজনকে ওই মহিলার কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, মহিলার স্বামী তাকে ও কয়েকটি শিশু-বাচ্চা রেখে মারা গিয়েছে। বর্তমানে জীবন ধারণের জন্য তার কাছে কিছুই নেই......। সময়টা ছিল হজ্জের মৌসুম। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক নিজেও তখন নফল হজ্জের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু শহরের মাঝে এক অবলা নারীর এমন রিক্ত-শূণ্য অবস্থা তাঁর সংকল্পকে নাড়িয়ে দিল। তিনি ওই হৃদয়বিদারক ঘটনা জেনে তাঁর হজ্জের সমস্ত টাকা-পয়সা ওই অসহায় মহিলাকে দান করে দিলেন। যখন হজ্জের মৌসুম শেষ হয়ে এল, লোকজন তাঁর কাছে দলে দলে আসতে লাগল তাঁকে অভিবাদন জানাতে এবং সবার মাঝে তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল তাঁর একটু সাক্ষাৎ পেতে। যারা তার সাক্ষাৎ-লাভে ধণ্য হল তারা তাঁকে জানাল যে, আমরা অনেক কষ্টে লোকজনের ভীর সামলে আপনার কাছে পৌঁছেছি। আমরা হজ্জের সময় আপনার সাথে অমুক অমুক জায়গায় ছিলাম। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক তাদের এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন! তিনি মানুষজনকে বলতে লাগলেন যে, আমি তো এ বছর হজ্জে যাইনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তাঁর সরল স্বীকারোক্তিতে মানুষের মাঝে বরং কিছুটা কৌতুকের জন্ম নিল। তারা খুব দৃঢ়তার সাথে বলতে লাগল যে, আমরা অবশ্যই আপনাকে পবিত্র মক্কায় দেখেছি। আপনি অমুক জায়গায় এটা করেছেন-সেটা করেছেন ইত্যাদি। এতে ইবনে মুবারাকের বিস্মিত- ভাব আরো বেড়ে গেল। তিনি যত অস্বীকারের চেষ্টা করেন যে আমি এ বছর হজ্জে যাইনি, মানুষজন তাঁর কাছে আরো বেশি তাঁর হজ্জ পালনের ব্যপারটি তুলে ধরতে থাকে। অতঃপর দিন পেরিয়ে রাত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক বিছানায় গা এলিয়ে দেন। একসময় ঘুমের মাঝে তিনি স্বপ্ন দেখেন, কেউ একজন তাকে বলছে; "হে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক! আল্লাহ তায়া'লা সে দরিদ্র মহিলার জন্য তোমার 'দান' কবুল করেছেন এবং একজন ফেরেস্তাকে তোমার আকৃতিতে প্রেরণ করেছেন, যেন সে তোমার পক্ষ থেকে পবিত্র হজ্জ আদায় করতে পারে।" সুবহানাল্লাহ! প্রিয় পাঠক, বুঝতে পেরেছেন কত বড় নেয়া'মত আল্লাহ তায়া'লা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাককে দান করেছিলেন। ইবনে মুবারাকের কিন্তু বুঝতে বাকী থাকেনি প্রকৃতপক্ষে মক্কায় কী ঘটেছিল। সুবহানাল্লাহ! তাঁর মত এমন সৌভাগ্যবান পুণ্যাত্মা আর ক'জন ছিল বলুন! মহান আল্লাহ তায়া'লা দুনিয়াতেই খুশি হয়ে তাঁর সৎকাজের প্রতিদান দিয়ে দিয়েছেন। আর আখেরাতে যে অকল্পনীয়-চিত্তাকর্ষক নেয়া'মতে তাঁকে ভূষিত করবেন, সে সীমাহীন সুদৃশ্য আনন্দ-ভাবনা কি আমাদের কল্পনাতেও ঠাই পাবে?

বিষয়: বিবিধ

১৭৯৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

194588
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১০:৫৩
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম, জাজাকাল্লাহুল খাইরান, অনেক সুন্দর পোস্ট
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:৫৬
145138
ইমরান বিন আনোয়ার লিখেছেন : ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বারাকাল্লাহু ফি-কা। ধন্যবাদ।
194630
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:৩৩
আবু আশফাক লিখেছেন : ভালো মানুষদের গল্প শুনি। চলুক।
জাযাকাল্লাহ খাইরান ফিদদুনিয়া ওয়া আখেরাহ।
১৯ মার্চ ২০১৪ সকাল ১১:৫৮
145139
ইমরান বিন আনোয়ার লিখেছেন : ওয়া ইয়্যাকুম। আল্লাহু ইউআফিনা ফিদ্দুনয়া ওয়াল আখিরাহ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File