যুদ্ধ কার বিজয় কার
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান বিন আনোয়ার ০৭ মার্চ, ২০১৪, ০৪:২২:৪৩ বিকাল
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। কারণ এটা এত বেশি 'কমপ্লিকেইটেড', এতটা স্বার্থের চোরাবালিতে ঢাকা যে, মাঝেমাঝে মনে হয়; এই স্বাধীনতা অর্জন আর অনাদিকাল ধরে অন্যের দাসত্বে অপমানিত জীবন ধারণ করায় কোনো তফাত বুঝি ছিলনা! বাংলাদেশী-বাস্তবতায় আমার কথাটা কতটুকু সত্য, সেটা জ্ঞানী পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন। তবু আমার কথার বিপরীতে কেউ যদি প্রতিবাদের ঝড় উঠাতে চান, সেক্ষেত্রে মুচকি হেসে আমি রণে-ভঙ্গই দিব। কারণ, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বিতর্কে যেতে আমার কখনোই ভাল লাগেনা। গলা ফাটিয়ে ষাঁড়ের মত আমরা নিজেদের যুদ্ধ-ইতিহাস নিয়ে যা বলি সেটা হল, ন্যাংটো-পাকিস্তানীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের সাধারণ মানুষগুলো এক অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। আর তাদেরকে সেই প্রলয়ংকরী যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল কোনো এক 'দেশপ্রেমী' 'মহান' নেতা। যদিও ৪২'বছর পর এসেও আমরা আমাদের সেই 'দেশপ্রেমী' 'মহান' নেতাকে চিহ্নিত করতে পারিনি। সে যাইহোক, নয় মাসব্যাপী সে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আমাদের নিরস্ত্র-অসহায় 'তিরিশ-লাখ' মানুষ প্রাণ হারান। প্রায় 'দুই থেকে আড়াই লাখ' অবলা নারীর সম্ভ্রম ছিনতাই হয়। একথাগুলো ধ্রুব-তারার মতই সত্য! এবং এ তথ্যগুলো আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম 'ঘুমপাড়ানি মাসী-পিসি'র গল্পের মতই শুনে আসছি। যদিও আমরা লৌকিক-বিষন্ন প্রাণে এটা দাবি করি যে, মহান স্বাধীনতা-যুদ্ধে আমাদের বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি ঘটে। নারীদের সীমাহীন সম্ভ্রম-লুট ও ব্যপক ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, আমাদের সেই অকল্পনীয় আত্মত্যাগ আর অগণিত দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা শুধুমাত্র রাজনীতির শ্লোগানই বানিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে শহীদদের কাছে কৃতজ্ঞতা-প্রদর্শনে আমরা কখনোই আন্তরিক হইনি। সতীত্ব হারানো সে নারীদেরকে আমরা প্রকৃত বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে পারিনি। ফলে স্বাধীনতা-সংগ্রাম, নিরীহ বাংলার মানুষগুলোর বিস্ময়কর আত্মদানের কাহিনী আমাদেরকে যতটা না অনুপ্রাণিত করেছে, তারচেয়ে বেশি করেছে দ্বিধাগ্রস্থ। আমাদের রাজনীতি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে এতটা গোলকধাঁধায় নিক্ষিপ্ত করেছে যে, মুক্তিযুদ্ধের মহান কীর্তিগুলোয় আমরা গর্বিত হওয়ার পরিবর্তে বরং সেগুলো দিয়ে আমাদের বুকে আক্ষেপের হাহাকার ধ্বনিই বেশি উচ্চারিত হয়। এটা বলাই যায়, নিজেদের শ্রমে অর্জিত স্বাধীনতা নামক এই অমূল্য সম্পদটি সাধারণ মানুষের কল্যাণে কোনই কাজে আসেনি। আমরা সাধারণেরা, একে নিয়ে উদ্বুদ্ধ হওয়ার মত যথেষ্ট অবকাশই পাইনি! আর এই হতাশার হাহাকারে, স্বাধীনতাকে নিয়ে আমাদের নির্মোহতাকেই কাজে লাগিয়েছে কিছু আত্মসর্বস্ব-ধুরন্ধর শয়তানের দল। এটা যেমন আমাদের নিজ-ভূমে হয়েছে, দেশের বাইরেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং আবহমান কাল থেকেই দেশের বাইরে আমরা ক্ষণে-ক্ষণে সেই দৃষ্টান্ত দেখে আসছি। যার সর্বশেষ 'ফিল্মি-সংযোজন' হয়েছে ইন্ডিয়ার প্রভাবশালী 'ফিল্ম-প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান' 'যশরাজ ফিল্মস' নির্মিত 'গুন্ডে' ছবির চিত্রনাট্যে। আলী আব্বাস জাফর পরিচালিত ছবিটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার পাশাপাশি চরমভাবে বিকৃত করা হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ছবিটির শুরুর দিকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ভিডিও চিত্র দেখানোর পাশাপাশি হিন্দি ভাষায় বলা হয়, "১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ শেষ হয়। ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা হিন্দুস্তানের সেনাদের সামনে আত্মসমর্পণ করেন। জন্ম হয় বাংলাদেশ নামে নতুন এক দেশের"। হিন্দিতে আরও বলা হয়, "যখন হিন্দুস্তানের সেনারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন কাঁটাতারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল ১১-১২ বছরের দুই অনাথ বন্ধু বিক্রম ও বালা। তারা বুঝতে পারছিল না, তাদের সঙ্গে যা হলো তা কি ঠিক ছিল, নাকি ভুল? নতুন দেশ কি তাদের নতুন জীবন দেবে"? ছবিটির শুরুর দৃশ্যে দেখানো হয়, ভারতীয় যোদ্ধাদের সামনে আত্মসমর্পণ করছেন পাকিস্তানি সেনারা। আর জন্ম হচ্ছে বাংলাদেশের। পেছনে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর পোস্টার। উদ্বাস্তু শিবিরের সামনে দিয়ে রুটি ছুড়তে ছুড়তে চলেছে ত্রাণের গাড়ি, আর কাদামাটি থেকে তা কুড়িয়ে খাচ্ছে অসহায় মানুষ। ছবিটিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখানো হলেও কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়নি। তারমানে আমাদের লাশের উপর দিয়েই আমাদেরই সীমানায় রক্তের হুলি খেলায় মেতে উঠেছিল দুই চরম পিশাচ-গোষ্ঠী। আমাদের ভূমিকা সেখানে 'চিঁড়েচ্যাপটা-কলুর বলদ' ছাড়া আর কিছুই ছিলনা! এই কি তবে আমাদের জন্ম-উৎস মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত কারণ! যদি বুর্জোয়া-মিথ্যাবাদী কাহিনীকারদের আমরা দৃঢ়তার সাথে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারি, তাদের ক্ষতিকারক তথ্য-জীবণু দিয়ে আমাদের ইতিহাস দূষিত হওয়ার আগেই ওদের কূটকৌশলকে আমরা নস্যাৎ করে না দিই, তবে জাতি হিসেবে সত্যিই কি আমাদের পরিচয় সংকটে পড়তে হবেনা?
বিষয়: বিবিধ
৯৮২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন