প্রবাসে আমি খোদাকে দেখেছি
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান বিন আনোয়ার ০৩ মার্চ, ২০১৪, ০২:১৬:৩৪ দুপুর
ছেলেটি নাইজেরিয়ান। আমাদের ক্লাসমেট ছিল। মাঝেমাঝে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকত বলে টিচাররা টুকটাক বকাঝকা করতেন। একেতো ভীনদেশি, তারওপর আবার কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক! তাই পুরো সেমিস্টার একসাথে পার করে দিলেও তার সাথে কখনো আমাদের কথাবার্তা হয়নি। সেমিস্টার শেষে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সবাই যার যার আপন-ঠিকানায় চলে গেল। আমিও আমার বিদেশ-বিভূঁইয়ে একমাত্র আপনজন ভাইয়ার বাসায় চলে এলাম। পুরোটা বন্ধে আমার একমাত্র কাজ ছিল, সেই ঘুম-জড়ানো ভোর থেকে শুরু করে রাত বারোটা পর্যন্ত শুধুমাত্র ল্যাপটপ-কম্পিউটারের সামনে বসেই দিন পার করে দেয়া। নিজের বেডরুম আর বাসার চারদেয়ালের গন্ডি ছাড়াও পৃথিবীটা যে আরো বিচিত্র আনন্দে ভরপুর, বন্ধের সে সময়টাতে আমার একবারের জন্যও কথাটি মনে হয়নি। যাইহোক, নিঃসঙ্গ-অলস সময়টা পার করে আবারো ভার্সিটির মনোরম আঙ্গিনায় পা ফেলতে শুরু করেছি। নতুন সেমিস্টার যে শুরু হয়ে গেছে! অবশ্য আরো কিছুদিন 'নির্ভার' থাকার আশায় হোস্টেলে এখনো ফিরে যাইনি। একদিন ভাইয়া মসজিদ থেকে বের হয়ে বাসায় ফেরার পথে আমাকে জিগ্যেস করলেন, " কিরে, তুই অই ছেলেটারে চিনছ নাকি? ও'তো কয়েকদিন আমাকে তোর কথা বলল। তোর সাথে নাকি পড়েছে"। আমি অবাক হয়ে বললাম, "কোন ছেলে"? ভাইয়া আমাকে ধমক লাগালেন। বললেন, "আরে, যে ছেলেটা প্রতিদিন আমাদের মসজিদে নামাজ পড়ে। কী যেন নামটা ও--র, ভুলে গেছি"। আমি বললাম, "ঠিক আছে। আরেকবার মসজিদে এলে ওর সাথে কথা বলব"। ভাইয়ার কন্ঠে বেদনা ঝড়ে পড়ল, "আহারে, ছেলেটা এক্কেবারে গরীব। কিছুই নাই। মসজিদের বারান্দায় একটা চাদর বিছিয়ে থাকে। মসজিদ কমিটির কঠোর নিষেধ থাকায় আমি তাকে ভিতরে জায়গাও দিতে পারছিনা"। ভাইয়ার কথা শুনে আমি'তো তাজ্জব বনে' গেলাম। আমাদের সাথে পড়েছে, অথচ এমন কষ্ট-ক্লেশে জীবন কাটাচ্ছে এমন কোনো ছাত্রের কথা'তো আমার জানা নেই! তাছাড়া ভার্সিটির ছাত্র হয়ে সে কেন মসজিদের বারান্দায় রাত কাটাতে যাবে? তার তো নিশ্চয় কোনো নির্ধারিত বাসস্থান থাকার কথা! হয়তো হোস্টেল অথবা কোনো আত্মীয়ের বাসা! ভাবনার দোলাচলেই পুরোটা দিন কেটে গেল। সেদিন মসজিদে গিয়ে তাকে খুব ভালভাবে খোঁজ করলাম। নাহ, এমন কোন চেহারাই আমার চোখে পড়েনি যাকে দেখে মনে হয় সে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। পরদিন ফজর নামাজ শেষে বাসায় ফিরে সবেমাত্র বসেছি, অমনি ড্রয়িংরুম থেকে ভাইয়ার ডাক এল। "ইমরান, এদিকে আয়"। আমি হন্তদন্ত হয়ে ভাইয়ার ডাক শুনে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি একটা ছেলে বসে আছে। খুব ভাল করে সাদা রুমালে দু'দিক থেকে চেহারা ঢাকা থাকায় প্রথমে ওর চেহারাটা দেখতে পাইনি। একেবারে কাছে গিয়ে যখন তার সাথে কথা বলতে উদ্যত হলাম, তখনি প্রথম তার মলিন-পরিচিত চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। দেখেতো একেবারে "থ" হয়ে গেলাম। কোনোমতে আরবীতে জিগ্যেস করলাম, "আনতা----তুমি"? আমার অভিব্যক্তি দেখে সে যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। লাজুক হেসে হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বেশ কিছুটা সময় নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময় শেষে তাকে জিগ্যেস করলাম, "তুমি স্কলারশিপ পাওনি"? জবাবে সে যা বলল সেটি শুনে যেকোনো মানব-হৃদয়েই কষ্টের চোরাস্রোত বয়ে যেতে বাধ্য । ......অনেক স্বপ্ন নিয়ে এদেশে পাড়ি জমিয়েছিল সে জীবন-দুর্বিপাকে কিছুটা শান্তির স্পর্শ পাবার আশায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঘটেছে উল্টো! বেঁচে থাকার চিরন্তন সংগ্রাম এখানেও তাকে মুক্তি দেয়নি। বরং ফেলে আসা দুঃসহ অতীতের চাইতেও ভয়ানকভাবে তাকে দংশন করে চলেছে বর্তমান-বাস্তবতা। এখানে তার কাফীল (স্পন্সর) সাফ জানিয়ে দিয়েছে, থাকা-খাওয়া কিংবা জীবন চালানোর সামান্যতম উপকরণও সে তার কাফীলের কাছ থেকে পাবেনা। উপরন্তু প্রতিমাসে স্পন্সরশিপ বাবদ দেড় হাজার রিয়াল (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা) মুনাফা' দিতে হবে! এ যেন মৃত্যু-পথযাত্রীকে নরকের পথ দেখিয়ে দেওয়া। দু'বেলা অন্ন জোগাতে যে মানুষ তিনবেলা খেটে-ফিরে, সে কিনা প্রতি মাসে স্পন্সর-বাবদ দেড় হাজার রিয়াল-ফি পরিশোধ করবে! জীবন কতটা নিষ্ঠুর তা আমাদের সাবেক ছাত্র-বন্ধুটি খুব দ্রুতই অনুধাবন করে ফেলেছে! তথাপি অনেক কষ্টেসৃষ্টে গত প্রায় দেড়টি বছর কাটিয়ে দিয়েছে সে স্বপ্নের রঙ্গীন ফানুসগুলো বাস্তব হয়ে ধরা দেবে এই আশায়। এক সময় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাপীঠ ও সুপ্রাচীন জ্ঞান-কেন্দ্র জামিয়া' আযহার তথা মিসরের আযহার ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল সে। সেখান থেকে ক্রেডিট-ট্রান্সফার বা যে কোনো উপায়ে এখানে এসে ভার্সিটিতে এডমিশন নেয়। কিন্তু জীবন এখানেও তাকে নির্মম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে। ভার্সিটি থকে স্কলারশিপ না পাওয়ায় টিউশন-ফি সহ যাবতীয় পড়াশোনার খরচ তার নিজের উপরই বর্তায়। ফলে সেমিস্টার শেষে আট হাজার রিয়ালের (প্রায় ১লক্ষ সত্তর হাজার টাকা) বিশাল ঋণের বোঝা তার উপর চেপে বসল। আর যথারীতি ভার্সিটির ফি আদায় না করা পর্যন্ত নতুন সেমিস্টারে ভর্তি হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই তার জন্য। ব্যপারটা দাড়িয়েছে এমন, ভার্সিটি ও কাফীলের নির্ধারিত পাওনা পরিশোধ না করে সে দেশত্যাগও করতে পারবেনা! আহারে জীবন! সুখ-পাখি নামে যে অলীক স্বপ্নে আমরা বিভোর হয়ে যাই প্রতিটি মানব, সে সুখ-সাধনা অবশেষে আমাদের জীবনটাকেই খাদের কিনারে ফেলে দেয়। অবশ্য এত এত কষ্ট- যাতনা, চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা ক্রমাগত সংকট-বেলায়ও ছেলেটি কারো কাছে সাহায্য চায়নি। নিজের অবিরাম কষ্ট-স্রোত কারো কাছে ব্যক্ত করেনি। শুধু সারাদিন মসজিদে বসে বসে কোরআন তিলাওয়াত করেছে। নামাজ পড়েছে, দোয়া করেছে। পৃথিবীর সব দুঃখ-কষ্ট যিনি মুহুর্তেই বিলীন করে দিতে পারেন সেই অনন্ত- অসীম দয়াময়ের কাছে বেদনার আর্তি জানিয়েছে। দুখের সব অশ্রু সমর্পন করে সাহায্য প্রার্থনা করেছে। বান্দা যখন কায়মনোবাক্যে আল্লাহ'র কাছে দোয়া করে, হৃদয়ের সবটুকে আবেগ ঢেলে দিয়ে তাঁর কাছে কোনো কিছুর আর্জি পেশ করে, তখন অপরিসীম ভালবাসার অধিকারী আমাদের প্রভূ কি আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন? না, তিনি পারেননা। ভালবাসার দাবীতেই তিনি আমাদের রিক্ত হস্তে তাড়িয়ে দেননা। সেজন্যেই আল্লাহ ছেলেটির দোয়া কবুল করলেন। ভাইয়ার সাথে ছেলেটির পরিচয় হল। আমিও জানতে পারলাম তার না বলা কথাগুলো। ভাইয়া একদিন আমাদের মসজিদের খতীব সাহেব ও আরেকজন ধণাঢ্য-ব্যবসায়ীর কাছে ছেলেটির জন্য সহযোগিতা কামনা করলেন। তারা সাথে সাথেই নিজেদের মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে রাজী হয়ে গেলেন ছেলেটিকে সাহায্য করতে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল সৌভাগ্যের ঝর্ণাধারা! মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা'আলা তাঁর কুদরত দেখাতে শুরু করলেন। প্রথম বেলাতেই এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে দশ হাজার পাঁচশ' রিয়াল উপহার এল। এবং তিনি এটাও বললেন যে, "এখন থেকে প্রতিমাসেই আমি তাকে তিন হাজার রিয়াল হাত-খরচ দিব ইনশাআল্লাহ"। আমাদের খতীব সাহেব, ডক্টর সুলতান ইবরাহীম আল-হাশেমী, যিনি আবার ভার্সিটিতে আমাদের শ্রদ্ধেয় উস্তাদও; তিনি বললেন আবারো যাতে ছেলেটির ভার্সিটি-এডমিশন হয় সেজন্যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করবেন। এভাবে আরো অনেকেই ছেলেটিকে সহায়তা করতে আগ্রহী হয়ে উঠল। আর সে নিজে, রাত-দিন বিরামহীনভাবে নামাজ-রোজা, কোরআন তিলাওয়াত করে আল্লাহ'র কাছে নিজের অক্ষমতা ও অপারগতা পেশ করে চিরকালীন কল্যাণ ও মুক্তির জন্য আরো বেশি দোয়া করতে লাগল। এখানে আসার পর থেকে সে প্রতিদিনই রোজা রাখছে। আমরা নিজেরা এতটা দৃঢ় ঈমানের অধিকারী নই যে, প্রতিদিন রোজা রাখার দৃপ্ত ইচ্ছা বুকে লালন করতে পারি! ফলে সেই ছেলেটির অর্জিত নেক আমলের সামান্য অংশীদার হওয়ারই কেবল চেষ্টা করে যাচ্ছি আমরা। প্রতিদিন সে আমাদের ক্ষুদ্র মেহমানদারীতে ইফতার করে। নিজেদের সাধ্যমত তাকে রাতের খাবারটুকু গ্রহন করাতেও আমরা চেষ্টা করে যাই। কবুল করার মালিক আল্লাহ! তাকে দেখে একটা ব্যপার খুব বেশি মনে গেঁথে গেছে, আল্লাহ'র কাছে চাওয়ার মত চাইতে পারলে, তিনি পৃথিবীর যে কোনো প্রাণীকেই তার প্রয়োজনীয় সাহায্যটুকু দান করেন। তাকে ভালবেসে এক পা' এগিয়ে গেলে, তিনি আমাদের দিকে দৌড়ে আসেন; সে কথাটি কি কখনো ভুল হতে পারে??
বিষয়: বিবিধ
১১৮১ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাই হোক দুইজনে মিলে চলুম
আসল কথায় আসি,
শিরোনামটা একটু অন্যভাবে দিলে ভালো হতো কেননা আল্লাহকে কেউ এই পৃথিবী থেকে দেখতে পাবে না। তবে তার নেয়ামত,দয়া,ভালোবাসা,সাহায্য এগুলো দেখে আল্লাহকে অনুভব করা যায়।
তিনি যে এক অদ্বীতিয় তা অনুভব করা যায়।
তাই সিরোনামটা "প্রবাশে আমি আল্লাহর রহমত কে দেখেছি" হলেই ভালো হতো।
আর একটি কথা "আরবিতে বা কোরআনে বা সহিহ হাদিসে আল্লাহর কোথাও খোদা নাম নাই"
শিকরা তাদের সৃস্ঠি কর্তাকে খোদা নামে ডাকে তাই এই শব্দটা না ব্যাবহার করাই উত্তম।
আল্লহ আপনার নেক নিয়ত কবুল করুন আমিন।
ঘটনাটা পড়ে আমার মত মায়া দয়াহীন যুবকের চক্ষুদ্বয় থেকে কিছুটা অশ্রু গড়িয়ে পরল মাটিতে!আসলেই চাওয়ার মত চাইতে পারলে প্রভূ তারে ফিরায় না!আল্লাহ মহান,আল্লাহ মহান,আল্লাহ মহান।
অসাধারন ঘটনাটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন